৯/১১
অমীমাংসিত এক ট্র্যাজিক উপাখ্যান!
বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় অভিনব ও অবিশ্বাস্য বিমান হামলা করা হয়। জানমালে ক্ষতিসাধন হয় অপরিমেয়। আজ সেই ভয়াল দিনটির ১৭তম বর্ষপূর্তি। দিনটি এখনো ভুক্তভোগীদের স্মৃতিতে অম্লান। এক অসম যুদ্ধভীতি, গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অলীক সন্দেহপ্রবণতা এবং কথিত মুসলিম জঙ্গি হামলার আশঙ্কার মধ্য দিয়ে গভীর শ্রদ্ধায় দিনটি স্মরণ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও নিহতের স্বজনরা।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর অস্ত্র সক্ষমতার যুগেও প্রতিপক্ষ কাউকে দাবিয়ে রেখে ফায়দা লুটবার তরিকাটা এখনো সাম্রাজ্যবাদীদের অন্দরমহলের কূটপরিকল্পনাতেই রয়ে গেছে। দৃষ্টিগ্রাহ্য সরাসরি বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার চেয়ে বড় অস্ত্র হলো ‘জঙ্গিবাদ’। জঙ্গিবাদ রীতিমতো চাষ করা যায়, পেলেপুষে পরিপুষ্ট করা যায় এবং যারা চাষ করে, তারা ফল পায় আর যারা চাষের মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তারা মূলত সগোত্রীয়দের মারে এবং নিজেরা বেঘোরে মারা পড়ে।
এই জঙ্গিবাদের ভয়াল দংশন প্রমাণের প্রথম ও এখন পর্যন্ত বৃহৎ স্মারক হলো, নাইন/ইলেভেনের বিমান হামলা। যেহেতু এই হামলার পেছনে মুসলিম সন্ত্রাসীদের দায়ী করা হয়, এ কারণে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ ধর্মগোষ্ঠী মুসলিমদের মধ্যে রয়েছে নানা অবিশ্বাস ও সংশয়। এমনকি অমুসলিমদের অনেকেও এখন পর্যন্ত অভাবনীয় এ হামলার ঘটনার পূর্বাপর নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ ও সর্বৈব সত্য বিষয়ে সন্দিহান।
কিন্তু বিমান হামলায় নির্দোষ যাঁরা সেদিন প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের কারুণ্য নিশ্চিতার্থেই আজীবনই বিশ্ববাসীর প্রাণ স্পর্শ করে থাকবে। অনাহুত আক্রমণে আমাদের বাঙালিসহ প্রাণ হারানো হাজারো মানুষের প্রতি আমাদের প্রাণান্ত প্রণতি। আমরা তাঁদের গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।
১৭ বছর আগে এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারসহ একযোগে চালানো চারটি আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন অন্তত তিন হাজার মানুষ, আহত হন অন্তত ছয় হাজার জন। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টায় এই ঘটনা ঘটে। চারটি মার্কিন যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করে এ হামলা চালায় আত্মঘাতী সন্ত্রাসীরা। দুটি বিমান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের উত্তর ও দক্ষিণ টাওয়ারে আঘাত হানে। গুঁড়িয়ে ধসে পড়ে ভবন দুটি। আমেরিকান এয়ারলাইন্সের ছিনতাই করা আর একটি বিমান নিয়ে হামলা চালানো হয় মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগনে। তবে যাত্রীদের চেষ্টায় নির্ধারিত স্থানে হামলা চালাতে ব্যর্থ হয়ে পেনসিলভানিয়ার আকাশে বিধ্বস্ত হয় চতুর্থ বিমানটি। যদিও বিধ্বস্ত হওয়া বিমানের ধ্বংসাবশেষ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য আজও প্রকাশ করেনি মার্কিন প্রশাসন।
এমন লোমহর্ষক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটবার পরপরই সব দায় গিয়ে পড়ে জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদাপ্রধান ওসামা বিন লাদেনের ওপর। লাদেনের মাথার দাম ২৫ মিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করে দেয় মার্কিনিরা। এ ঘটনার পর মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে আরো জোরালোভাবে ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ পায় যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্য সমাবেশের পরিধি আরো বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, নাইন/ইলেভেনের আগ পর্যন্ত আল-কায়েদা ব্যাপকভাবে মার্কিন মদতেই তাদের জঙ্গিপনার ডালপালা বিস্তৃত করবার সুযোগ পায়। সৌদি আরবের ধনাঢ্য পরিবারে জন্ম নেওয়া লাদেন আশির দশকে তরুণ বয়সে পাকিস্তানে চলে আসেন। সে সময় আফগানিস্তান সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনপুষ্ট নজিবুল্লাহ সরকারের শাসন চলছিল। লাদেন পাকিস্তানে গোপনে আশ্রয় গ্রহণ করে সোভিয়েত সেনা দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। ওই সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন সমর্থন পায় পাকিস্তান আর্মি ও সে দেশের ছত্রছায়ায় থাকা ওসামা বিন লাদেনের জঙ্গিগোষ্ঠী আল-কায়েদা।
ইতিহাসের বিস্ময়কর পরিহাস এই যে, ওয়ান/ইলেভেনের ১০ বছর পর ২০১১ সালের জুলাইতে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ থেকে লাদেনকে পাকড়াও করে হত্যা করে মার্কিন বিশেষায়িত বাহিনীর সদস্যরা। আল-কায়েদার মাথা কেটে দিতে পেরে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে মার্কিন প্রশাসন। কিন্তু ঠিক কীভাবে এত দিন মার্কিনিদের কৌশলগত মিত্র পাকিস্তানে লাদেনের মতো দুর্ধর্ষ জঙ্গিনেতা দীর্ঘদিন সহিহ-সালামতে পালিয়ে থাকতে পারলেন কিংবা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ঢুকে মার্কিন বাহিনী লাদেনকে লাশ বানিয়ে আরব সাগরে ডুবিয়ে দিতে পারল, এসব প্রশ্নের জবাব কিছুতেই মেলে না। আরো পরিহাস এই যে, এত দিন পরে জঙ্গি দমনে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আর্থিক ও প্রশিক্ষণ সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।
৯/১১ নিয়ে বিস্ময়কর সত্যের একটি হলো, হামলার জন্য অভিযুক্তদের অনেকেই এখনো জীবিত রয়েছেন বলে মাঝেমধ্যে খবর পাওয়া যায়। এ নিয়ে হামলার পরপর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল বিবিসি ও দ্য গার্ডিয়ান। আর সেই অভিযুক্তদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিতেই প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। হামলাকারীদের আমেরিকার আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। তাই নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মহলে আল-কায়েদার সফলতার চেয়ে মার্কিন প্রশাসনের ব্যর্থতার দায়ভার নিয়েই আলোচনা হয় বেশি। অবশ্য বিরুদ্ধবাদীদের কেউ কেউ এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, টুইন টাওয়ার হামলা স্রেফ বুশ প্রশাসনের মস্তিষ্কপ্রসূত ড্রামা। বিশেষ করে রাশিয়াপন্থী বিশ্লেষকরা নাইন/ইলেভেনের ঘটনার দায়ভার মার্কিন প্রশাসকদের ওপরই চাপিয়ে থাকেন। যুক্তিটাও খুব সহজ। মার্কিনিদের সমর্থন না পেলে রাশিয়াবিরোধী লাদেনের জঙ্গিসম্রাট লাদেন হওয়া হয়ে উঠত না।
নাইন/ইলেভেনের দুঃখজনক মার্কিনি সফলতা হলো, মুসলিমদের ঢালাওভাবে জঙ্গি ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া গেছে। বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে পড়েছে। এতে বিপাকে পড়ছেন উদারনৈতিক ও মানবিক মুসলিমরাও। আইএস, আল-কায়েদা, তালেবান, লস্কর-ই-তাইয়েবাসহ বহু নামে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত মুসলিম উগ্রবাদীরা সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকে এখনো অস্থিতিশীল করে রেখেছে। রোজ বোমা হামলায় নিরীহ মানুষ মারা পড়ছে। যদিও মুসলিম জঙ্গিরা যেসব অস্ত্র ও ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে জঙ্গিবাদ ছড়ায়, তার সবকিছুর নিয়ন্ত্রক ঘুরেফিরে ওই পশ্চিমা কট্টরপন্থী রাজনীতিকরাই। এমনকি বর্তমান সময়ে জঙ্গিবাদের এক ধরনের মুখপত্র হিসেবে যে গোষ্ঠী কাজ করে, তাদের বসবাসও ওই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই। ইরাকি বংশোদ্ভূত মার্কিন ইহুদি নারী রিটা কাটজ ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স’ বলে একটি বেসরকারি সংস্থা চালান। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক মুসলিম নামধারী জঙ্গিরা একটি ‘টুঁ’ শব্দ করলেও বিশ্ববাসীকে নিমেষে ওই সাইট ইন্টেলিজেন্স জানিয়ে দেয়।
ভূ-রাজনীতির এমন ঘোরপ্যাঁচ সাধারণের বোধের অনুগম্য নয়। মুসলমানদের পবিত্র ভূমি সৌদি আরবের কাছে নির্যাতিত ও নিগৃহীত হয় ইয়েমেন, কাতার, ফিলিস্তিন, লেবানন বা ইরান নামের অপর মুসলমান রাষ্ট্র। পক্ষান্তরে, লজ্জাজনক আনুকূল্য পায় মুসলিমবিদ্বেষী ইসরায়েল বা মার্কিন প্রশাসন। দেখা গেছে, ৯/১১ হামলাকারী ১৯ জনের মধ্যে ১৫ জনই ছিল সৌদি নাগরিক। এই বছরের মার্চেই বিবিসি খবর দিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ভয়াবহতম ৯/১১ হামলার ঘটনায় বিচারের মুখোমুখি হতে হবে সৌদি আরবকে। যদিও সৌদি আরবের দাবি, বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনায় তাদের কোনোরূপ সম্পৃক্ততার প্রমাণ নেই। কিন্তু মার্কিন বিচারক জর্জ ড্যানিয়েলস বলেছেন, ২০১৬ সালের সন্ত্রাসবাদবিরোধী আইন অনুযায়ী সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগটির যুক্তিসংগত ভিত্তি আছে বলেই মনে করেন তিনি। তার নির্দেশ অনুযায়ী শতকোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে করা একটি মামলা চলমান থাকবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্টশিপের দায়িত্ব গ্রহণ করবার পর প্রথম সফর করেছেন সৌদি আরব এবং সেখানে বীরোচিত সম্মাননা পেয়েছেন। উপরন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সর্বোচ্চ অস্ত্র ক্রেতার তকমাটাও এখন এই আরবের গায়েই।
কাজেই বিশ্বব্যাপী মুসলিম উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ ও ইসলাম বিদ্বেষের দায়ভার মুসলিমরাও এড়াতে পারে না। কিছু লোভী মুসলিমকে ধর্মের ‘ক্যাপ্টাগন’ খাইয়ে অর্থ ও ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের নিজেদের স্বার্থে ক্রীড়নক বানিয়ে ফেলতে পারছে। পশ্চিমাদের পাতা ফাঁদ এড়ানোর সক্ষমতা না দেখাতে পারা এবং নিজের স্বাধীনসত্তাকে সবার ওপরে স্থান দিতে না পারার ফলাফল হচ্ছে, এখন মুসলিমরাই তার মুসলমান ভাইকে কচুকাটা করছে। মধ্যপ্রাচ্যে হাজারো মুসলমান প্রাণ হারাচ্ছে তার সগোত্রীয় জালিমদের হাতে। সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ যত দিন আছে, তত দিন জঙ্গিবাদের ভয়াল বিষ থেকে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের মুক্তি নেই। ধর্মটা জঙ্গিবাদের নিমিত্ত মাত্র।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।