রম্যরচনা
কেরামত আলীর কেরামতি গরু
গরুর রচনা লেখায় দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থাকলেও গরু কেনার ব্যাপারে অভিজ্ঞতাশূন্য মানুষের অভাব নেই। এমন একজন কেরামত আলী। মধ্যবয়স্ক কেরামত আলীর ধারণা, গরু কেনা গরুর রচনা লেখার চেয়েও সহজ। যাব, পছন্দ করব, টাকা গুনে নিয়ে আসবে। ব্যস, খেল খতম গরু হজম।
প্রতিবার ঈদের আগে ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় গরু কেনার সঙ্গে কখনোই যাওয়া হয় না কেরামত আলীর। ফলে সহজ কাজটাকে আরো সহজ মনে করার যথেষ্ট সুযোগ তিনি পান। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। ঈদ আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ব্যস্ততার পারদ শেয়ারবাজারের মতো নিচের দিকে নামছে। পক্ষান্তরে, পরিবারের অন্যদের ব্যস্ততা কাঁচাবাজারের মতো ঊর্ধ্বমুখী। সেদিন বড়ভাই খাবার টেবিলে সবাইকে ডেকে গম্ভীর মুখে ঘোষণা করলেন, এবার গাধাটা গরু কিনবে। এমন কথার মানে বুঝতে পাঠকের সমস্যা হলেও ‘আলী’ পরিবারের সবার কাছে পানির মতো পরিষ্কার। বড়ভাই শুধু কেরামতকে আদর ও রাগ করে গাধা সম্বোধন করে থাকেন।
গাধা ডাকে কেরামত আলীর অভ্যস্ত হয়ে গেলেও পশুকেন্দ্রিক ঈদের সামনে তাঁকে পশুর কাতারে ফেলায় কিঞ্চিৎ মাইন্ড করেছেন। মাইন্ড করলেও তাঁর কিছু করার নেই, বলার নেই। আলী পরিবারে কেরামত গাধা হলে বড়ভাই সিংহ। তাঁর মুখের ওপর কথা বলা মানে কাটা ছাগল হয়ে সিংহের দরজায় কড়া নাড়া।
কেরামত আলী কাজের ছেলেটার সঙ্গে পশুর হাটে গেলেন পকেটভর্তি টাকা আর মুখভর্তি হাসি নিয়ে। প্রতিবার অন্যরা গরু কেনে। গরুর কোনো না কোনো সমস্যা থাকেই। কেরামত আলীর কাজ হলো কেনা গরুর ওপর রিভিউ দেওয়া। সমস্যাগুলো খুঁজে বের করে ক্রেতাকে খ্যাপানো। প্রতিবার বিপুল উৎসাহে তিনি কাজটা করেন।
এবার তাঁকে দেখিয়ে দেওয়ার পালা। কীভাবে নিখুঁত গরু কিনতে হয়, দেখিয়ে দেবেন।
পশুর হাটের ভেতরে ঢুকে দেখলেন, একটা গরুকে ঘিরে জটলা পাকানো হয়েছে। মানুষের ভিড় ঠেলে গরুর কাছে গেলেন। সবাই প্রায় হাতির সাইজ একটা গরুর সঙ্গে সেলফি তুলছে। গরুটাও কান নেড়ে সবার সঙ্গে ভাববিনিময় করছে।
স্কুলজীবনে একটা সমস্যা ছিল কেরামত সাহেবের। প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে যেতেন। গরুর ক্ষেত্রেও এমনটাই হলো। প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে গেলেন।
স্কুলজীবনে বরাবর ব্যর্থ হলেও এবার সফল কেরামত আলী। গরু কেনা হলো।
এই গরুর বিশেষত্ব হলো, তোতা পাখির মতো কথা শোনে। বসতে বললে বসে। পানি খেতে বললে পানি খায়, বন্ধ করতে বললে পানি খাওয়া বন্ধ করে। অন্য সব গরুর মতো হাঁ করে হাম্বা হাম্বা করে না। গরুর মালিক কোন টোনে কথা বললে গরু শুনবে, সেটা শিখিয়ে দিলেন। বারকয়েক ট্রায়াল দেওয়া হলো।
কেরামত আলী গরুর মালিকের শেখানো পদ্ধতিতে বললেন, পানি খা। গরু পানি খেলো। কেরামত বললেন, অফ যা। গরু পানি খাওয়া বন্ধ করে হুকুমকারীর দিকে তাকিয়ে রইল। যেন পরবর্তী আদেশের অপেক্ষায় রয়েছে।
এবার আর তাঁকে পায় কে? বাড়ি গিয়ে দেখানো হবে কেরামত আলীর কেরামতি। এমন পোষ মানানো গরু, আলী পরিবারের কেউ চোখে দেখেনি, এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত।
চওড়া মুখে গরুর রশি ধরে হাট থেকে বের হলেন। নিরীহ টাইপ মানুষ বলে তাঁকে গাধা বলা হয়। এই গরুটা তার চেয়েও বেশি নিরীহ। রশি ধরে তিনি হাঁটছেন গরুর পিছু পিছু। গরুটা যেন তাঁকে পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সিএনজি ভাড়া দিয়ে কাজের ছেলেটাকে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো। বাসায় গিয়ে সে গরু সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করবে, উৎসাহ বাড়বে সবার। কাজ কিছুটা এগিয়ে থাক।
কাজের ছেলেকে পাঠিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি বুঝতে বেশি সময় লাগল না কেরামত আলীর। সবাই দাম জানতে চাইছে। দাম বলার সঙ্গে তিনি গরুর গুণাগুণও বলে দিচ্ছেন। দাম এক লাখ ৬০ হাজার টাকা, এই গরু তোতা পাখির মতো কথা শোনে, বসতে বললে বসে, উঠতে বললে ওঠে। উৎসুক দর্শকের আগ্রহ নিবারণ করতে বারকয়েক সার্কাস দেখানোর মতো ওঠবস করানো হলো। ধীরে ধীরে মানুষ জমতে শুরু করেছে। আগে গরু হাতে হাঁটছেন কেরামত আলী। পিছে পঞ্চাশজনের মতো। নির্বাচনের সামনে হলে ভালোই হতো। লোক জমায়েত হওয়ায় একদিক থেকে লাভই হয়েছে। কেউ দাম জানতে চাইলে তাঁকে কথা বলতে হচ্ছে না। দর্শক বলে সমস্বরে জবাব দিচ্ছে, দাম এক লাখ ৬০, গরু তোতা পাখির মতো কথা শোনে। খাইতে কইলে খায়, না করলে খাওয়া বাদ দিয়া তাকিয়ে থাকে।
কেরামত আলীর পিছে ক্রমে লোকসমাগম বাড়ছে। এবার পেছন থেকে দর্শক জাপটে ধরল, ভাই, আরেকবার একটু খেলা দেখান। প্লাস্টিকের লাল বালতি ভরে পানি আনা হলো। গরুর রেস্ট নেওয়ার জন্য চট বিছিয়ে দিল উৎসাহী দর্শক।
কেরামত আলী কেরামতি দেখানো শুরু করলেন। গরুকে শেখানো সুরে আদেশ করলেন, শুয়ে রেস্ট নে। গরু বিছানো চটের ওপর শুয়ে পড়ল। জাদুকরদের মতো দর্শকের দিকে তাকালেন তিনি। তুমুল করতালি শুরু হলো। এবার তিনি পানি খেতে বলার সঙ্গে সঙ্গে গরু উঠে পানি খাওয়া শুরু করল। নিষেধ করতেই পানি খাওয়ায় বন্ধ দিল। রাস্তার পাশে দর্শক জমে গেছে। পাশ দিয়ে যাচ্ছিল এক রিকশা, সেই রিকশার চাকা হঠাৎ ফেটে গেল বিকট শব্দে। দর্শকের মাঝখান থেকে কে যেন বলে উঠল, বোম মারছেরে, বোম মারছে।
সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো হুড়োহুড়ি। লোকজনের দিগ্বিদিক ছোটাছুটি দেখে শান্ত গরুটাও হাম্বা শব্দ করে দে ছুট। কেরামত আলী দৌড়ে গিয়ে গরুর রশি ধরলেন। থামানোর চেষ্টা করলেন। গরুর মালিকের শিখিয়ে দেওয়া টোনে বার কয়েক বলার চেষ্টা করলেন, এই থাম, থাম কইতাছি। কিন্তু দৌড়ের ওপর থাকায় ভীতু গলায় শিখে নেওয়া সুর আসছিল না কিছুতেই। তিড়িং-বিড়িং লাফালাফির সঙ্গে দুর্দান্ত গতিতে ছুটে চলছে গরু। সঙ্গে রশি ধরা কেরামত। টেনে ধরে থামানোর চেষ্টা করছেন।
কোথায় কী হয়ে গেল, মনে নেই কেরামত আলীর। স্থানীয় লোকজন নাকি তাঁকে ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলের ভেতর থেকে অচেতন অবস্থায় তুলে এনে হাসপাতালে ভর্তি করে রেখে গেছে। হাসপাতালের কেবিনটায় কেরামত আলীর আত্মীয়স্বজনে ভরে গেছে। কাজের ছেলেটা গরুর ছেঁড়া রশি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেরামত আলীকে ম্যানহল থেকে উদ্ধারের সময় এই রশি তাঁর হাতে পেঁচানো ছিল।