আত্মহত্যা
অরিত্রীর অকালমৃত্যুর দায় কার?
৪ ডিসেম্বরের জাতীয় দৈনিকগুলোতে ঢাকার একটি বিখ্যাত স্কুলের নবম শ্রেণির একজন ছাত্রীর আত্মহত্যার খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতেও ব্যাপক আলোড়ন পড়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ওই ছাত্রী এই বছরের ফাইনাল পরীক্ষায় মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অসৎ উপায় অবলম্বন করায় স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী তাকে এই বছরের পরীক্ষায় বসতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মৃত ছাত্রীর অভিভাবকদের মতে, স্কুল কর্তৃপক্ষ ওই ঘটনার পর তাঁদের (অভিভাবকদের) ডেকে এ জন্য খুব খারাপভাবে বকা দেয় এবং ওই ছাত্রীকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করার কথা বলে। অভিভাবকরা অনেক অনুরোধ করার পরও কর্তৃপক্ষ তাদের সিদ্ধান্তে অনড় ছিল বলে জানা যায়। পরে বাসায় ফিরে ওই ছাত্রী ফাঁসি নিয়ে আত্মহত্যা করে।
এ ধরনের প্রতিটি সংবাদই আমাকে ধাক্কা দেয়। আমি এমনটা আর শুনতে চাই না। এই সংবাদগুলো এমনই যে না পড়েও পারা যায় না। নবম শ্রেণির ছাত্রী, কতই বয়স হয়েছিল। পুরো জীবনটা পড়ে ছিল সামনে। গোটা পরিবারটাই যে শেষ হয়ে গেল। এই ক্ষতি আর পূরণ হওয়ার নয়।
স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের আইনকানুন নিয়ে আছে। যে যত অমানুষের মতো আচরণ করতে পারেন, তিনি বোধহয় তত ভালো কর্মকর্তা!
আমার জানতে ইচ্ছা করে, স্কুলের উদ্দেশ্য কী? কেন আমরা শিশুদের স্কুলে পাঠাই? সচরাচর স্কুলের উদ্দেশ্য বিষয়ে দুটো পরস্পরবিরোধী ধারা লক্ষ করা যায়। যেমন, ‘বিজনেস রাউন্ডটেবিল’ (এ রায়ান, ২০০৪) এবং অ্যাচিভ (২০০৪)-এর মতে স্কুলের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো এমন ধরনের কর্মী তৈরি করা, যাদের বিদ্যমান পেশাগুলোতে সফল হওয়ার উপযোগী দক্ষতা ও ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য থাকবে। তবে অনেকে আবার এমন ধরনের লক্ষ্য নিয়ে স্কুল পরিচালনাকে খুব বেশি সংকীর্ণ বলে মনে করেন (ফ্রিম্যান, ২০০৫; গুডল্যান্ড, ১৯৮৪; হগকিনসন, ২০০৬; পোস্টম্যান, ১৯৯৬)। তাদের মতে, স্কুলের লক্ষ্য হওয়া উচিত সক্রিয় নাগরিক তৈরি করা, শিশুদের তাদের ব্যক্তিগত সাফল্য অর্জনের জন্য, নিজেদের সামর্থ্য বিকশিত করতে সাহায্য করা। শিশুদের এমনভাবে তৈরি করা যাতে তারা গণতন্ত্রের বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সামাজিকভাবে অবদান রাখতে সক্ষম হয়।
যদি স্কুলের লক্ষ্য হয় দক্ষ কর্মী তৈরি করা, তবে স্কুল ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের কর্মী নির্বাচনের একটি বর্ধিত বিভাগ হিসেবে কাজ করবে। স্কুলগুলো (১) শিক্ষার্থীদের এমন ধরনের কর্মীতে পরিণত করবে, যাদের কর্মী হিসেবে কাজ করার একটি ন্যূনতম মাত্রায় দক্ষতা ও প্রবণতা থাকবে এবং (২) শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিয়ে এমনভাবে ফলাফল অনুযায়ী ভাগ করবে, যাতে ব্যবসায়ীরা তাঁদের কাজের উপযোগী এমন শিক্ষার্থীদের কর্মী হিসেবে বেছে নিতে পারেন।
যাদের কর্মী হিসেবে কাজ করার দক্ষতা নেই, তাদের বাতিল করে দেওয়াও স্কুলের কাজ হবে। অর্থাৎ তাদের আর পড়ার সুযোগ দেওয়া হবে না। ফলে তাদের শিক্ষার পেছনে আর খরচও করতে হবে না। স্কুলগুলোর আরেকটি লক্ষ্য হবে উপযুক্ত কর্মীর সংখ্যা বিদ্যমান কাজের থেকে যাতে অনেক বেশি হয়। তখন ব্যবসায়ীরা সস্তায় সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থীদের কাজে নিয়ে কম খরচে ভালো কাজ করাতে পারবেন এবং লাভবান হতে পারবেন। অন্যদিকে যেসব স্কুল শিশুদের যোগ্যতাগুলোর সর্বোচ্চ বিকাশকে নিশ্চিত করতে চায়, তাদের ফলপ্রসূ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চায় সেসব স্কুলের কাজ হয় অন্যভাবে।
এই স্কুলগুলোতে শিশুদের মধ্যে এমন ধরনের গুণাবলি বিকশিত করতে চেষ্টা করা হয়, যাতে তাদের এমন ধরনের দক্ষতা, প্রবৃত্তি, মূল্যবোধ এবং জ্ঞান সৃষ্টি হয়, যাতে তারা সমাজের উৎপাদনশীল সদস্যে পরিণত হতে পারে। যাতে তারা ভালো নেতা, ভালো পিতামাতা ও দক্ষ কর্মী হিসেবে বেড়ে ওঠে। এই স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের সক্ষমতা ও আগ্রহগুলোকে শনাক্ত করা হয়, ব্যক্তিগত শিক্ষার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে তাদের সাহায্য করা হয়, তাদের নিজেদের শিক্ষাবিষয়ক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা হয়, তাদের ক্ষমতায়ন করা হয়, তাদের একে অপরের কল্যাণ নিশ্চিত করতে ও সমাজের সর্বসাধারণের বিষয়ে ভাবতে ও জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে শেখানো হয়। তাদের নানা ধরনের ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কাজ করতে ও দলগতভাবে একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করে কাজ করতে শেখানো হয়।
ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার কৌশল পরিমাপ করা হয় ও তাদের উপযোগী করে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। বিজ্ঞজনের মতে, আমরা এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির একটি মিশ্রণ করেও স্কুল শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারি। বাংলাদেশের শিক্ষানীতিতে এমন ধরনের মিশ্রণই পাওয়া যায়।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণয়ন করেছে, যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার কথা। এই নীতিতে বলা হয়েছে :
‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়নে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে বিধৃত সংশ্লিষ্ট নির্দেশনাসমূহ বিবেচনায় রাখা হয়েছে। জাতিসংঘ শিশু অধিকার কনভেনশন, যেখানে প্রত্যেক সদস্য দেশে সকল শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার তাগিদ রয়েছে, সেটিও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়ন ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্ম কুশল নাগরিক গড়ে তোলা। পাশাপাশি শিক্ষার মাধ্যমেই জাতিকে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার বৈশিষ্ট্য ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এই শিক্ষানীতি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে গণমুখী, সুলভ, সুষম, সর্বজনীন, সুপরিকল্পিত, বিজ্ঞানমনস্ক এবং মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি ও রণকৌশল হিসেবে কাজ করবে।’
এই নীতিটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত। ৭৯ পৃষ্ঠার এই দলিলে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া প্রতিরোধের ব্যবস্থা বাতলে দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের অধিকার ও কর্তব্য বিষয়ে বলা আছে। শিক্ষানীতির দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, এই নীতি অনুযায়ী বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রয়োজনীয় কর্মদক্ষতাও শিক্ষা দেয়। একটা বিষয় খুবই পরিষ্কার, শিক্ষার্থীদের স্কুল থেকে বহিষ্কার করা এই নীতিতে সমর্থন করছে না। শিক্ষানীতি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করলে পুরো দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিক পন্থায় পরিচালিত হতো বলে বিজ্ঞজনেরা মনে করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য অনুযায়ী, যেসব শিশু হাই স্কুল থেকে পড়া ছেড়ে দেয় তারা যারা লেখাপড়া শেষ করে তাদের তুলনায় কম বেতনে কাজ করে। এ ছাড়া এই স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুরা সব ধরনের অপরাধের ৭৫%-এর সঙ্গে জড়িত বলে পাওয়া যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা সমাজে অবদান রাখার মতো সদস্যে পরিণত হতে ব্যর্থ হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে স্কুল থেকে ঝরে পড়া প্রতিরোধে তাই সর্বাত্মক চেষ্টা নেওয়া হয়। লাখ লাখ ডলার খরচ করে তারা বিশেষ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, যাতে স্কুল থেকে ঝরে পড়া ঠেকানো যায়। ফলে সমাজের বোঝা হওয়া কমবে ও অনেকগুলো কচি জীবন রক্ষা পাবে। সমাজের অপরাধ কমে আসবে। দেশের অর্থনীতি বেগবান হবে।
আমাদের দেশের স্কুল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষত তথাকথিত বিখ্যাত স্কুলগুলো কিছু হলেই বহিষ্কারের চিন্তায় মেতে ওঠে। এই শিশুগুলো যাবে কোথায়? সমাজের বোঝায় পরিণত হবে? অপরাধে জড়িয়ে পড়বে? নাকি জীবন থেকেই ঝরে পড়বে? বহিষ্কারের কী ফল হবে তাদের কোমল মনের মধ্যে? নিজের ও অভিভাবকদের অপমানিত হতে দেখে হয়তো অপরাধবোধ বেড়ে উঠবে। জেগে উঠবে সর্বনাশা আকাঙ্ক্ষা। মনে রাখতে হবে, সব শিশুর সহন ক্ষমতা সমান নয়।
এর সমাধান কোথায়? শিশুদের মনের কষ্টগুলোর বিষয়ে শিক্ষকদের, কর্মকর্তাদের আরো সচেতন হয়ে উঠতে হবে।
১৭ জুলাই ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী স্কুলে স্কুলে স্কুল সাইকোলজিস্ট নিয়োগের নির্দেশনা প্রদান করেন (ঢাকা ট্রিবিউন, ডিসেম্বর ৫, ২০১৮)। নানা কারণে এটি এখনো বাস্তবায়িত হয়ে ওঠেনি। হয়তো এই নির্দেশনার মধ্যেই বর্তমান সমস্যার একটি সমাধান নিহিত রয়েছে। তবে এটির বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ।
যতদিন পর্যন্ত প্রতিটি স্কুলে মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ করা সম্ভব না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত প্রতিটি স্কুলের একজন করে শিক্ষককে কাউন্সেলিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে ছাত্রদের কাউন্সেলিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া যায়। এ ছাড়া শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে আরো বেশি করে কাউন্সেলিং ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি ঢোকানো প্রয়োজন। এ ছাড়া যারাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনিক দায়িত্বে আসবেন, তাঁদেরই বাধ্যতামূলকভাবে কাউন্সেলিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।
এ ছাড়া স্কুল থেকে ছাত্রছাত্রী বহিষ্কার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন। শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিপক্ষে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদেরও পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ রাখা জরুরি। কোনো স্কুল থেকে কোনো শিক্ষার্থী ঝরে পড়লে তার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জবাবদিহি করবে এমন বিধান থাকাও উত্তম।
যে শিশুটি আর নেই, তাকে স্মরণ করছি। তার পরিবার এই শোক সইবার শক্তি পাক। আর কোনো কচি প্রাণ যেন ঝরে না যায়, এই ধরনের সর্বনাশা সংবাদ যেন আমাদের বুকে আর কাঁপন না ধরায়, এই প্রত্যাশায় শেষ করছি।
লেখক : ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।