জনপ্রতিনিধি
এমপিদের কর্মকাণ্ড ও সরকারের ভাবমূর্তি
এক খুনি খুন করে সিঁড়ি দিয়ে পালিয়ে গেছে। আদালতে খুনির পক্ষে তাঁর উকিল বললেন, অভিযুক্ত যে খুন করে পালিয়ে গেছেন তার প্রমাণ কী? কারণ যে সিঁড়ির কথা বলা হচ্ছে সেই সিঁড়িটা কি ওপর থেকে নিচে নেমেছে নাকি নিচ থেকে ওপরে উঠেছে?সিঁড়ির উৎপত্তি রহস্য প্রমাণ করতে না পারায় খুনি খালাস পেয়ে যায়।এটা একটা কৌতুক হলেও যুক্তিতর্কের খাতিরে এমন সব কথাও বলতে শোনা যায়।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখি এ ধরনের হাস্যকর কিছু যুক্তি দিয়ে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পার পেয়ে যায় প্রকৃত অপরাধীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলেন, উপযুক্ত প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই উপযুক্ত প্রমাণটা কী?আই উইটনেসও পুলিশ ভাইদের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ নয়! আর দোষ যদি করেন কোনো মন্ত্রী কিংবা এমপি তাহলে তো কথাই নেই।
গাইবান্ধা ১ আসনের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের কথাই না হয় ধরুন।এলাকার অভিভাবক তিনি। সকালবেলা মেজাজ খারাপ হওয়ায় এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়েছেন আর সেই গুলি গিয়ে লেগেছে ৯ বছর বয়সী সৌরভের পায়ে। এমপি সাহেব তো আর সৌরভের কোনো ক্ষতি করতে চাননি, কী দয়ার শরীর তাঁর। কী নিশানা তাঁর! শুধু পায়েই গুলি লেগেছে। মাতাল হলেও তাঁর লক্ষ্যের বিচ্যুতি ঘটেনি।
ওদিকে, বোকার হদ্দ সৌরভের বাবা কী করলেন? এমপির নামে মামলা দিয়ে বসলেন। এখন ঠেলা সামলাও। ভয়ে বাড়িতেই যেতে পারছে না সৌরভের পরিবার। এদিকে পুলিশ বলছে, এমপি সাহেব যদি গুলি ছোড়েন, সেটার প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।এমপি সাহেব নাকি প্রায় সময়ই মাতাল অবস্থায় এলাকায় উল্টোপাল্টা কর্মকাণ্ড করেন।এমনকি ঢাকায় ন্যাম ভবনে তার যে ফ্ল্যাট সেখানকার কর্মচারীরা বললেন, এমপি সাহেব এই সরকারি বাসভবনেও নাকি কখনো মাতাল না হয়ে ঢুকেননি।এই ফ্ল্যাটে আর কী কী কর্মকাণ্ড করেন তিনি, আশপাশের সবাই জানলেও কারো কিছু বলার নেই। এমপি লিটনের কর্মকাণ্ড জানার পর আপনাদের নিশ্চয় মনে পড়ে যাচ্ছে পুরনো আমলের অত্যাচারী জমিদারদের কথা?
অন্যদিকে, দেশের দক্ষিণ সীমান্তে ইয়াবা ব্যবসা, মানবপাচার আর রোহিঙ্গা বৈধকরণ কাজে কক্সবাজারের সংসদ সদস্য বদির নাম বারবার এলেও তাঁর গায়ে ফুলের টোকা দেওয়ার সাহস কারো নেই।
এমপি পিনু খান কাবিখার টাকা নয়ছয় করেন আবার তার ছেলে রনি মধ্যরাতে রাজধানীর রাজপথে প্রকাশ্যে গুলি করে মানুষ মেরে ফেলেন। ময়মনসিংহের এমপি গিয়াসউদ্দিনও প্রকাশ্যে জনগণের উদ্দেশ্যে গুলি ছুড়েছিলেন।রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি সফিউর রহমান সফি কাজের আগেই বিল না দেওয়ায় নির্বাহী প্রকৌশলীকে পিটিয়েছেন। ফেনীর নিজাম হাজারীর অনুসারীরা অস্ত্রসহ র্যাবের হাতে আটক হলেও সময়-সুযোগে তারা জামিনও পেয়ে যান। শুধু কি তাই, সংসদ সদস্য মাহমুদ সামাদ চৌধুরী কয়েস বলেছেন, আমি যদি বড় কেউ হতাম তাহলে জাফর ইকবালকে কোর্ট পয়েন্টে ধরে এনে চাবুক মারতাম। ভাবা যায়? এঁরাই আমাদের জনপ্রতিনিধি!
এমপিদের এমন ঔদ্ধত্য আর গডফাদারগিরির পেছনে কি শিক্ষাগত যোগ্যতাই দায়ী? এমন প্রশ্ন অনেক অবুঝ লোক করে থাকেন। বিগত জাতীয় সংসদগুলোতে শিক্ষিত জনপ্রতিনিধির হার বাড়ানো নিয়ে সুশীল সমাজ বারবার গলা ফাটিয়েছে। এমনকি সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) জনপ্রতনিধিদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, তাঁদের আয়ের উৎস এবং সম্পদের পরিমাণ নিয়ে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে।
যদিও বরাবরই জনপ্রতনিধিদের সম্পদের বিবরণ কিংবা আয়ের উৎস নিয়ে গরমিল থেকেছে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই সরকারের আমলেই। তবে দশম জাতীয় সংসদে জনপ্রতিনিধিদের শিক্ষাগত যোগ্যতার হার তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। এটা আশার কথা। এবারে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সুজন একটি পরিসংখ্যান দিয়েছে যাতে প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে তারা একটি খতিয়ান দেখিয়েছে।
যদিও সুজন পরিসংখ্যান দেওয়ার আগে একটি মজার তথ্য দিয়েছে। সুজনের বক্তব্যটি হুবহু তুলে ধরছি- “অতীতে সুজন এর পক্ষ থেকে প্রতিটি নির্বাচনেই ভোটারদের কাছে আমরা এসকল তথ্য তুলে ধরেছি। তথ্য প্রদানের মূল উদ্দেশ্যই ছিল ভোটারদের ক্ষমতায়িত করা, যাতে তারা জেনে শুনে বুঝে সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত প্রার্থীদের নির্বাচিত করতে পারেন। আসন্ন নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ না হলেও আমরা গণমাধ্যমের সহযোগিতায় সচেতন মহলসহ ভোটারদের জ্ঞাতার্থে তথ্যসমূহ তুলে ধরছি। তবে তথ্যসমূহের সঠিকতা সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত নই। অনেকেই মনে করেন, অনেকের হলফনামায় অনেক তথ্য গোপন করা হয়েছে একং বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করা হয়েছে।”
“শিক্ষাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রে ৫৪০ জন প্রার্থীর মধ্যে অধিকাংশই (৩৮২ জন বা ৭০ দশমিক ৭৪ শতাংশ) স্নাতক বা স্নাতকোত্তর।বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ ১৫৩ জন প্রার্থীর মধ্যে এই হার ৮২ দশমিক ৩৫ শতাংশ(১২৬ জন) এবং ১৪৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ৩৮৭ জন প্রার্থীর মধ্যে ৬৬ দশমিক ১৪ শতাংশ(২৫৬ জন)। ৫৪০ জন প্রার্থীর মধ্যে স্বল্প শিক্ষিত অর্থাৎ এসএসসি বা তার চেয়ে কম শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীর হার ১৭ দশমিক ২২ শতাংশ(৯৩ জন)। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ ১৫৩ জন প্রার্থীর মধ্যে এই হার ৫ দশমিক ২২ শতাংশ(৮ জন) এবং ১৪৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিকারী ৩৮৭ জন প্রার্থীর মধ্যে ২১ দশমকি ৯৬ শতাংশ(৮৫ জন)।”
“বিশ্লেষণ থেকে আমরা আমরা এ কথা বলতে পারি, আইনসভার সদস্য পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের অধিকাংশ উচ্চ শিক্ষিত হলেও এসএসসির চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন ৫০ জন(৯ দশমিক ২৫ শতাংশ) প্রার্থী রয়েছেন। আর শিক্ষাগত যোগ্যতায় গরমিল ছাড়াও দশম জাতীয় সংসদে নির্বাচনে প্রার্থীদের আয়ের উৎস কিংবা সম্পদের পরিমাণ নিয়ে তথ্য কারচুপির অভিযোগ পাওয়া গেছে।”
এই শিক্ষাগত যোগ্যতার ৫০-৫০ ব্যালেন্স নিয়ে কি আমাদের আত্মতুষ্টির সুযোগ আছে কি না- তা জানার ইচ্ছার হলো সাম্প্রতিক সময়ের এমপিদের কাণ্ডকারখানা দেখে। সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের কাছে জানতে চাইলে তিনি একটা অসহায় হাসি দিয়ে চুপ করে থাকলেন। পরে ধীরে ধীরে বললেন, “প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানুষকে পরিবর্তন করতে পারে না যদি মানুষ সেই শিক্ষা আত্মস্থ করে নিজেকে পরিবর্তন করতে না পারে। তবে জনপ্রতিনিধিদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখতেই হবে। পরিবর্তন নিশ্চয়ই আসবে। সেদিন নিশ্চয়ই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনে শিক্ষাগত যোগ্যতাকে মূল্য দেবে। চোর-বাটপার-বদমায়েশ লোকদের জায়গা দেবে না।”
জাতীয় সংসদে এই ২০১৩ সালেও এমপিদের নোংরা কথার তুবড়ি নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। নারী সংসদ সদস্যরাও পিছিয়ে ছিলেন না। যেসব অশ্রাব্য ভাষায় তারা জাতীয় সংসদকে কলুষিত করেছেন সেটার জন্য দেশের সাধারণ মানুষের মাথা নত হয়ে গেছে কিন্তু জ্ঞানপাপী সেই সংসদ সদস্যদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা সেদিনও ছিল না, আজও নেই। অথচ তাদের অনেকেই পেশায় আইনজীবী। তাহলে শিক্ষার মানদণ্ডটাই বা কি করে ধরব আমরা? যখন শিক্ষিত হয়েও এই জনপ্রতিনিধিরা নোংরা শব্দ ব্যবহার করেন সংসদে। অনেকবারই কথা উঠেছে জনপ্রতিনিধি হিসেবে একটি ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করা হোক। এ বিষয়ে ১৯৭৩ সালের জনপ্রতিনিধি আইন সংশোধনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির আমলে শিক্ষিতের পাশাপাশি অযোগ্য অশিক্ষিত কিন্তু শুধু পেশি আর টাকার জোরে অনেককেই এমপি বানানো হয়েছে। তার ধারাবাহিকতা থেকে বেরোতে পারেনি আওয়ামী লীগ। এমনকি সর্বশেষ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেও কাদের জনপ্রতিনিধি করা হয়েছে তার প্রমাণ কিছুদিন পর পরই পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এমপিদের কার্যকলাপে বারবার বিব্রত হচ্ছেন সরকার। হয়তো ভুল করেই বা কোনো উপায় ছিল না বলেই এঁরা জনপ্রতিনিধি হওয়ার টিকেট পেয়েছিলেন কিন্তু যখন এসব জনপ্রতিনিধির কর্মকাণ্ডে মানুষ ত্যক্ত বিরক্ত তখন তাঁদের বিরুদ্ধে কেন চটজলদি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না?
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ