মৎস্যসম্পদ
ইলিশ ট্র্যাজেডি
‘ক্ষ্যাতের মইদ্যে পাচটা বড় বড় ইলিশ মাছ। উন্দুরে খাইয়া থোয়নায় কিছু।’
‘হ্যাঁ কও কি?...’। ‘হয়, সোবাহান দ্যাখছে। মনে অয় পুলিশের লড়ানি খাইয়া কেউ কোলায় হালাইয়া দৌড়াইছে।’
বরগুনার মোকামিয়া লঞ্চঘাটে দুজনের কথোপকথন।
প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ ধরার বিরুদ্ধে গত ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর অভিযান চলেছে। বৃহত্তর বরিশালের অন্যতম প্রধান নদী বিষখালীতে তুলনামূলক বেশি ইলিশ ধরা পড়ে এবং এখানের ইলিশের স্বাদও অনন্য। ফলে ইলিশের প্রতি স্থানীয়দের চাহিদা এবং সেই সঙ্গে জেলেদের অভাব বা কখনো লোভের কারণে নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ ধরা বন্ধ করা কঠিন। চুপেচাপে, ঘোপেঘাপে ইলিশ ধরা অব্যাহত থাকে। অগত্যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে পড়লে হয় হাতকড়া অথবা পালিয়ে বাঁচা। এ রকম কোনো এক জেলে হয়তো অভিযানের মুখে পড়ে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন এবং রক্ষা করতে চেয়েছিলেন পাঁচটি বড় ইলিশ, যা বিক্রি করলে হয়তো তার কিছু পয়সা হতো এবং দাদনের কিছু টাকা শোধ দেওয়া যেত। ট্র্যাজেডি হলো, দৌড়ানোর সময় তিনি হয়তো লুকিয়ে রাখার জন্য ধানক্ষেতে ফেলে গিয়েছিলেন ওই ইলিশ মাছগুলো এবং ভেবেছিলেন পরে একসময় এসে মাছগুলো নিয়ে যাবেন। কিন্তু মাছগুলো খাদ্য হয়েছে ইঁদুরের। আর এই নিয়ে শোরগোল বিষখালীর তীরে মোকামিয়া লঞ্চঘাটে।
ইলিশের এবিসিডি
মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছের অবদান প্রায় শতকরা ৪২ ভাগ। সেখানে ইলিশ মাছের অবদান এককভাবে ১২ ভাগ। আর একক প্রজাতি হিসেবে ইলিশ মাছ সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইলিশ মাছের বার্ষিক উৎপাদন ৩ লাখ মেট্রিক টনের বেশি, যার বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা।
কিন্তু পরিবেশগত পরিবর্তনের জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয় সংকোচন ও জলজ পরিবেশ দূষণের ফলে ইলিশের উৎপাদন ব্যাহত হয়। তার সঙ্গে রয়েছে প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ ধরা, নির্বিচারে জাটকা নিধন, ইলিশ ধরতে অবৈধ নান রকম জাল ব্যবহার।
ইলিশের জন্ম হয় স্বাদু পানিতে অর্থাৎ নদীতে। এরপর সে সাগরে যায়। আবার প্রজননের সময় নদীতে ফিরে আসে। এই নদী ও সাগরে চলাচলই তাঁর জীবন। ফলে ইলিশ সমুদ্রে ও নদীতে দুই জায়গায়ই ধরা পড়ে। যদিও তার স্বাদ নির্ভর করে সে কতদিন মিঠাপানিতে অর্থাৎ নদীতে চলাচল করল তার ওপর। যে কারণে সমুদ্র থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী পদ্মা নদীর ইলিশ বেশি সুস্বাদু এবং এর কদরও বেশি। মনে রাখা দরকার, পদ্মায় যেসব ইলিশ মাছ ধরা পড়ে, তারা বেশ সৌভাগ্যবান। কেননা উপকূলে সমুদ্রের পরে মেঘনাসহ অন্যান্য নদীতে ইলিশ ধরার জন্য যেসব জাল ও ফাঁদ পাতা হয়, সেই সব জাল ও ফাঁদ ফাঁকি দিয়ে যে ইলিশগুলো বেরিয়ে যেতে পারে, সেগুলোই বড় হওয়ার সুযোগ পায় পদ্মার মিঠাপানিতে। আর সেই মিঠা পানিতে সে যতদিন বাঁচবে তার শরীরে স্বাদও বাড়তে থাকবে।
সাধারণত এক বছর বয়সে ইলিশ মাছ পরিপক্বতা লাভ করে, অর্থাৎ খাওয়ার উপযোগী হয়। তবে আবহাওয়ার তারতম্যসহ অন্যান্য কারণে অনেক সময় ৮-১০ মাস বয়সেও ইলিশ মাছ পরিপক্ব হতে পারে। বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশে যে হারে ইলিশ ধরা হয়, তাতে এক বছরের আগেই অধিকাংশ ইলিশ ধরা পড়ে। যারা টিকে থাকে তারা বেশ বড় হয়। যেমন গত এপ্রিল পটুয়াখালী কলাপাড়ার রামনাবাদ নদীর মোহনায় জেলে শহিদের জালে ধরা পড়ে ২৪ দশমিক ৫ ইঞ্চি লম্বা এবং ৭ দশমিক ৮ ইঞ্চি প্রস্থ এক ইলিশ, যার ওজন ছিল দুই কেজি ৮৫০ গ্রাম। মাছটি বিক্রি হয় ১২ হাজার টাকায়।
ইলিশ রক্ষার উদ্যোগ
ইলিশ রক্ষায় প্রজনন মৌসুমে এবার ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত ১৫ দিন ইলিশ ধরা ও বিক্রি নিষিদ্ধ করে সরকার। অন্যান্য বছর এ সময় ১১ দিন হলেও এবার সময় চারদিন বাড়ানো হয়।
সরকার-নির্ধারিত ওই সময়ে ইলিশ ধরা ও বিক্রির পাশাপাশি সরবরাহ ও মজুদও নিষিদ্ধ থাকে। এ আদেশ অমান্য করলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে অভিযুক্তদের এক মাস থেকে সর্বোচ্চ ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং এক হাজার টাকা জরিমানা দিতে হয়। তবে এর পর প্রত্যেকবার অপরাধের জন্য দ্বিগুণ হারে শাস্তি ভোগ করতে হয়।
সরকারের দাবি, প্রজনন মৌসুমে ইলিশ মাছ ধরা বন্ধ থাকলে প্রায় দেড় কোটি ইলিশ মাছ রক্ষা পায়। অর্থাৎ তারা বড় হওয়ার সুযোগ পায়। বিশেষ করে প্রজনন মৌসুমে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে উপকূলে বৃষ্টি হলে এবং ওই বছর জাটকা নিধন নিয়ন্ত্রণ করা গেলে পরের বছর ইলিশের বাম্পার উৎপাদন হয়। সুতরাং এবার প্রজনন মৌসুমে যে হারে বৃষ্টি হয়েছে তাতে জাটকা নিধন নিয়ন্ত্রণ করা গেলে আগামী মৌসুমে আমজনতাও বড় ইলিশ চেখে দেখতে পারবে বলে আশা করা যায়। যদিও এর অনেকটাই নির্ভর করছে ধরা পড়া ইলিশ আসলেই কতটা বাজারে এলো আর কতটা পাচার হলো তার ওপর।
জেলেরা খাবে কী?
ইলিশ রক্ষার উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। এই উদ্যোগের ফলে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে বলে সরকারি হিসেবে বলা হয়। প্রশ্ন হলো, মাছ ধরেই যাঁদের জীবিকা চলে, তাঁরা মাছ ধরার এই নিষিদ্ধ মৌসুমে কী করবেন? কী করে পেট চলবে?
জেলেদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারলেও এই সময়টুকুতে যাতে তাঁরা খেয়েপরে বেঁচে থাকতে পারেন, সেজন্য কিছু চাল ও নগদ অর্থ বরাদ্দ দেয় সরকার। কিন্তু স্থানীয় সরকারের চিরাচরিত অনিয়ম দুর্নীতিতে সেসব সহায়তা যে অনেক সময়ই প্রকৃত জেলেদের রান্নাঘর পর্যন্ত পৌঁছায় না, তা প্রতিবছরই নানা সংবাদমাধ্যমে আসে।
জেলেদের জন্য ভিজিএফ ও বিকল্প কর্মসংস্থানে সরকারের বরাদ্দ অর্থ বণ্টনে দুর্নীতির অভিযোগ এনে সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছে ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতি। যেখানে অভিযোগ করা হয়, জেলেদের খাদ্যসহায়তায় ভিজিএফ ও বিকল্প কর্মসংস্থানের অর্থ লুট ও অনিয়ম এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। দরিদ্র জেলেরা যাতে সরকারি সাহায্য ঠিকমতো পান, তার ব্যবস্থা গ্রহণে প্রধানমন্ত্রীরও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় সংবাদ সম্মেলনে।
জেলেরা বলেন, আইন যতই কঠিন হোক, পেটে ভাত না থাকলে তা প্রয়োগ করে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা কঠিন। তাই ইলিশের প্রজনন মৌসুমের ১৫ দিনের কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রকৃত জেলেরা যাতে বিকল্প কর্মসংস্থান বা পুনর্বাসনের আওতায় আসে, যাতে এখানে অনিয়মত দুর্নীতি না হয়, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। সেই সঙ্গে সহায়তা হিসেবে যে অর্থ বা চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেটিও পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে।
সম্প্রতি চাঁদপুরে এক অনুষ্ঠানে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দিপু মণি কিছুটা আশার বাণী শুনিয়ে বলেছেন, ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন জেলেদের জন্য বরাদ্দ চালের পরিমাণ বাড়ানো হবে। তিনি বলেন, সারা দেশে বছরে দুবার ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা থাকে। এ সময় জেলেদের ৪০ কেজি চাল দিলেও তা বর্তমান বাজারে সংসার চালানোর জন্য খুবই সামান্য। ফলে এ চাল আরো বাড়িয়ে দেওয়া হবে। সেই সাথে বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য জেলেদের বিভিন্ন উপকরণ দেওয়া হয়। এসব উপকরণ সঠিকভাবে ব্যবহার করলে তাদের ভাগ্য পরির্বতন সম্ভব বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ইলিশ ট্র্যাজেডি
ইলিশে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো, যে জেলের জালে ইলিশ ধরা দেয়, সেই ইলিশ অধিকাংশ সময়ই ওই জেলের রান্নাঘর আলোকিত করে না। ছোটখাট দু-একটা মাছ জেলে তাঁর পরিবারের জন্য নিয়ে গেলেও আকারে বড় ইলিশগুলো তাঁকে রেখে যেতে হয় মহাজনের আড়তে। কেননা মহাজনের কাছ থেকে দাদন নেওয়া আছে। আবার যদি কারো দাদন নাও থাকে, তারপরও একটু ভালো দামের আশায় জেলেরা অপেক্ষাকৃত বড় মাছগুলো বিক্রি করে দেন।
আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে যেসব জাটকা ও নিষিদ্ধ মৌসুমে বড় ইলিশ আটক হয়, সেগুলো কোথায় যায়?
৮ অক্টোবর এনটিভি অনলাইনের একটি খবর ছিল এ রকম, ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার এক জেলের বাড়ির ফ্রিজে রাখা মা ইলিশ উদ্ধার করে স্থানীয় এতিমখানায় বিলিয়ে দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। বড়ইয়া ইউনিয়নের কলাকোপা এলাকার জেলে বেলায়েত হোসেনের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ঘরের ভেতরে রাখা একটি ফ্রিজ থেকে ৫০ কেজি ডিমওয়ালা ইলিশ উদ্ধার করা হয়। এ সময় বেলায়েত হোসেন পালিয়ে যান। জব্দ করা ইলিশ মাছগুলো স্থানীয় এতিমখানায় বিতরণ করা হয়।
অন্যান্য স্থানেও এ রকম অভিযানে আটক অধিকাংশ ইলিশের গন্তব্য হয় বিভিন্ন মাদ্রাসা ও এতিমখানা। তাও ভালো যে, এই সুযোগে এতিমখানার শিশুরা অধরা ইলিশের স্বাদ পায়।
তবে সব সময়ই যে আটক হওয়া ইলিশ মাদ্রাসা ও এতিমখানায় যায় তাই নয়, বরং অভিযোগ আছে, এসব ইলিশ অনেক সময় চলে যায় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বাসায়।
২ অক্টোবর বাংলানিউজের একটি খবর ছিল এ রকম, বরগুনার তালতলী উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা ১৪টি মা-ইলিশসহ আটক করে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। ইলিশের প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা ও পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও মাছ পরিবহনের দায়ে তাকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে বলে জানায় স্থানীয় প্রশাসন। এ বিষয়ে তালতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাবুল আখতার বলেন, এলাকাবাসী তাঁকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে।
শুধু ইলিশ মাছ নয়, মাদকবিরোধী অভিযানেও প্রতিনিয়ত লাখ লাখ ইয়াবা, ফেনসিডিল, মদ, গাঁজা ইত্যাদি আটক করা হয়। এর একটি অংশ টিভি ক্যামেরার সামনে ধ্বংস করে ফেলা হলেও বাকি মাদক কোথায় যায় তা অনেকেই জানেন।
ইলিশ না খেলে কী হয়?
অর্থনীতির সেই সহজ সূত্র- চাহিদা কমলে দাম কমবে; চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বে। যে কারণে পহেলা বৈশাখে যখন বস্তুত ইলিশ মাছ ধরা নিষেধ, ওই সময়ে যেহেতু বাঙালিকে ‘বাঙালি’ হওয়ার জন্য ইলিশ মাছ খেতেই হয়, সে কারণে এক হাজার টাকার ইলিশ মাছ অনেকে ১০ হাজার টাকায়ও কেনেন। অর্থনীতির এই সূত্র অনুযায়ী আরো দেখা যায়, সারা বছর যে পাবলিক বেগুন খায় না, রোজার মাসে সেও বেগুনের ওপর নজর দেয়, ফলে ২০ টাকার বেগুন রোজার মাসে কিনতে হয় ১০০ টাকায়। প্রশ্ন হলো, বেগুন না খেলে কী হয়?...একই প্রশ্ন, ইলিশ না খেলে কী হয়?...আপনার শরীরে যে আমিষের প্রয়োজন তা মেটানোর জন্য ইলিশ খাওয়া বাধ্যতামূলক নয়। সুতরাং ইলিশের জন্য জান হারাম করে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। ইলিশ না খেলে কিছু হয় না- এই ধারণাটা বদ্ধমূল হলে প্রথমত জাটকা ধরা বন্ধ হবে, বৈশাখে ইলিশ নিয়ে একটা সিন্ডিকেটের কোটি টাকার বাণিজ্য বন্ধ হবে, ইলিশ কিনতে পারে না এমন দুর্বল অর্থনীতির মানুষের মন খারাপ হওয়াও বন্ধ হবে।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক ও উপস্থাপক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর