নিরাপত্তা
ধর্ষণ প্রতিরোধে কোন পথে আমরা?
মানুষের নৈতিকতার যখন চরম অধঃপতন ঘটে, তখনই তারা ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ করে। সাম্প্রতিককালে কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রতিনিয়িতই ঘটছে ধর্ষণের মতো জঘন্যতম অপরাধ। থামছেই না এ বর্বরতা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এ রকম কয়েকটি ঘটনায় চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। হতভম্ব হচ্ছেন বিবেকবান মানুষ। চলন্ত গাড়ি, কর্মস্থল, বাসাবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থানে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে এসব ঘটনা। ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন শিশু থেকে পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, আগের মাসগুলোর তুলনায় চলতি মাসে ধর্ষণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এ ব্যাপারে জরুরি ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
সামাজিক মূল্যবোধের অভাব, নৈতিক অবক্ষয়, পারিবারিক অনুশাসনের অনুপস্থিতিসহ নানা কারণে ধর্ষণ বাড়ছে বলে সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করেন। বিশেষ করে এ ধরনের ঘটনায় অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় দিনদিন বেড়েই চলেছে। আমি মনে করি, তাদের এই যুক্তির পক্ষে অবশ্যই সত্যতা রয়েছে। কারণ শিশু থেকে বৃদ্ধারা যখন এ নরপশুদের হাত থেকে রেহায় পায় না, তখন আমাদের আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, সমাজ এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, পত্রিকা বা অনলাইন দেখব আর ধর্ষণের খবর পড়ব না তা কি হয়? গত দুই সপ্তাহে এনটিভি অনলাইনের সংবাদ ছিল এমন ‘বিয়েতে রাজি না হওয়ায় কিশোরীকে ধর্ষণ’, ‘রাজধানীতে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণ, চিত্র ধারণ’, ‘প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় কিশোরীকে ধর্ষণ’, ‘স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা, লাখ টাকায় রফা’, ‘নেত্রকোনায় স্কুলছাত্রী ধর্ষণের শিকার’, ‘গাংনীতে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ, কলেজছাত্র আটক’, ‘ধর্ষণের পর কিশোরীর লাশ নদীতে!’, ‘গণধর্ষণের অভিযোগে ছাত্রলীগ-ছাত্রদল নেতাকে গণপিটুনি’, ‘বগুড়ায় মাদ্রাসাছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ’, ‘ঢাবিতে ধর্ষণের অভিযোগে ছাত্রলীগকর্মী গ্রেপ্তার’, ‘ত্রিপুরায় কিশোরীকে ধর্ষণের চেষ্টা, গাছে বেঁধে নির্যাতন’ ও ‘লক্ষ্মীপুরে দুই শিশু ধর্ষণের শিকার’ প্রভৃতি শিরোনাম বোধহয় লিখে শেষ করা যাবে না। এসব শিরোনাম যেন প্রতিটি গণমাধ্যমের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সর্বশেষ (৩০ সেপ্টেম্বর) বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) থেকে প্রকাশিত এক তথ্যে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৫৯১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন ৭৬ জন। আর ঢাকা মহানগর পুলিশের হিসাব অনুযায়ী গত আগস্ট মাসেই ১৫৯ জন নারী-শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছে অন্তত ৪৫ জন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের হিসাবে গত জুলাই মাসে ৮৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হন ১৫ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় নয়জনকে। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় ১৯ জনের ওপর। এ ছাড়া শ্লীলতাহানির শিকার হন ১০ জন। আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসাবে গত ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন, ২০১৫) ধর্ষিত নারীর সংখ্যা ৩২৬। ধর্ষণের পর খুন হয়েছে ২৯ জন। মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর হিসাবে গত ১৫ বছরে (২০০১-২০১৫) দেশে ১০ হাজার ৮৩২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মহিলা পাঁচ হাজার ৭০৫ জন, শিশু পাঁচ হাজার ২০, গণধর্ষণ এক হাজার ৭৩৬টি, ধর্ষণের পর হত্যা এক হাজার ৩১২টি, ধর্ষণের পর আত্মহত্যা ১৩৭টি। এসব প্রতিবেদনের তথ্য দেখে আমরা হতবাক হই। এ ধরনের পরিসংখ্যানই বলে দেয়, বর্তমান সময়ে ‘ধর্ষণ’ নামক বিভীষিকা আমাদের জীবনে কতটা চেপে বসেছে। কোনো কিছু থেকেই এ জঘন্য অপরাধের মুক্তি মিলছে না।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, আমরা কি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মতো ধর্ষণে এগিয়ে চলছি? যে দেশকে নিয়ে পশ্চিমা সমাজ রেন্ডিয়া (রেপ+ইন্ডিয়া) বলে অবহিত করে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি) তথ্য অনুযায়ী, ভারতে প্রতিদিন ৯২ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়। ২০১৩ সালেই এ সংখ্যা ছিল ৩৩ হাজার ৭০৭। ভারতে এ ধরনের ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও বিশ্বে ধর্ষণের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় দেশ কিন্তু ভারত নয়। ওই স্থানটি দখল করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। তারপর পর্যায়ক্রমে দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইডেন, ভারত, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা, শ্রীলঙ্কা ও ইথিওপিয়া। আমাদের সৌভাগ্য যে, ধর্ষণে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নেই। তবে অবস্থান যাই হোক না কেন, যা চলছে, যেভাবে চলছে এটা আমাদের জন্য সুখকর নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিদিন যেভাবে ধর্ষণের চিত্র ফুটে উঠছে, তাতে শীর্ষ দশে উঠতে হয়তো আর বেশি সময় লাগবে না। দিনদিন ধর্ষিতার তালিকা দীর্ঘই হতে থাকছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, সরকার, প্রশাসন, আইন ও বিচারব্যবস্থার কোনো উদ্যোগই ধর্ষণ থামাতে পারছে না। তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, ধর্ষণের অপ্রতিরোধ্য মিছিল থামাবার শক্তি কি কারোরই নেই?
মেয়েদের পৈশাচিক নির্যাতন করে ধর্ষণ, সামান্য অন্যায়ের জন্য মারধর করা, এমনকি তাদের মেরে ফেলা-এসব বন্ধ হতে হবে যে কোনো মূল্যে। এ ছাড়া অবলীলায় নিরীহ শিশুদের ওপর পৈশাচিক আক্রমণও বন্ধ হতে হবে। এসব অপকর্ম তো আমাদের আশপাশের মানুষই করে। আমরাই করি। প্রশ্ন উঠতে পারে, আমরা মানুষ নাকি মানুষরূপী শয়তান? আমি মনে করি, মানুষের বিবেক যখন মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে, তখন তারা এমন ঘটনা ঘটাতে থাকে। যার ফলে ধর্ষিতার স্বপ্নভঙ্গ হয়। থামে না ধর্ষিতার বুকভাঙা হাহাকার। আমৃত্যু অপ্রতিরোধ্য এ গ্লানি সারা জীবন তাকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়। এসব ঘটনা নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হয়, সেমিনার-র্যালি হয়, আন্দোলন হয়। কিন্তু তারপর সবাই আগের মতো চুপচাপ। থেমে যায় বিবেকের চিৎকার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষেত্রেও একই অভিযোগ। প্রথমে দৌড়ঝাঁপ শুরু হলেও পরে গিয়ে তারা নির্লিপ্ত হয়ে পড়ে। আবার অনেক ক্ষেত্রে পুলিশও জড়িত থাকে। এ জন্য ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ প্রয়োজন। নারী সংগঠনগুলোর এ বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টিসহ প্রতিবাদ করা উচিত।
এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের পর্যাপ্ত ভূমিকা রয়েছে। যাতে ধর্ষণের মতো গর্হিত অপরাধ প্রতিরোধে সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসে। সর্বোপরি কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটলেই ধর্ষকদের ধরিয়ে দিতে হবে। কে পুলিশ, কে নেতা সেদিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। সবাই একযোগে কাজ করতে হবে।
এ ছাড়া ধর্ষণ প্রতিরোধে নারীদেরও দায়দায়িত্ব রয়েছে। অপরিচিত বা কয়েকদিনের পরিচিত এক বা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কোথাও যাওয়া ঠিক নয়। নারীদের দেখতে হবে সে কার সঙ্গে যাচ্ছে, তার সঙ্গে কত দিনের পরিচয়, ওই ব্যক্তি সম্পর্কে সে কতটুকু জানে, কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে ইত্যাদি বিষয়। হঠাৎ রাস্তায়, ফোনে বা ফেসবুকে পরিচয় এমন কোনো ব্যক্তির সঙ্গে কোথাও যাওয়া উচিত নয়।
বিদ্যমান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারায় নারী ও শিশুকে ধর্ষণের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু সেই আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেক সময় দীর্ঘসূত্রতার কারণে ভুক্তভোগীরা বিচারের আশা ছেড়ে দেয়। অথবা রাজনৈতিক ভয়ভীতি প্রদর্শন ও অর্থের বিনিময়ে সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়া হয়। যার ফলে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে।
আমি মনে করি, দেশে ধর্ষণবিরোধী বিদ্যমান যে আইন রয়েছে তা সংস্কার, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, পুলিশের আলাদা তদন্ত ইউনিট গঠন, অভিযুক্তদের জামিন প্রদানে কঠোরতা, ধর্ষকদের শাস্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দ্রুত বিচার নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং দোষীদের বিরুদ্ধে দেওয়া রায় গণমাধ্যমে ব্যাপক হারে প্রচার করা উচিত। যাতে করে সমাজে বসবাসকারী দুষ্ট প্রকৃতির লোক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে নিরুৎসাহিত হয়। একই সঙ্গে ধর্ষণ প্রতিরোধে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গীকার থাকতে হবে। সম্মিলিত প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। শুধু নারী নয় এসব ক্ষেত্রে পুরুষদেরও অংশ নিতে হবে। কেননা আমাদের নতুন প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য এখনই ভাবতে হবে। আদর্শের বাংলাদেশ গড়তে হলে ধর্ষণ নামক এই ব্যাধি এখনই থামাতে হবে।
লেখক : সভাপতি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি।