সিরিয়া সংকট
সিরিয়ায় রুশ হামলা : কার লাভ, কার ক্ষতি?
গত ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে বিশ্বমিডিয়ার মনোযোগ অব্যাহতভাবে দখল করে আছে ‘সিরিয়া কেননা এদিন থেকে সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট তথা আইএস নিধনে’ রাশিয়ার বিমান হামলা শুরু হয়। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্থান আক্রমণের পর এই প্রথম রাশিয়া সাবেক সৌভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে কোনো রাষ্ট্রে গিয়ে যুদ্ধে জড়াল। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার যুদ্ধংদেহী উপস্থিতি মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে মার্কিন এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের নানা ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত হিসাব-নিকাশ ওলট-পালট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি করেছে। তা ছাড়া, ইউক্রেন আক্রমণের পরিণতি হিসেবে মার্কিন-ব্রিটিশ-ফ্রান্স-জার্মান নেতৃত্বাধীন জোট যখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার চিন্তা-ভাবনা করছে, তখন রাশিয়ার সিরিয়ায় এই আইএস-বিরোধী বিমান হামলা বিশ্বরাজনীতির অনেক ব্যাকরণ পাল্টে দেওয়ার পাশাপাশি মার্কিনের বাড়া ভাতে রীতিমতো ছাই দিয়েছে।
সিরিয়ার নির্বাচিত এবং বৈধ সরকারের প্রধান বাশার আল-আসাদকে সরানোর পশ্চিমা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট (ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, তুরস্ক, সৌদি আরব ও কাতার) ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে সিরিয়ার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে থাকা আইএসকে ধ্বংস করার জন্য লাগাতার আক্রমণ চালালেও কারো কারো মতে আড়াই হাজারবার আক্রমণ চালানো হয়, বিশেষ কোনো উল্লেখযোগ্য এবং দৃশ্যমান ফল পাওয়া যায়নি। অধিকন্তু আইএসের ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা এবং ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার নামে সিরিয়া এবং ইরাকের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে এক ধরনের ভয়ানক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড জারি রাখা এবং তার বিস্তার ঘটনোর দৃশ্যমান অবস্থা ও ব্যবস্থা মার্কিন-নেতৃত্বাধীন জোটের মিশন-ব্যর্থতাকেই প্রতিভাত করে। পাশাপাশি, মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের সদিচ্ছাকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। তাই ইরাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইব্রাহিম জাফারি অভিযোগ করেছেন ‘আমেরিকা ও তার মিত্ররা আইসিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মোটেও আন্তরিক নয়।’ এ রকম একটি অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার উপস্থিতি এন্তার পরিস্থিতিকে একটি ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। জন্ম দিয়েছে বহুমাত্রিক উত্তেজনার। কেউ কেউ বলছেন, স্নায়ুযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হলো; আবার কেউ কেউ বা বলছেন মনে হয় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যুদ্ধ চলছে মাঠে; যুদ্ধ চলছে মিডিয়ায়; যুদ্ধ চলছে আধিপত্য বিস্তারে, যুদ্ধ চলছে নানা ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার প্রবেশে কার ক্ষতি কার লাভ? রাশিয়ার উপস্থিতি কেন কারো কারো জন্য স্বস্তি; আবার কারো জন্য গোস্বার কারণ হয়ে উঠেছে? এ যুদ্ধের শেষ পরিণতি কী? এ নিবন্ধে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।
আজকের সিরিয়ার যে অবস্থা এটা মোটাদাগে তথাকথিত আরব-বসন্তের নগদ প্রতিফল। ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় আসাদের নিয়মিত সৈন্য বাহিনীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ নাম ধারণ করে আসাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে যাদের মার্কিন নেতৃত্বে তুরস্ক ও সৌদি আরবের সহায়তায় অস্ত্র, প্রশিক্ষণ এবং অর্থ দিয়ে আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। তখন থেকেই মূলত মার্কিন পলিসির প্রায় সবকিছুই আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সাজানো হয়েছে যার অনিবার্য প্রতিফল আজকের আইএস। তাই, আইএসের উত্থানের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে জনগণের জীবনমান ও নিরাপত্তার ভয়াবহ অবনতি ঘটলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো এ থেকে কেবল লাভবানই হয়েছে এবং হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৪ সালের শুরুতে যখন থেকে ইরাক-সিরিয়ায় আইএসের উত্থান, ঠিক তখন থেকেই বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমতে শুরু করে। কিন্তু হওয়ার কথা বিপরীত অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যে সংকট বৃদ্ধির কারণে বিশ্ববাজারে তেলের দাম তো বাড়ার কথা! প্রশ্ন হচ্ছে কমল কেন? কারণ হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে অব্যাহত সংকটের কারণে সেখানকার রাষ্ট্রগুলোর উৎপাদন, বিপণন ও বাণিজ্যিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে অধিকাংশ দেশই তেল উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছে এবং বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে তেল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।
তা ছাড়া বিভিন্ন পক্ষের অধিকৃত এলাকা থেকে নির্বিঘ্নে তেল পাচারের অভিযোগও আছে। এসবই তেলের দাম কমাতে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু তেলের এই অব্যাহত দরপতনই রাশিয়ার জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, কেননা রাশিয়া পৃথিবীর তৃতীয় বৃহৎ তেল উৎপাদনকারী রাষ্ট্র। ফলে, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ার রাশিয়ার বৈদেশিক বাণিজ্য বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এরং এ যাত্রা অব্যাহত থাকলে রাশিয়া ছাড়া পশ্চিমা বিশ্ব ক্রমান্বয়ে লাভবান হবে কিন্তু রাশিয়া এক অভাবনীয় অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়বে। তাই, অন্যের বেয়াড়া লাভের বিপরীতে নিজের অর্থনৈতিক ক্ষতি চেয়ে চেয়ে দেখার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। সুতরাং, মার্কিন-স্বার্থ সিদ্ধির সাজানো বাগানে রাশিয়া বুলডোজার চালাবে সেটাই স্বাভাবিক।
রাশিয়ার আরো একটি বড় স্বার্থ হচ্ছে অস্ত্র ব্যবসা। মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক অস্থিতিশীলতার কারণে বিশ্বের সব রাষ্ট্র নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বাড়িয়েছে। ফলে, অস্ত্র বিক্রি করে এর মাধ্যমেও মুনাফা করছে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো। এ কথা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত এবং সবার জ্ঞাত যে, মার্কিন অর্থনীতির একটি অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে সে দেশের ওয়ার ইন্ডাস্ট্রি। সুতরাং পৃথিবীর দেশে দেশে যুদ্ধ বাধিয়ে রাখার মধ্যেই মার্কিন অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষিত এবং প্রবৃদ্ধি নিহিত। কেননা, একটা বুলেট খরচ হওয়া মানেই একটা বুলেটের চাহিদা তৈরি হওয়া। সে কারণেই অনেকে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে ‘যুদ্ধবাজ পররাষ্ট্র’ নীতি বলে। তাই, আরব বসন্তের সূত্র ধরে লিবিয়ার গাদ্দাফিকে হত্যা, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে রাখা, আইএসের উত্থান প্রভৃতি গোটা মধ্যপ্রাচ্যে একটা চরম নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ তৈরি করেছে। ফলে, সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা বৃদ্ধি প্রযুক্তি ক্রয় ও গবেষণা খাতেও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেছে। এখানেও লাভবান হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। গাছেরটাও পকেটে, গোড়ারটাও প্যাকেটে! আরব বসন্তের নামে এবং ‘স্বৈরাচারী সরকার’ উৎখাতের নামে মধ্যপ্রাচ্যে যে যুদ্ধ ও ধ্বংস সংঘটিত হয়েছিল, সেখান থেকেও লাভবান হয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো, কেননা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের নামে পশ্চিমা কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রিগুলো দারুণ ব্যবসা করেছে মধ্যপ্রাচ্যে। এ সাম্রাজ্যবাদী ভাগবাটোয়ায় যারা কিছুই পায়নি, তারাও পেয়েছে কম দামের তেল। ফলে, সিরিয়ায় সংকট জিইয়ে রাখা আর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক মুনাফা-প্রবাহ নিশ্চিতকরণ সমার্থক। আর এ-ভাগবাটোয়ারার মার্কিন-চালে রাশিয়া ক্ষতিগ্রস্ত বলেই, নিজের ক্ষমতা দেখানো ছাড়া রাশিয়ার আর কোনো উপায় ছিল না।
স্বার্থের সম্পর্ক এবং লুটপাটের ভাগবাটোয়ারা-ভিত্তিক খাতির যে বেশিদিন স্থায়ী হয় না, সিরিয়াকে কেন্দ্র করে রুশ-মার্কিন দ্বৈরথ মূলত তারই নগদ নজির হাজির করে। মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার নিবিড় মিত্র ইরান কিছুদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতার চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। কার্যত সিরীয় রাষ্ট্র, সরকার ও সেনাবাহিনী, সবই বিপর্যস্ত। ফলে সবেধন নীলমণি আসাদও পতনের অপেক্ষায়। কেননা সিরিয়ায় নানা মাত্রায় গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব, আইএসের নৃশংসতা, মার্কিন নেতৃতাধীন জোটের হামলার নামে নিত্য আক্রমণ পরিস্থিতি, আসাদবিরোধীদের ক্রমবর্ধমান শক্তি সঞ্চয়, আসাদকে বিদায় করতে ক্রমবর্ধমান পশ্চিমা চাপ প্রভৃতি সামাল দিতে আসাদ যখন অনেকটা পতনোন্মুখ, এ অবস্থায় কৃষ্ণসাগরের দখল টিকিয়ে রাখা এবং তা আরো বিস্তৃত করার পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিতে চাইলে মধ্যপ্রাচ্য সংকটে রাশিয়ার হাত গুটিয়ে বসে থাকা চলে না। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, রাশিয়ার তৈরি অস্ত্রের একজন বড় খরিদ্দার হচ্ছেন আসাদ। আসাদের যদি পতন হয় এবং মার্কিন তাঁবেদার কোনো সরকার যদি সিরিয়ার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসে, তবে রাশিয়া তার সবচেয়ে বড় অস্ত্র-খরিদ্দারকে হারাবে যা রাশিয়ার অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তাই, সিরিয়ার স্থিতিশীলতা, আসাদের ক্ষমতায় টিকে থাকা, মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটকে ব্যর্থ করে দিয়ে মার্কিন আধিপত্য খর্ব করা এবং জঙ্গি দমনের করিতকর্মতায় মার্কিন জোটকে টেক্কা দেওয়া প্রভৃতি অনেকগুলো কারণে সিরিয়ায় রাশিয়ার যুদ্ধংদেহী প্রবেশ খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এবং সেটা হওয়ারই কথা ছিল দুদিন আগে বা পরে। কেননা, বৈশ্বিক রাজনৈতিক অর্থনীতিতে রাশিয়া হচ্ছে ‘হাতি’; তাই, মরলেও লাখ টাকা। চোখের সামনে মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান মার্কিন আধিপত্য যখন রাশিয়ার তেল-বাণিজ্য এবং অস্ত্র-বাজারকে ধ্বংস করায় লিপ্ত, তখন রাশিয়া সেখানে নাগ গলাবে-এটাই স্বাভাবিক।
দীর্ঘদিন অর্থনৈতিক সংকটের ভেতর দিয়ে গেলেও রাশিয়া এখন পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম অর্থনীতি। পুতিনের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে দেশটি ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হয়েছে। এই অগ্রসরতার অর্থই হচ্ছে বিরাট উৎপাদন, যা বিক্রির জন্য অবশ্যই তাকে নতুন বাজার খুঁজতে হবে। রাশিয়া এটাও জানে যে, বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং নিও-লিবারেল ইকোনমির নামে বর্তমান বিশ্ববাজার ব্যবস্থার প্রায় পুরোটাতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আধিপত্য বিস্তার করে আছে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে তেল থেকে আয় কমে যাওয়া যেমন রাশিয়ার কাম্য নয়, অস্ত্রের খরিদ্দার কমে যাওয়া যেমন অনাকাঙ্ক্ষিত, তেমনি পণ্য বিক্রির জন্যও তাকে নতুন বাজার জয় করতে হবে এবং বিশ্ববাজারকে মার্কিন দখলদারিত্বকে মুক্ত করতে হবে। তাই পরিস্থিতি নিজের পক্ষে আনতে গেলে পুতিনকে রক্তপাত ও ধ্বংসযজ্ঞে নামতেই হতো। তা ছাড়া, নিজের ঘরে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে যুক্তরাষ্ট্র যেমন রাশিয়ার জন্য বাজার ছেড়ে দেবে না, তেমনি বাজার সৃষ্টি না করে উৎপাদন করলে তার অর্থনৈতিক মূল্যও শূন্য। তাই, আসাদের ঘোর সমর্থক এবং সবচেয়ে বিশ্বস্ত মিত্র হওয়া সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার উপস্থিতি এবং যুদ্ধে জড়ানো যতটা না সিরিয়ার প্রতি আন্তরিকতা এবং দায়িত্ববোধ থেকে, ততোধিক মার্কিন আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করা এবং রাশিয়ার নিজের অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা।
রাশিয়ার আধিপত্য বিস্তারের এ ব্যাকরণ যুক্তরাষ্ট্র যে বিনা চিন্তায় হজম করছে সেটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। আগে থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে একটা সুবিধাজনক অবস্থান নেওয়া যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের রাশিয়ার বিরুদ্ধে একজোট করছে। সৌদি, ইয়েমেন, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন ও তুরস্কের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে রাশিয়াবিরোধী একটা শক্ত অবস্থান গ্রহণ করছে। এভাবেই ক্রমশ রুশ-মার্কিন দ্বৈরথ আরো চাঙ্গা হচ্ছে। তবে শঙ্কার কথা হচ্ছে, রুশ ও মার্কিন সামরিক ঘাঁটি এখন মুখোমুখি। রুশ যুদ্ধবিমানগুলো যেসব এলাকা দিয়ে যাতায়াত করছে সেগুলো মার্কিন সামরিক ঘাঁটির ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায়। একইভাবে রুশ যুদ্ধবিমানের নাগালের মধ্যে মার্কিন ও তার মিত্ররা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার খবর অনুযায়ী, মার্কিন উপকূলে রাশিয়ান জাহাজ দেখা গেছে; আবার রাশিয়ান জলসীমাতেও মার্কিন গোয়েন্দা রণতরী বহাল রয়েছে। ফলে এটা বলা যায় যে এ রকম মুখোমুখি যুদ্ধংদেহী অবস্থায়ও রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র একে অন্যের নাগালের মধ্যে বসবাস করছে।
রুশ-মার্কিন এত সব তৎপরতার ফলে একটি সম্ভাব্য যুদ্ধের আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। দ্বন্দ্ব যেভাবে ঘনীভূত হচ্ছে, তাতে যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি বলতে গেলে এখনই বিরাজ করছে। অবশ্য যুদ্ধ আদৌ হবে কি না, হলেও কীভাবে বা কতটা হবে, তার অনেক কিছুই নির্ভর করছে বিশ্বক্ষমতার অন্য কেন্দ্রগুলোর ওপর; বিশেষ করে চীন, ভারত ও ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর ওপর। এখানে মনে রাখা জরুরি যে, সিরিয়া ইস্যুতে নানা অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে বিশ্বের বড় দেশগুলো দুটি ভাগে বিভক্ত। আরব দেশগুলো ছাড়াও মার্কিনিদের নেতৃত্বে ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালি সিরিয়া সংকটের প্রথম থেকেই জড়িত ছিল।
এই দেশগুলোর সম্মিলিত সিদ্ধান্তেই কথিত ‘সিরিয়ান ন্যাশনাল কোয়ালিশন’ গঠন করা হয়, যার মাধ্যমে এ দেশগুলো আসাদের বিপক্ষে বিদ্রোহী গ্রুপকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে রাশিয়া ও চীন আসাদ সরকারের পক্ষে। তারা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আসাদের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়েছে। তবে বিশ্বমিডিয়া যেভাবেই সিরিয়া সংকটকে উপস্থাপন করুক না কেন, উপরিউক্ত আলোচনা থেকে সাফ প্রতীয়মান হয়ে যে, এটা যতটা না আইএস দমন, ততোধিক রুশ-মার্কিন দ্বৈরথ : বিশ্ব বাজারে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, তেলসম্পদের লুট ও তেল-বাণিজ্য জোরদার, অস্ত্র ব্যবসার প্রসার ও বাজার নিশ্চিতকরণ এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে নিজের মোড়লত্ব বহাল রাখার দ্বৈরথ। মুশকিল হচ্ছে, রাজায় রাজায় ঝগড়া করে, প্রজা মরে বেবিচারে! সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এ দ্বৈরথ সিরিয়ানদের জীবনকে রীতিমতো নরকে পরিণত করেছে। দুই কোটি ২২ লাখ সিরিয়ানের মধ্যে এখন এক কোটি ২০ লাখই উদ্বাস্তে পরিণত হয়েছে। চল্লিশ লাখ সিরিয়ান আশপাশের দেশে শরণার্থী হয়ে অমানবিক ও মানবেতর জীবন-যাপন করছে। যাদের গণতন্ত্র দিতে এত কিছু, তাদের নিজের অস্তিত্বই আজ বিপন্নপ্রায়। তাই, পশ্চিমাদের (আলগা) দরদে দেওয়া গণতন্ত্র যে কতটা কস্টলি, সিরিয়ার সংকট মূলত আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়।
ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।