সমসাময়িক
ধর্মীয় সম্প্রীতি বনাম ৫৭ ধারার সাতপাঁচ
৫৭ সংখ্যাটিকে উল্টে দিলে হয় সাতপাঁচ, যার অর্থ বিবিধ ভাবনা। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বহুল আলোচিত ও সমালোচিত ৫৭ ধারা নিয়ে লেখার আগেও সাতপাঁচ ভেবে দেখলাম, এই ধারা নিয়ে লেখা পড়ে যদি কারো মনে হয় যে তাঁর সম্মানহানি হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ব্যাহত হয়েছে, তাহলে এ ধারায় কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি এই লেখকের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন এবং এই ইস্যুতে সদা তৎপর ‘জনগণের বন্ধু’ পুলিশ দরজায় কড়া নেড়ে বলবেন, ‘আমীন আল রশীদ বাসায় আছেন?’
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে এরই মধ্যে অনেক লেখালেখি হয়েছে। ফেসবুক ও ব্লগে তো বটেই, মূলধারার গণমাধ্যমেও অনেকে লিখেছেন। অপেক্ষাকৃত নবীনরা লিখেছেন। আবার বিদগ্ধজনরাও লিখেছেন। তাতে নীতিনির্ধারকদের মন গলেনি; বরং তাঁরা ভাবছেন, ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের জন্য আরো কঠিন কী আইন করা যায়, তা নিয়ে। ফলে এই ৫৭ ধারা বাতিলের দাবি জানিয়ে আপাতত কোনো লাভ নেই। কেননা, আইনটি পাস হয় ২০০৬ সালে। ২০১৩ সালে এর কয়েকটি ধারা সংশোধিত হয়। অথচ এখনো এর কোনো বিধিমালা তৈরি হয়নি। আর বিধিমালা না থাকলে আইনকে নিজের ইচ্ছামতো ব্যবহারের সুযোগ থাকেই।
৫৭ ধারাটি বিশেষভাবে বিতর্কিত এ কারণে যে এ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া হয়, তাহলে তার এই কার্য হবে একটি অপরাধ। আর কোনো ব্যক্তি এই অপরাধ করলে তিনি অনধিক ১৪ বছর এবং অন্যূন সাত বছর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
কিন্তু ‘মিথ্যা’ বা ‘অশ্লীলের’ সংজ্ঞা কী, ব্যক্তির ভাবমূর্তি আসলে কী জিনিস, একজন খারাপ লোক সম্পর্কে যদি এমন কিছু লেখা হয় যা সত্য, তাহলেও সেটি কি ভাবমূর্তি ক্ষতির মধ্যে পড়বে, তা স্পষ্ট নয়। অর্থাৎ এ আইনে অপরাধের যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা অস্পষ্ট। তা ছাড়া কোনো লেখার কারণে আদৌ কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগল কি না অথবা কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার আদৌ কোনো উদ্দেশ্য লেখকের ছিল কি না, তাও যাচাই করার সুযোগ রাখা হয়নি এ আইনে। কিন্তু বিধিমালা থাকলে এ নিয়ে এ রকম ধোঁয়াশার সৃষ্টি হতো না। কিন্তু যেহেতু বিধিমালা নেই, তাই এখন যে কেউ যেকোনো লেখার বিরুদ্ধেই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগ আনতে পারেন।
২.
এখন প্রশ্ন হলো, ধর্মীয় সম্প্রীতির সঙ্গে এই ৫৭ ধারার কী সম্পর্ক? দুটি ঘটনার দিকে নজর দেওয়া যাক।
সৌদি আরবের মিনায় পদদলিত হয়ে প্রাণহানির ঘটনা নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় গত ২৬ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বেসরকারি সংস্থা 'লিডার্স'-এর নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মণ্ডল। তাঁর বিরুদ্ধে শ্যামনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আকবর কবীর বাদী হয়ে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করেন। ফেসবুক স্ট্যাটাসে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া হয়েছে বলে বাদী অভিযোগ করেন। মোহন কুমার মণ্ডল ফেসবুক স্ট্যাটাসে মিনায় শয়তানের উদ্দেশে পাথর ছোড়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। যদিও তিনি পরে এই স্ট্যাটাস প্রত্যাহার করেন। এর পর তিনি জামিনও চেয়েছেন। কিন্তু জামিন পাননি। এখনো জেলে আছেন।
এর দুদিন পর ২৮ সেপ্টেম্বর মাগুরায় দীপু বিশ্বাস নামের এক স্কুলছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয় ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে 'কুরুচিপূর্ণ ও অশালীন' মন্তব্য করার অভিযোগে। সে থৈয়পাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র। পুলিশের দাবি, দীপু তার ফেসবুক ওয়ালে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ ও অশালীন মন্তব্য করে। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে সন্ধ্যার পর মিছিল নিয়ে তার বাড়িতে হামলা করতে যায় কিছু বিক্ষুব্ধ মানুষ। এ সময় পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে দিপুকে গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করা হয়। এরপর দিপু আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। তবে সে কিশোর বলে তাকে জেলহাজতে না পাঠিয়ে আদালত তাকে যশোর কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠান। মামলা চলাকালীন বা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সে সেখানেই থাকবে।
৩.
ইসলাম সম্পর্কে কোনো কিছু লেখার কারণে যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত দেশের সরকার কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করে, তখন সেটি দেশের বাইরে দুই ধরনের বার্তা দেয়; যেমন বাংলাদেশের সরকার বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী নয় এবং এখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা স্বাধীন নয়। এ ছাড়া কমিউনিটি হারমোনি, অর্থাৎ কমিউনিটির মানুষের মধ্যে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যে সামাজিক বন্ধন, সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেননা, যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মনে করে যে তাদের ধর্ম বা তাদের ধর্মের কোনো রীতিনীতিকে কেউ কটাক্ষ করেছে, তখন স্বভাবতই তারা ক্ষুব্ধ হয় এবং অতি উৎসাহী কেউ কেউ এই কর্মকাণ্ডকে ‘অপরাধ’ গণ্য করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিয়ে অভিযুক্তকে আইনের মুখোমুখি দাঁড় করায়।
সমাজের একটা বড় অংশের মানুষের কাছেই যেহেতু এখন স্মার্টফোন আছে এবং ফেসবুক ব্যবহার করে, ফলে ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে কেউ একটা কিছু লিখলে সেটি নিয়ে অতি উৎসাহীরা যেমন ঝাঁপিয়ে পড়েন, তেমনি কেউ কেউ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারেও নামেন।
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় জমায়েত হজ নিয়ে মন্তব্য করায় যেমন একজন হিন্দু নাগরিককে গ্রেপ্তার সমাজের ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার পথে অন্তরায়, তেমনি আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজা সামনে রেখে কোনো মুসলমান নাগরিক যদি এমন কিছু লেখেন, যা হিন্দু ধর্মের মানুষের অনুভূতিতে আঘাত লাগে, সে ক্ষেত্রে তাঁরাও ৫৭ ধারায় মামলা করতে পারেন। তখন দেখা যাবে, গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে, দুর্গাপূজা নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করায় অমুক আটক।
অর্থাৎ ইসলাম সম্পর্কে যখন কোনো হিন্দু নাগরিক কটুকথা লেখেন বা হিন্দুধর্মের সমালোচনা করে যখন কোনো মুসলাম নাগরিক কিছু লেখেন, তখন এটি আখেরে এ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। বিশেষ করে যারা যুক্তিতর্কের চেয়ে আবেগ আর ধর্মীয় অনুভূতির ওপর বেশি নির্ভরশীল। ফলে তারা যখন দেখছে যে তাদের হাতে ৫৭ ধারা নামে একটা জাদুকরি অস্ত্র আছে, ফলে তারা এটিকে ব্যবহারের সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক ও উপস্থাপক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।