ভবন ব্যবহারের চূড়ান্ত অনুমোদন কে দেবে?
বনানী আর চকবাজারের মধ্যে অনেক পার্থক্য। একটা পুরান ঢাকা আরেকটা আধুনিক ঢাকা। কিন্তু এক জায়গায় এসে দুঃখজনক মিল পাওয়া গেল। আগুন দুই বিপরীত চিত্রের জায়গাকে এক বিন্দুতে এনে দিয়েছে। চকবাজার থেকে বনানী; আগুনের লেলিহান শিখা আর কোন কোন স্থানে এবং ভবনে পৌঁছে আমাদের আত্মীয়-স্বজনকে কেড়ে নিবে কেউ জানে না। তরুণ সাংবাদিক রাশেদ নিজাম ফেসবুকে অনেক কষ্ট নিয়ে লিখেছেন, এটা রাজধানী নয়, ‘লাশধানী’। কিছু লোভী মানুষ এই ঢাকা শহরকে মৃত্যুপুরী বানিয়ে ফেলেছে। রাস্তায় মৃত্যু, ‘অত্যাধুনিক’ ভবনে মৃত্যু। ঢাকা যেন মৃত্যুর ফাঁদ। একের পর এক মানব-সৃষ্ট দুর্যোগের কারণে মানুষের মনে এখন এমনই অনুভূতি।
অগ্নিকাণ্ড বিশ্বের সব দেশেই হয়। লন্ডন, নিউইয়র্কের মতো শহরেও হয়। সেখানেও মানুষ মারা যায়। কিন্তু সেসব দেশে বিল্ডিং কোড মেনে চলার প্রবণতা অনেক বেশি। অন্যদিকে আমাদের দেশে কী হয়? ঢাকার অধিকাংশ ভবন প্রজেক্ট-প্ল্যান অনুযায়ী নির্মিত হয়নি। ১০তলার অনুমতি নিয়ে বানানো হচ্ছে ১৫তলা। ১৯তলার অনুমতি নিয়ে বানানো হচ্ছে ২৩তলা। শুধু ভবন মালিককে দায়ী করলে বক্তব্য পূর্ণ হয় না। রাজউককে ঘুষ দিয়েই ভবন মালিকরা এমন জোচ্চুরি করেন। ঢাকা শহরে নিয়ম মেনে কয়টি ভবন আজ পর্যন্ত হয়েছে এবং হবে। ঢাকায় যত আরাজকতা হয় তার বড় কারণ রাজউক নিজে। অথচ রাজউক মানে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। স্বাধীনতার পর থেকে রাজউক কী নিষ্ঠুরভাবেই না রাজধানীর উন্নয়ন করে চলেছে।
অধিকাংশ ভবন নিয়ম বহির্ভূতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। বনানীর যে ভবনটি আকস্মিক মৃত্যুপুরী হয়ে গেল সেটি কত কাঠার উপর নির্মিত? পাশের আরেকটি বহুতল ভবনের সাথে এর বলতে গেলে কোনো গ্যাপই ছিল না। একটি সূত্রে জানা যাচ্ছে, মাত্র ৫ কাঠার উপর নির্মিত হয়েছে ২২ তলা ভবন। রাজউক অনুমোদন দিয়েছিল ১৯ তলা ভবনের। ৫ কাঠা জায়গায় একটি আদর্শ ভবন বানাতে হলে সেটি কত উঁচু হতে পারে? এটা বুঝতে ইঞ্জিনিয়ার হওয়া লাগে না। উঁচু এই ভবনের ভেতরটা বলতে গেলে বস্তি বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। মালিক পক্ষের লোভ, রাজউকের ঘুষ-প্রীতি সব মিলেই ঢাকা শহরের ভবনগুলো আজ আগুনের কারখানা হয়ে গেছে। একটি ভবনের ভেতরের দরজা জানালা কেমন হওয়া উচিত? কী রকম দরজা-জানালা ব্যবহার করলে আগুন কম লাগবে? ভেতরে কেমন স্পেস থাকা উচিত? এগুলোর নিশ্চয় স্ট্যান্ডার্ড জানেন বিশেষজ্ঞগণ।
আগুন লাগলে ধোঁয়ার কারণে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। ভবনগুলোতে কি ধোঁয়া নির্গমনের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা আছে? আমরা বনানীর ঘটনায় দেখলাম, কালো ধোঁয়া বের করে দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। পুরো ভবন দামি কাচ দিয়ে ঘেরা ছিল। আধুনিক স্থাপনায় কাচের ব্যবহার খুব হয়। বাহারি কাচ থাকলে আমাদের কাছে ভবনগুলো সুন্দর বলে মনে হয়। আমরা সাধারণ মানুষ। তবু আমাদের মনে নানা প্রশ্ন জাগে। ভবনে আগুন লেগে গেলে এই দামি, মোটা কাচগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যাওয়ার কি কোনো ব্যবস্থা ছিল বনানীর ভবনে? যদি থাকত, অনেক মানুষ বেঁচে যেত। ধোঁয়া বের হয়ে যাওয়ার কোনো রাস্তা ছিল না। তদুপরি ভবনের কক্ষগুলোতে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা-নির্ভর ডিজিটাল দরজা দিয়ে সাজানো ছিল। আগুন লাগার পর বিদ্যুৎ চলে যায়। বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় দরজাগুলো কোনোভাবেই খুলতে না পেরে মানুষ যার যার কক্ষে আটকে ছিলেন দীর্ঘক্ষণ। ফলে অক্সিজেনের অভাবে অনেকে মারা গেছেন।
আগুন লেগে যাওয়ার পর ভবনের ভেতরের অবস্থানকারীরা দুটো কাজ করতে পারতেন। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যেতে পারতেন অথবা ছাদে উঠে যেতে পারতেন। বিমান বাহিনীর অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার ভবনের উপরে বারবার চক্কর দিয়েছে, কিন্তু কাউকে উদ্ধার করতে পেরেছে বলে জানা যায়নি। কারণ, কেউ ছাদে উঠতে পারেনি। ছাদ কি তাহলে তালা মারা ছিল? দরকারের সময় ছাদ ব্যবহার করতে পারেননি হতভাগ্য মানুষগুলো। বিদ্যুৎ না থাকায় অনেকেই কক্ষে আটকে থাকেন এবং সিঁড়ি দিয়ে যে নিচে চলে যাবেন সে ব্যবস্থাও করা যায়নি। আগুন লাগার পর মানুষকে জানানো যায়নি যে আগুন লেগেছে। সাথে সাথে জানলে হয়তো হতাহতের পরিমাণ আরো কম হতো।
এত বড় ভবন; নিশ্চয় এর নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী ছিল। এই নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা কি কখনো আগুন লাগলে কীভাবে কাজ করবেন তার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন? ভবনে কি কোনো কেন্দ্রীয় এলার্ম সিস্টেম ছিল? আগুন লাগলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাইরেন বেজে উঠার প্রযুক্তি অনেক ভবনে ব্যবহৃত হতে আমরা দেখি। কিংবা স্মোক ডিটেক্টর? এগুলো ছিল না। ভবন মালিক শুধু ভবন উঁচু করেছেন। প্রতি ইঞ্চি জায়গা ভাড়া দিয়ে মালিক শুধু কামাতে চেয়েছেন। মালিকের ছেলে-মেয়েরা থাকে ইউরোপ-আমেরিকায়। সেখানে তারা খুব নিয়ম মানে আর বাংলাদেশকে গালি-গালাজ করে অনিয়মের জন্য। এমনকি দেশের টাকা পাচার করে মালিক বিদেশে যে বাড়িগুলো বানিয়েছেন, সেগুলো সব নিয়ম মেনেই করা হয়েছে। কারণ সেখানকার রাজউক দুর্নীতি করে না। বাংলাদেশের রাজউক দুর্নীতি করে । আর এসব দুর্নীতিবাজদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেয় এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ। দুর্নীতিবাজদের আশপাশে থেকে টাকা গুনে সাংবাদিক নামধারী কিছু প্রতারক। সব ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজদের একটা সিণ্ডিকেট সব লুটেপুটে খাচ্ছে।
একমাত্র ব্যতিক্রম ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্স। এখানে যারা চাকরি করেন, তারা কেমন বেতন-ভাতা পান জানি না। তবে দেশের সবচেয়ে পরিশ্রমী আর সৎ মানুষগুলো যে ফায়ার সার্ভিসে চাকরি করেন, এতে দেশের সাধারণ মানুষের কোনো সন্দেহ নেই। দেশের সব পেশার লোক কাজে ফাঁকি দেয়। শুধু দেয় না এই ফায়ার সার্ভিসের লোকজন। কর্তব্য পালনে বিন্দুমাত্র গাফিলতি নেই ফায়ার সার্ভিসের। লোভী, অসৎ মানুষগুলোর কারণে নানাবিধ দুর্যোগ সৃষ্টি হয়। আর সে দুর্যোগ থেকে মানুষকে বাঁচাতে আসে ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু কতকাল আর এভাবে চলবে এই ঢাকা?
রাজউক যেহেতু ভবনগুলোতে নিয়ম নিশ্চিত করছে না, সেহেতু ফায়ার সার্ভিসকে আরো শক্তিশালী করা হোক। ফায়ার সার্ভিস শুধু আগুন নেভানো আর ভবন ধ্বংস কিংবা অন্য কোনো বিপদগ্রস্ত মানুষকে উদ্ধারের কাজই করবে না। ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন ছাড়া রাজধানীর একটি ভবনও যেন মানুষ ব্যবহার করতে না পারে সে পদক্ষেপ এখনি নিতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, এমন নিয়ম এখনি আছে। ‘অকুপেন্সি’ সনদ নিতে হয় ফায়ার সার্ভিস থেকে। অর্থাৎ একটি ভবন নির্মিত হওয়ার পর সেটি বসবাসযোগ্য বা ব্যবহারযোগ্য হয়েছে কি না, এই সনদ দেওয়ার এখতিয়ার ফায়ার সার্ভিসের। কিন্তু রাজউক এ ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতা করে না। ভবনগুলো নির্মিত হয়ে যাওয়ার পর, এমনকি মানুষ ব্যবহার শুরু করার পরও ফায়ার সার্ভিসকে নিয়ম মাফিক আপডেট দেয় না রাজউক। কারণ ফায়ার সার্ভিসকে বেশি সম্পৃক্ত করলে কালো টাকার ধান্দা বন্ধ হয়ে যায়।
রাজউকের দুর্নীতিকে শিকড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলতে হবে। পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসকে শক্তিশালী করতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের জনবল বাড়াতে হবে। দেশ জুড়ে লাখ লাখ প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের দৃষ্টিতে সবচেয়ে সফল বিভাগ ফায়ার সার্ভিসকে বিশ্বের সমস্ত অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দিতে হবে। পাশাপাশি ভবনগুলোর ব্যবহার-সংক্রান্ত অনুমোদন ক্ষমতা ফায়ার সার্ভিসকে দেওয়া হোক।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়