অটিজম
একজন মায়ের সংগ্রামের কথা
এহসান আমার একমাত্র সন্তান। অনেক আদরের। ওর যেদিন জন্ম হয়, সেদিন ডাক্তার আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনার একটা খুব সুন্দর ছেলে হয়েছে, একেবারে রাজপুত্র।’ ডাক্তারের কথা শুনে খুশিতে আমার মন ভরে যায়, চোখ দুটো আনন্দে ছলছল করে ওঠে। তখন একবারের জন্যও মনে হয়নি এ আনন্দ ক্ষণিকের। যা হোক, এহসান ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। ছয় মাসে বসতে শেখা, নয় মাসে হামাগুড়ি ও আধো আধো বোলে দু-একটি শব্দ শিখল। নিয়মমাফিক ১৪ মাসে হাঁটাও শিখল।
আমি স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম। ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার নয়, সরকারি ফার্স্ট ক্লাস অফিসার হিসেবে গড়ে তুলব। ওর বয়স যখন এক বছর আট মাস, তখন ওর মাঝে পরিবর্তন লক্ষ করলাম, ডাকলে আর আগের মতো তাকায় না। একা একা নিজের মতো খেলা করে। শিশু বিশেষজ্ঞ দেখালাম, বলল কান পরীক্ষা করতে। না, কোনো সমস্যা নেই। ডাক্তার পাঠালেন শিশু বিকাশ কেন্দ্রে। সেখানে প্রেসক্রিপশনে লেখা ছিল অটিস্টিক, কিন্তু এই শব্দটির সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। ডাক্তারও বুঝিয়ে বলেননি আসলে ওর সমস্যাটা কী?
এর মধ্যে চার বছর পার হয়ে গেল, এহসান দু-একটা শব্দের যে কথাগুলো বলত তা বন্ধ করে দিল। খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। পরবর্তী সময়ে ভারত নিয়ে গেলাম। ওখানে ডাক্তার বললেন, আপনার সন্তান অটিস্টিক এবং এটা কী ধরনের সমস্যা, তিনি বুঝিয়ে দিলেন।
চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করলাম। কী করব, কোথায় নিয়ে গেলে আমার বাচ্চা একটু ভালো হবে, সে আশায় পাগলের মতো এখানে-ওখানে ছোটাছুটি করলাম। কিন্তু বাচ্চার কোনো উন্নতি হচ্ছে না, বরং হাইপার হতে লাগল, জিনিসপত্র ভাঙা শুরু করল। আমি চাকরি করতাম। মনে হলো চাকরির জন্য ঠিকমতো পরিচর্যা হছে না, তাই চাকরি ছেড়ে দিলাম। কিন্তু কীভাবে যত্ন নিলে বাচ্চার উন্নতি হবে, তা জানা ছিল না। তাই স্পেশাল স্কুলে চাকরি নিলাম। তখন বিষয়টা ভালো করে বুঝলাম। এদের নিজ হাতে কাজ না শেখালে এরা কিছুই শিখবে না এবং এদের একা রাখা যাবে না। এই চাকরিও ছাড়লাম। শুরু হলো আমার সংগ্রাম।
দিনরাত বাচ্চার পেছনে খাটছি, খাওয়া ও ঘুম ঠিকমতো হয় না। কত রাত বাচ্চা ঘুমায় না, আমিও ওর সঙ্গে জেগে থাকি। দিনে ঘুমালে আমি ঘরের কাজ করি। সমাজের মানুষ ও প্রতিবেশীরা হয়তো পেছনে বলে কোনো পাপের জন্য এমন শাস্তি। তার মানে আমরা ও আমাদের সন্তান সমাজে চরম অবজ্ঞার স্বীকার। আমি মনে মনে চাই, আমার বাচ্চা যেন নিজের কাজ নিজে করতে পারে, তার যেন একটু বুদ্ধি বাড়ে। এ জন্য কতই না চেষ্টা করি, জীবনের সবটুকু সুখ উৎসর্গ করেছি তার স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য। নিজের ক্যারিয়ার ছেড়ে দিয়েছি। নিজের সবটুকু দিয়ে বাচ্চার একটু উন্নতির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করি। আমি আমার ছেলের মুখে শুধু 'মা' ডাক শোনার জন্য ১৭ বছর সাধনা করে যাচ্ছি।
লেখক : অভিভাবক