স্থানীয় সরকার
দলীয় পরিচয়ে নির্বাচন ও গণতন্ত্রের বিপদ
ইংরেজি Cliquism শব্দের বাংলা অর্থ করা হয়েছে দলবাজি। শব্দটিকে আরেকটু হালনাগাদ করে কেউ কেউ ‘পার্টিয়ার্কি’ও বলতে চান। তবে সব কথারই সমার্থক শব্দ হলো—দলাদলি, দলীয় স্বার্থ, পক্ষপাতদুষ্ট, একদেশদর্শিতা, পক্ষানুরাগ, একচোখামি, অসমদর্শিতা, সপক্ষতা, সাম্প্রদায়িকতা বা একপেশে ইত্যাদি।
এই শব্দসম্ভারের সঙ্গে মিল রেখে আজকাল বাংলাদেশের দলবাজির সঙ্গে চরমপন্থা শব্দটিই বেশ সাযুজ্যপূর্ণ! সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, বহুত্ববাদ, গণতন্ত্র, সমতা, পরমতসহিষ্ণুতা এগুলো বাতুলতামাত্র।
কেবিনেটে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এখন থেকে সব নির্বাচন দলীয় পরিচয়ে হবে। অর্থাৎ সমাজের সর্বত্র দলবাজিই প্রথম ও শেষ কথা! এতে দেশ ও জনতার কী লাভ হবে, তা আগাম ঠাওর করা না গেলেও আমাদের অধরা গণতন্ত্র যে আরো বেশি অজানা বিপদের মুখে পড়তে পারে—এমন আশঙ্কাই প্রকাশিত হচ্ছে সচেতন মহলে!
স্বাধীনতা-পূর্ববর্তীকালের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী কিংবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো সম্মানিত, দায়িত্বশীল, বিবেচক, দূরদর্শী ও ন্যায়বিচারক দলীয় কর্মী বা নেতার আকালের যুগে দেশের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত দলবাজি মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে পারবে—এ কথা বুকে হাত দিয়ে কে বলতে পারে?
বর্তমান রাজনীতি যে এক ধরনের বেগতিক অবস্থার মধ্যে আছে, তা তৃণমূল পর্যায় থেকে উঠে এসে এখন রাষ্ট্রের শীর্ষ পদে আসীন মো. আবদুল হামিদের সাম্প্রতিক বক্তব্যেই পরিষ্কার হয়েছে। রাজনীতি কোনোকালেই ব্যবসা ছিল না। এটা ছিল নিরেট জনসেবা বা কোনো কিছুর প্রত্যাশা না করে নিজের সর্বস্ব ত্যাগের মাধ্যমে জনকল্যাণে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাওয়ার ব্রত। অথচ সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে নিজের নামে সেতু উদ্বোধন করতে গিয়ে এক নাগরিক সমাবেশে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তাঁর পর্যবেক্ষণ থেকে সখেদে বলেছেন, দুঃখের বিষয়, আজকে রাজনীতি চলে গেছে ব্যবসায়ীদের পকেটে। এটি হচ্ছে আমাদের দেশের জন্য সবচেয়ে বড় কলঙ্কজনক অধ্যায়। এর হাত থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে। রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের আধিপত্যের অবসানও প্রত্যাশা করেন তিনি। রাষ্ট্রপতি আরো বলেছিলেন, সততা ছাড়া একজন রাজনীতিবিদ কোনোদিনই সে যা করতে চায়, তার বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। টাকা-পয়সার মালিক যদি কেউ হতে চায়, আরো অনেক রাস্তা আছে। রাজনীতির পথ বেছে না নেওয়াই উত্তম।
জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব ক্রমাগতভাবে বেড়ে ৫৭ শতাংশে দাঁড়ানোর তথ্যটি কয়েক বছর আগে টিআইবির এক গবেষণায় উঠে আসে। প্রথম সংসদে এই হার ছিল ১৭ দশমিক ৫ ভাগ। আইনজীবী আবদুল হামিদ ওই সংসদে ছিলেন। ওই সংসদে আইনজীবীর শতকরা হার বেশি থাকলে তা কমে নবম সংসদে ১৪ শতাংশে পৌঁছায়।
মহামান্য রাষ্ট্রপতির পর্যবেক্ষণ ও টিআইবির তথ্য থেকে বোঝাই যাচ্ছে, রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে। রাজনীতিতে নাম লেখালে দল কর্তৃক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে ওই ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত পুঁজির সুরক্ষা মেলে। উপরন্তু সেই ব্যবসায়ী নেতা যদি হন ক্ষমতাসীন দলের, তবে তো পোয়াবারো; বাণিজ্যের লক্ষ্মী তখন ষোলোআনা পয়মন্ত।
আমরা একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই দেখতে পাবো, কোনো নিবেদিতপ্রাণ ত্যাগী কর্মবীর আজকাল পার্টির গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবিতে যেতে পারেন কি না, যদি না তিনি জায়গামতো মালকড়ি ঢালতে পারেন। কোনো নির্বাচনেই মনোনয়ন পান কি না, যদি মানি ও মাসল পাওয়ার না থাকে? কাজেই সব ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয়ে নির্বাচনের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মানি মেশিন রাজনীতির বিকিকিনির হাটবাজারটা শুধু তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া আর কী আসবে-যাবে, তা নিয়ে ভাবতেই পারেন!
দলীয় পরিচয়ে স্থানীয় নির্বাচনের সরকারি এ সিদ্ধান্তে দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি এর পক্ষে বা বিপক্ষে সুনির্দিষ্টভাবে তাদের ভাবনার কথা জানাতে পারেনি। সরকারি নানামুখী চাপে জেরবার বিএনপি তাদের দল গোছানো নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে। কাজেই বিএনপি নেত্রীর অবর্তমানে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা এ সিদ্ধান্তকে সরকারি দুরভিসন্ধি বা অসৎ উদ্দেশ্যজনিত কূটকৌশল আখ্যা দিলেও গ্রহণ বা বর্জনের বিষয়ে মনোভাব জানাতে পারেনি।
বিএনপির রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামী এ সিদ্ধান্তে হতাশা প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে সরকারের সঙ্গে ঘর করা এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টিও এ বিষয়ে না ঘরকা, না ঘাটকা অবস্থায় আছে।
জামায়াতের হতাশার প্রধান কারণ হচ্ছে, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধদুষ্ট হিসেবে তাদের দলের নিবন্ধন আদালতের সিদ্ধান্তে ঝুলে আছে। তাই স্থানীয় কিংবা জাতীয় নির্বাচনে দাঁড়িপাল্লা মার্কা দেখতে পাবে না তাদের অনুসারীরা। এ বিষয়টিকে নিজেদের পক্ষে ঢাল হিসেবে নিতে চাইছে ক্ষমতাসীনরা। কিন্তু সরকারের জানা থাকা ভালো, আওয়ামী লীগে এখন আর ত্যাগী আওয়ামী লীগারদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। প্রকৃত বামপন্থীদের পেছনে ফেলে সময়ের প্রয়োজনে ও স্বার্থের দাবিতে আমূল বদলে যাওয়া পক্ব বামরাই এখন আওয়ামী নিয়ন্ত্রক। তার ওপর সরকারি দলন-পীড়নে কোণঠাসা বিত্তবান হেফাজত-জামায়াতরা নিজেদের পিঠ বাঁচাতে হাজারে-বিজারে ঢুকে পড়েছে আওয়ামী লীগে। পুঁজিবাদী সেসব হাইব্রিড আওয়ামী লীগার যদি নৌকা প্রতীকে নির্বাচনে জিতে গিয়ে ধর্মান্ধতা বা সাম্প্রদায়িকতার বিষ তৃণমূলে ছড়িয়ে দিতে পারে, সেখানে দাঁড়িপাল্লা থাকা-না থাকার মধ্যে কোনো তফাৎ নেই! সুতরাং দলীয় পরিচয়ে নির্বাচনের এটা একটা বিপদ। যে বিপদের কুমির আওয়ামী লীগের কাটা খাল দিয়েই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করার জন্য ওত পেতে আছে।
আগামী দিনের বিএনপি লিডার তারেক রহমান জামায়াতের মতো ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে কৌশলগত কারণে নিজেদের মিত্র হিসেবে রেখেও তবু সাহস করে লন্ডনে বসে একবার বলেছিলেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চলতে পারে না! সেখানে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র হেফাজতে গুলিয়ে দেওয়া আওয়ামী লীগ এমন কথা আজকাল অন্তরেও ভাবে না। তাদের ভাবী নেতা বরং জোর দিয়ে বলেন, তাঁরা চিকন সুতোর ওপর দিয়ে হাঁটছেন। যে সুতো তত্ত্বের সঙ্গে ড. জাফর ইকবালের মতো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষরা তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
এ ছাড়া অনেকেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় পরিচয় বিষয়টিকে জায়েজ করার জন্য ভারত, ব্রিটেন বা আমেরিকার উদাহরণ টানছেন। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনৈতিক দল বুঝি সেসব দেশের স্তরে পৌঁছাতে পেরেছে? যেখানে নিজেদের দলের মধ্যে ন্যূনতম গণতন্ত্র চর্চা নেই, সেখানে তৃণমূলে অগণতন্ত্রের দলবাজিতা ছড়িয়ে দেওয়ার মানেই থাকতে পারে না।
স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সাধারণ মানুষ নিরপেক্ষ জেনে তার কাছে দল-মত নির্বিশেষে ব্যক্তি বা সামষ্টিক সমস্যার প্রবিধান চাইবার অধিকার বা সাহস রাখেন। কিন্তু এখন কি আর সে উপায় থাকবে? পার্টির বিভিন্ন স্তরে অর্থের বিনিময়ে ক্ষমতা পাওয়া দলদাস চেয়ারম্যানরা নিজের দল নৌকা বা ধানের শীষ ছাড়া আর কিছু চিনবেন? দলের বাইরে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন? বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা তাতে সায় দেয় না। রাজনীতির অঙ্গনে প্রতিপক্ষের প্রতি সামান্য সহিষ্ণুতা যেখানে অবর্তমান, সেখানে দলবাজ সমাজপ্রধানরা দলবিচারী না হয়ে মানুষবিচারী হবেন, এ কথা স্বপ্নেও ভাবা সম্ভব নয়! সুতরাং এই সিদ্ধান্ত প্রকৃত সাম্যের গণতন্ত্র চর্চার প্রক্রিয়া না হয়ে বিদ্বেষ ছড়ানোর কলকাঠিই হয়ে উঠতে পারে।
বলা হচ্ছে, মার্কা না থাকলেও স্থানীয় নির্বাচনগুলো বরাবর দলীয় পরিচয়েই হয়ে আসছিল। কথাটা অসত্য নয়। সে সঙ্গে দলীয় মানুষের দোহাই দিয়েই নিজেদের পার্টির লোকদের প্রশাসনযন্ত্র ব্যবহার করে পাস করানোর মহোৎসবও দেখা গেছে সর্বশেষ উপজেলা ও সিটি নির্বাচনে। এমন অবস্থায় দলীয় পরিচয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে কেবল সেই প্রক্রিয়ারই পোক্ত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হবে। এর বেশি কিছু অন্যথা কী হবে?
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে আমরা সহমত পোষণ করতে পারি। বিভিন্ন মিডিয়ায় তিনি বলেছেন, নতুন এ সংশোধনীর নেতিবাচক প্রবণতা নিয়ে যাঁরা সোচ্চার হয়েছেন, তাঁদের যুক্তি ও আশঙ্কাগুলো উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। এমন সিদ্ধান্তের আগে প্রথম প্রায়োরিটি হওয়া উচিত নির্বাচনের সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এবং সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, কারণ এখন নির্বাচন নিয়ে কেউ আগ্রহ বোধ করে না। তাই সর্বত্র আইনের শাসন ও প্রশাসনের নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, ব্যবহারের চিন্তা থেকে যদি তড়িঘড়ি এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং তা বাস্তবায়নে সরকারি দল প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকে, তাহলে এ প্রচেষ্টা দীর্ঘ মেয়াদে তৃণমূলে রাজনীতির সুস্থ ও সুষ্ঠু বিকাশ বাধাগ্রস্ত করবে। অন্তত প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে এ নির্বাচন অনুষ্ঠান সব ধরনের হস্তক্ষেপমুক্ত করা সম্ভব হলে এ ব্যবস্থা একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে পারে। অন্যথায় এ ব্যবস্থা স্থানীয় সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ও কার্যকারিতাকে ক্ষতিগ্রস্তই করবে।
সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারও একই সুরে কথা বলেছেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না; বরং এর পরিণতি অশুভ হতে পারে।
যে দেশে জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসনে দলীয় লোকের ছড়াছড়ি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা যখন প্রশ্নবিদ্ধ, যেখানে অসাধুতা বা অনৈতিকতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়ে বসেছে, সেখানে দলীয় নির্বাচনের সরবত্তা নিয়ে আশাব্যঞ্জক কিছু ভাবার অবকাশ থাকতেই পারে না।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এডমন্ড বার্ক রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, রাজনৈতিক দল এমন এক সংগঠিত জনগোষ্ঠী, যারা একটি নির্দিষ্ট স্বীকৃত নীতির ভিত্তিতে যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সচেষ্ট।
কিন্তু আমাদের এখানে বর্তমানে রাজনৈতিক দল মানে, যারা অবিরাম মিথ্যা বলে, ঘুষ খায়, দুর্নীতি করে, নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে, তুচ্ছ কারণে নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি বাঁধিয়ে গর্ভের সন্তানকে পর্যন্ত গুলি করে বসে, যাঁরা জাতীয় সাফল্যকে দলীয় সাফল্য বলে অপপ্রচার চালায়, যাঁরা নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে ভেবে নিজেদের অন্যায় কখনো স্বীকার করে না, যাঁরা কথায় কথায় হরতাল ডেকে জনদুর্ভোগ বাড়ায়, যাঁরা বিদেশের কাছে নানা অজুহাতে নিজেদের ভাবমূর্তির বারোটা বাজায়, দেশের অর্থ-সম্পদকে যাঁরা নিজেদের সম্পত্তি মনে করে নয়ছয় করে অথবা যাঁরা আজীবন ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে!
লেখক : গাজীপুর প্রতিনিধি, মাছরাঙা টেলিভিশন।