কিশোর অপরাধ
সন্তানের সঙ্গে কি ধ্বংস করছেন দেশ?
মাসশেষে নয়, ভদ্রলোকের বাড়িতে প্রতিদিনই টাকা-পয়সার আগমন ঘটে। এ দেশে টাকা-পয়সা কামাই করতে খুব খাটাখাটনি করতে হয়, তা কিন্তু না। একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই হয়, সঙ্গে দরকার একটু বুঝদার হওয়া। ক্লাস নাইনে পড়া ছেলেটা কয়েকদিন হলো বায়না ধরেছে, কী এক ব্র্যান্ডের নতুন মোটরসাইকেল এসেছে, সেটা কিনে না দিলে নাকি বাসাতেই থাকবে না। আজকালকার ছেলেপেলে, না দিলে কি হয়! দামও খুব বেশি তা নয়, এই লাখ দু-তিনেক টাকার মতো। তিনি এখনো হ্যাঁ-না কিছুই বলেননি ছেলেকে, তবে এর মধ্যেই পরিচিত এক ডিলারের সঙ্গে কথাবার্তাও বলে ফেলেছেন। তাঁর ছেলে বলে কথা, শখের জিনিস কিনে দেবেন না, এমন কি আর হয়?
ওপরের গল্পটি কি খুব বেশি অবাস্তব মনে হয়? প্রতিদিনের ঢাকা শহরে চলাফেরা করা লোকজনমাত্রই বুঝবেন, একেবারেই নয়। অজস্র মোটরসাইকেলে আরোহী হিসেবে নাদান শিশুদের প্রায়ই দেখা যায় আজকাল রাস্তায়। তাদের গতি, হাবভাব দেখলে ঢাকাই ছবি তো কোন ছার, হলিউডের স্টান্টবাজ নায়করাও লজ্জা পেয়ে যেতে পারেন। ভাঙাচোরা খানাখন্দে কিংবা জ্যামজটে ভরপুর রাস্তায় তার ‘যেভাবে’ এবং ‘দক্ষতার’ সঙ্গে তাদের শখের দ্বিচক্রযানটি চালিয়ে যায়, বিষয়টি ‘মুগ্ধ’ হওয়ার মতোই। সমস্যা একটিই, এই ‘মুগ্ধতা’র মাত্রাটি প্রতিনিয়তই বিভিন্নভাবে ছাড়িয়ে যায়। ফলে দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাঘাটের মানুষজনও দু-একজন মারা যায়। এটা তো ঘটতেই পারে, ‘মুগ্ধতা’ সৃষ্টি করলে দু-একজন মরলে এমন কীই বা আসে-যায়। আমাদের দেশে এখন শিশুদের যৌবনটা বছর আট-দশেক আগেই চলে আসছে বিবিধ সাংস্কৃতিক এবং পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির প্রভাবে। আর এই যৌবন মোটেও ‘যুদ্ধে যাওয়ার’ সময় নয়, ‘মোটরসাইকেল চালাবার সময়’। আর মানুষগুলোও এমন, হাংরি যুগের সেই কবিতার বলা ‘গরিবগুলো এত খারাপ, একটুতেই মরে যায়’ মার্কা যেন! একটা দুটো বাড়ি খেতে না খেতেই মরে শেষ!
পরে আবার এসব ঝামেলা তো সামাল দিতে হয়। অল্প বয়সে বাইক ভালো চালাতে পারলেও ঠিকমতো লাইসেন্স জোগাড় করা ঝামেলা হয়, রাস্তাঘাটে কেস খেতে হয় পুলিশের কাছে, কাজেই ‘বড়ভাই’দের সঙ্গে পরিচয় দ্রুত করতে হয়, একটু হাবিজাবি খেতে আর খাওয়াতে হয়, আর একটা গ্যাং থাকতে হয়, ‘পোলাপাইন সব একলগে থাকতে হয়’। আর আরেকটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, বাইক না থাকলে ‘হট’ মেয়েরা পাত্তা দেবে নাকি? অমুক ফ্রেন্ড তো হচ্ছে বাইকে চড়িয়ে আর বাইকের স্টান্ট দেখিয়েই ওর ‘সব কয়জন’ গার্লফ্রেন্ডকে... । বাইক থাকলে সব আছে, বাইক না থাকলে কিছুই নেই।
বয়ঃসন্ধিকালে শরীরমনে এক ধরনের রদবদল ঘটে। এ সময় শরীরের চিরচেনা স্থানগুলো বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনেও উঁকি দেয় দুনিয়া দখল আর ধ্বংস করে দেওয়ার ভীষণ দুঃসাহস, আবেগ। সময়ের সঙ্গে, দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের দেশে এই আবেগটি খুব বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে এসে ঠেকেছে। আর তাতে দুর্দান্ত সঙ্গত জোগাচ্ছেন এ দেশের অজস্র অভিভাবক। যা যা ‘দরকার’, সেগুলো অর্থের প্রাচুর্যে নিশ্চিন্তে জোগান দিচ্ছেন আদরের সন্তানটিকে। এই অভিভাবকদের অনেকে বয়ঃসন্ধি বিষয়ে জানুন কি না জানুন, তারা ‘পড়ালেখার’ গুরুত্ব দিব্যি দেন। কাজেই তাঁরা সন্তানকে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেন যে ‘এ প্লাস’ পেলেই নতুন বাইক কিনে দেবেন, ওটা করলেই সবচেয়ে লেটেস্ট আইফোন, স্যামসাং গ্যালাক্সি বা এইচটিসি কিনে দেবেন। কিন্তু পুঁথিগত বিদ্যা গিলতে গিলতে সন্তানটির যে শিশু বয়সেই সুস্থ এবং স্বাভাবিক আত্মাটির অপমৃত্যু ঘটেছে, তা তাঁদের নজরে আসে না। যার জন্য কলেজে পড়ুয়া ছেলেটি বাইকে চাপা দিয়ে এক সন্তানের মাকে দিব্যি মেরে ফেলে, রাস্তায় মেয়েদের ওড়না ধরে টান দেয়, মানুষজনের হাত থেকে টানের ওপরে ব্যাগ বা জিনিসপত্র নিয়ে চলে যায় ‘মজা’ করে, বাইকের ‘বাহাদুরি’ দেখিয়ে পাঁচ-ছয়জন তারই বয়সী বা কমবয়সী মেয়ের সঙ্গে ‘যা করার করে ফেলে’। এসবের খোঁজখবর মা-বাবার কাছে থাকে না। বা খবর এলেও প্রথম দিকে তারা একেবারেই গা করেন না, ‘এই বয়সী ছেলেপুলে, একটু তো এই রকম করতেই পারে’- বলে উড়িয়ে দেন, বা হয়তো ঠাশ করে এক-দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দেন সন্তানের গালে।
‘একটি তুলসী গাছের আত্মকাহিনী’র সুবাদে আমরা জেনেছি, ‘হাতে বন্দুক থাকলে নিরীহ মানুষেরও চোখ পড়ে পশুপাখির ওপর’। ব্রাজিলিয়ান চলচ্চিত্রকার ফার্নান্দো মেরেলেসের বিখ্যাত থ্রিলার ‘সিটি অব গড’ যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন যে হাফপ্যান্ট পরা ছোট্ট শিশুটি হো হো করে হাসতে হাসতে কীভাবে রিভলভার চালিয়ে গণ্ডা গণ্ডা মানুষ খুন করতে পারে। কাজেই, এই কিশোরদের ‘যেমন খুশি তেমনভাবে’ চলার অনুপ্রেরণা দেওয়ার মতো ‘অযত্ন’ করলে তার ফলাফল কেমন হতে পারে, তা নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন!
সম্প্রতি কয়েকজন শিশুর এমন ‘কাণ্ড’ আমরা সবাই দেখেছি, জেনেছি গণমাধ্যমের কল্যাণে। জাতিসংঘের সূত্রে, তারা যেটাই করে থাকুক না কেন, তারা শিশু। বাস্তবেও তাই। বাইক, গাড়ি আর সবচেয়ে দামি ফ্ল্যাগশিপ স্মার্টফোন চালানোর কায়দাকানুন যতই জানা থাক, বাস্তবেই তারা শিশু। আর এই শিশুটিকে এমন ভয়াবহ করে গড়ে তোলার জন্য, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, সঙ্গদোষ বা যেটার দোষই আপনি দিন না কেন, আসল ব্যাপারটা বুঝতে কষ্ট হওয়া উচিত নয়। আপনার মাঝে যদি ন্যূনতম লজিক কাজ করে, তবে বুঝবেন যে আমাদের অভিভাবকরাই আমাদের শিশুদের দিনদিন মননে-মানসে ভয়াবহ করে তুলছেন নিজেদের অজান্তে, দেশের ভবিষ্যৎ সম্পদ নয় বরং ভবিষ্যতের ত্রাস হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার রসদ জোগাচ্ছেন। এই বিষয়ে সতর্কতা একদিনে-দুদিনে নয়, একজন-দুজনে কথা বলে নয়, রাষ্ট্রের এবং সরকারের থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের ভবিষ্যৎ যদি দিনদিন এমন হয়ে যেতে থাকে, তাহলে জাতির ভবিষ্যৎও ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট হয়ে যাবে সমানুপাতিকভাবে। সময় থাকতে সতর্ক হোন, সন্তানটিকে বাইক কিনে দেওয়ার বদলে তাকে সময় দিন, তাকে বুঝুন এবং তাকে অনেক কিছু বোঝান। নিজে বুঝুন, নিজের চিন্তাভাবনা-কাজকর্ম স্বচ্ছ করুন, পরিষ্কার করুন। আর তাতে যদি আপত্তি থাকে, তাহলে আপনার শিশুসন্তানকে লেটেস্ট বাইক কিনে দেওয়ার সময় একটি লেটেস্ট ব্র্যান্ডের রিভলভারও কিনে দিতে পারেন। যেকোনো কিছু ছোটবেলা থেকে ঠিকমতো শিখতে পারলে তাতে দক্ষতা বাড়ে, এতে করে সে কিছু করুক আর নাই করুক, ভবিষ্যতের একজন স্বনামধন্য গ্যাংস্টার বা ক্যাডার তো হয়ে উঠতেই পারবে! আর হ্যাঁ, রাজনীতির কথাটা না হয় বাদই দিলাম!
লেখক : সাংবাদিক