স্থানীয় সরকার
সবার আগে প্রয়োজন অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চা!
২০১২ সালের নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন শুরু থেকেই ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। কে পাচ্ছেন, কে পেলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থন তা নিয়ে কত নাটকীয়তা! নির্বাচন ঘিরে নেতাকর্মীরা ভাগ হয়েছেন দুই ভাগে, দলছুটও হয়েছিলেন কেউ কেউ। আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার পরও ডা. সেলিনা হায়াত আইভী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। মনোনয়ন পেয়েছিলেন শামীম ওসমান। আইভিকে নির্বাচন থেকে সরে যেতেও বলা হয়েছিল। কালো টাকা, ক্ষমতার দাপট সব কিছুর চেষ্টা হয়েছিল সে নির্বাচনে। ড. এ টি এম শামছুল হুদার সে কমিশনের শক্ত ভূমিকার কারণে নানা চেষ্টার পরও নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি কোনো পক্ষ। আর দলীয় সমর্থন না পেলেও হাল ধরে রেখেছিলেন আইভি। দলের সমর্থন হারালেও নারায়ণগঞ্জবাসীর সমর্থন নিয়ে দেশের প্রথম নারী মেয়র হয়েছিলেন ডা. আইভী।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ছোট একটা উদাহরণ এটি। স্থানীয় নির্বাচনে দলের সমর্থন নিয়ে এমন টানাহেঁচড়া হয় দেশের সব জায়গায়। হয় অর্থ লেনদেনও। হোক সেটা ক্ষমতাসীন কিংবা বিরোধী দলে। সিটি করপোরেশন কিংবা ইউনিয়ন পরিষদে।
তৃণমূলের উন্নয়নে দাবি ছিল, স্থানীয় সরকার কাঠামো শক্তিশালী করতে সবগুলো প্রতিষ্ঠানকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসার। সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল- জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে সুস্থ নির্বাচনী সংস্কৃতির পথে হাঁটার। সেসব কিছুই হয়নি। হয়েছে, নির্বাচনী কিছু আইনের সংশোধনী। ক্ষমতাসীন দল ছাড়া যা কখনোই কারোই দাবি ছিল না।
স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা ও জেলা পরিষদ এবং পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন এই পাচটি নির্বাচনের অংশগ্রহণে সরকারের পক্ষ থেকে যে আইন করা হয়েছে সেটিকে অনেকে অনেকভাবে ব্যাখ্যা করছেন। সাদা চোখে তাকিয়ে এক বাক্যে বলা যায়, এতদিনও এ নির্বাচন অনেকটা দলীয়ভাবেই হয়েছে। তবে এর জন্য লিখিত কোনো আইন ছিল না। নতুন এ আইনের মাধ্যমে তা পূর্ণতা পেয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে যদি বলি, ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের পত্রিকাগুলোতে চোখ রাখলেই দেখা যাবে সবগুলোতে ছিল প্রায় একই ধরনের শিরোনাম। উপজেলা নির্বাচনের প্রথম তিন ধাপের সংবাদ শিরোনাম ছিল, উপজেলায় এগিয়ে বিএনপি শেষের দুই ধাপে- অনিয়ম আর কারচুপির পাশাপাশি জিতেছে আওয়ামী লীগ। মোটামুটি এমনই শিরোনাম ছিল বেশির ভাগ পত্রপত্রিকায়।
আরেকটু পেছনে তাকালে ২০১৩ সালের গাজীপুরসহ পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গণমাধ্যমের সংবাদ ছিল- পাঁচ সিটিতে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি। কিংবা পাঁচ সিটিতে বিএনপির জয়।
যদি বলি এটা শুধু গণমাধ্যমের ভাষা ছিল তাই না। দলীয় নেতাকর্মী থেকে গোটা দেশবাসীই কিন্তু বিষয়গুলোকে এমনভাবে দেখেছে। এখনো ইউনিয়ন কিংবা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সময় তৃণমূলের অনেক ভোটারের মুখে শোনা যায় আওয়ামী লীগের মার্কা আনারস কিংবা বিএনপির মার্কা ছাতা। নতুন যা হয়েছে তা হলো, স্থানীয় নির্বাচনে এখন থেকে শোনা যাবে নৌকা, ধানের শীষ কিংবা লাঙ্গল প্রতীকের কথা; যা দেশের ইতিহাসে একেবারেই প্রথম।
দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচন উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে হয়ে থাকে। উদাহরণ, ভারতের পঞ্চায়েত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচনের রেওয়াজ আছে। তবে তেমন পরিবেশ কী বাংলাদেশে আছে?
এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাজনৈতিক দলের। কারণ দলগত নির্বাচন মানেই দলীয় মনোনয়ন। বাংলাদেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের মধ্যেই গণতন্ত্রের চর্চা নেই বললেই চলে। ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন সবখানেই রয়েছে স্বজনপ্রীতি। ভবিষ্যতের স্থানীয় নির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থী বাছাইয়ে এই সংকট খুব বড় আকারে দেখা দিতে পারে, যা চোখ বন্ধ করেই বলে দেওয়া যায়। দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে অনেকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করার সুযোগ হারাবে সংশোধিত আইনের প্রয়োগের ফলে।
শুরুর সেই নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন প্রসঙ্গে যদি আসি তাহলে বলা যায়, সে সময় সেলিনা হায়াৎ আইভী দলের সমর্থন হারালেও জনসমর্থনে জিতেছিলেন। এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যাঁরা দলের মধ্যে কোণঠাসা হলেও জনগণের কাছে আস্থার প্রতীক। নতুন সংশোধনীর আলোকে নির্বাচন হলে অনেকটাই সংকুচিত হবে তৃণমূলের গণতন্ত্রের দুয়ার।
সাধারণত সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্রভাবে অংশ নিতে চাইলে প্রার্থীকে এক এলাকার ভোটারের এক শতাংশের স্বাক্ষরসহ মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার বিধি রয়েছে। বিধি অনুযায়ী মনোনয়ন জমা দিতে গিয়ে তড়িঘড়ি করে অনেকেই সুযোগ হারায়। এমন উদাহরণ অহরহ। তবে এতদিন স্থানীয় সরকার নির্দলীয় হওয়ায় স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের অংশগ্রহণের অবাধ সুযোগ ছিল সবার। কিন্তু নতুন সংশোধনীর ফলে সে পথ অনেকটাই রুদ্ধ হবে।
দলগতভাবে নির্বাচনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন। ২০০৮ তৎকালীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের নিয়ম চালু হয়। ওই সময় রাজনৈতিক দলগুলোকে যেসব শর্ত বেঁধে দেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে প্রধান শর্ত ছিল- কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ জেলায় ও ১০০ উপজেলায় রাজনৈতিক দলের কার্যালয় ও কমিটি থাকতে হবে। সে সময় এই শর্ত পূরণ করতে না পেরে শতাধিক রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বঞ্চিত হয়েছে। পরবর্তীতে কাজী রকিব উদ্দীনের নতুন কমিশনের অধীনে প্রায় অর্ধশত দল নিবন্ধনের আবেদন করলেও দুটি ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দলই নিবন্ধন পায়নি। বর্তমানে সব মিলিয়ে ৪০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে।
স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে পার্বত্যাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের তৃণমূলের অনেক রাজনৈতিক দল ভোটে অংশ নেয়। তাদের অনেকেই ভোটে জয়লাভ করে। এমন নজির কম নয়। গেল উপজেলা নির্বাচনে পাবর্ত্য অঞ্চলের পিসিজেএসএস, ইউপিডিএফ, জেএসএসসহ তৃণমূলের অনেক রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা ভোটে জয়লাভ করে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন।
নতুন সংশোধনী অধ্যাদেশ আকারে না হলেও একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ডিসেম্বরের পৌরসভা নির্বাচনের আগে আপাতত কোনো রাজনৈতিক দলকে নতুন করে নিবন্ধন দেওয়া হবে না। এ ছাড়া নিবন্ধনের শর্তও পরিবর্তন করা হবে না। যদি তা না হয়ে থাকে তাহলে তৃণমূলের এসব রাজনৈতিক দলের কাছে নতুন এ সংশোধনী একটা বড় দুঃসংবাদ। কেননা নতুন আইনের মারপ্যাঁচে পড়ে অনেক প্রার্থীরই নির্বাচনে মনোনয়নপত্র বাতিলের সম্ভাবনা থাকবে।
তবে, সবচেয়ে বেশি ভূমিকা যাদের, নির্বাচন কমিশন তাদের অবস্থানও অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের হাতে অবাধ ক্ষমতা থাকলেও অদৃশ কারণে সেই ক্ষমতা চর্চার সঙ্গে এখনো পরিচিত হতে পারেনি বর্তমান নির্বাচন কমিশন। যার উদাহরণ সবশেষ অনুষ্ঠিত হওয়া ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ ও চট্টগ্রামের সিটির নির্বাচন। সুতারং দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বিধিমালায় পরিবর্তন বা সংশোধন ছাড়া সংশোধিত আইনে ইসি নির্বাচন অনুষ্ঠিত করলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তৃণমূলের রাজনীতি। আর এর মাশুল দিতে হবে সাধারণ জনগণকেই।
লেখক : সংবাদকর্মী, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।