তরুণ প্রজন্ম
ফারিজ কোনো আলাদা চরিত্র নয়
রাজপথে সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রকাশ্যে পিস্তল উঁচিয়ে আলোচিত হয়েছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য এইচ বি এম ইকবাল। ২০০১ সালের ওই ঘটনার পর ২০১৫ সাল, এবার খবরের শিরোনাম তাঁর ভাইয়ের ছেলে ফারিজ রহমান।
ঘটনা গত ১২ অক্টোবরের।রাজধানীর গুলশানে প্রাইভেটকার চাপা দিয়ে কয়েকজনকে আহত করেন ১৬ বছরের এই কিশোর। ওই দিন বিকেলে গুলশানের ৭৪ নম্বর সড়কে দুই বন্ধুর কার রেসিংয়ের সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে ফারিজের গাড়ি।
শুরুতে ঘটনাটি গণমাধ্যমে খুব একটা পাত্তা পায়নি। প্রথম সারির দুয়েকটি দৈনিক বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ছাপলেও টেলিভিশনে খবরটি চোখে পড়েনি। তবে সমালোচনার ঝড় ওঠে অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকে। প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান হওয়ায় ফারিজকে বাঁচাতে পুলিশি তৎপরতার বিরুদ্ধে সেখানে ক্ষোভ জানায় সাধারণ মানুষ। এ অবস্থায় এগিয়ে আসেন উচ্চ আদালত।
জনস্বার্থে দায়ের করা এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের অবকাশকালীন বেঞ্চ ২০ অক্টোবর এই মর্মে রুল জারি করেন যে, ফারিজের বিরুদ্ধে কেন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে মামলা না করায় গুলশান থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কেন আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চান আদালত।
এ বিষয়ে ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া সাংবাদিকদের বলেছেন, ঘটনার আটদিন পরও পুলিশ কোনো মামলা করেনি। কিন্তু মোটরযান আইন অনুসারে ২১ দিনের মধ্যে মামলা না করলে আর কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। তাই জনস্বার্থে সুপ্রিম কোর্টের ছয়জন আইনজীবী এ বিষয়ে রিট করেন।
২
ফারিজের ওই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ১৭ অক্টোবর রাজধানীর এজিবি কলোনিতে স্থানীয় কিছু বখাটের মোটরবাইক চাপায় নিহত হন এক নারী। ২১ অক্টোবর বিডি নিউজ এ ঘটনার একটি ফলোআপ প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে, ‘এজিবি কলোনির বাইক সন্ত্রাস’। বিডি নিউজের অপরাধবিষয়ক প্রধান প্রতিবেদক লিটন হায়দারের ওই রিপোর্টে বলা হয়, মতিঝিল এজিবি কলোনি ঘিরে ডজনখানেক বখাটে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। এদেরই একটি দলের বখাটেপনায় প্রাণ যায় গণপূর্ত বিভাগের হিসাব সহকারী রুনা আক্তারের (২৬)। তার স্বামী লুৎফর রহমান একটি মামলা করলেও তারা নিজেরাই এখন আতঙ্কে আছেন। মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন রুনার বাবা মোহাম্মদ সোবহান। ওই দিন রুনাকে ওড়না টেনে রাস্তায় ফেলে তারপর মোটরসাইকেলের চাকায় পিষে পালানোর সময় স্থানীয়দের হাতে আটক হয় আল আমিন সোহান ওরফে সোহান শাহরিয়ার (১৯) নামের এক তরুণ। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করলেও একই বাইকে তার সঙ্গে থাকা আরো দুজনকে কেন ধরা হচ্ছে না, সে প্রশ্ন তুলেছে রুনার পরিবার।
৩
প্রশ্ন হলো, ফারিজ কিংবা সোহান শাহরিয়ারদের নিয়ে এখন যে আলোচনা-সমালোচনা আর বিতর্ক হচ্ছে, তাতে নতুন কী আছে? এ রকম ঘটনা কি প্রতিনিয়তিই ঘটছে না? এই তরুণরা কি সমাজের আলাদা কেউ এবং তারা যে ঘটনা ঘটিয়েছে, তা কি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা?
বস্তুত বাংলাদেশের ভেতরে গুলশান-বনানী-বারিধারার মতো অভিজাত এলাকায় খুব গোপনে গড়ে উঠেছে আরেক বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশেরই প্রতিনিধি ফারিজ বা সোহান। যারা মাতাল ষাঁড়ের মতো গোঁ গোঁ শব্দ করে বাইক কিংবা কার ছোটায়, যারা ওই বিরক্তিকর শব্দ নিশ্চিত করতে মোটরসাইকেল অথবা গাড়ির সাইলেন্সার পাইপ খুলে ফেলে। এই তারুণ্য বেড়ে উঠছে আধুনিক শিক্ষায় অথচ তারা মাতৃভাষা বাংলার চেয়ে ইংরেজিতে বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করে, যে তারুণ্যের কাছে ফকির লালন বড়জোর একজন শিল্পী এবং যার গানের কথা বিকৃত করে পশ্চিমা যন্ত্রের করাতে তথাকথিত ফিউশনের নামে অস্থিরতা তৈরি করে, এই তারুণ্যের কাছে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধ আলাদা কোনো মানে তৈরি করে না, এই তারুণ্য চে গেভারার ছবিসহ টি শার্ট গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়ায় অথচ চে কে জানতে চাইলে বলে, হি ওয়াজ আ ফ্যাশন আইকন, ফারিজ সেই তারুণ্যেরই প্রতিনিধি, আলাদা কেউ নয়।
তবে দোষ তাদের একার নয়। এই তরুণদের জন্য আমরা কোন বাংলাদেশ তৈরি করছি অথবা তারা আসলে কী ধরনের বাংলাদেশ চায় কিংবা কী ধরনের বাংলাদেশ তারা নির্মাণ করতে চায়- এ বিষয়গুলোরও এখন মীমাংসা হওয়া জরুরি। প্রশ্নটি করতে হবে তাদের অভিভাবকদেরও। কেননা তারুণ্যের এই সংকট শুরু হয় ভোগবিলাসিতা থেকে। আমাদের যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সম্পদের যে বৈষম্য তাতে তারুণ্যের একটা অংশ খুব গোপনে, কখনো প্রকাশ্যেই ফারিজ বা সোহান হয়ে উঠবে- এটিই স্বাভাবিক।
এই তারুণ্যের সামনে কী স্বপ্ন রয়েছে? তাদের কজনের চোখের সামনে সবুজ ঘাসের দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, নদী আর বিশাল নীল আকাশ রয়েছে? এসির কৃত্রিম হাওয়ায় অভ্যস্ত এই তারুণ্যের কাছে খোলা জানালার দখিন হাওয়া বিশেষ কোনো মানে বহন করে কি? পিৎজা বার্গার আর হট ডগের ভিড়ে এই তারুণ্যের কাছে শীতের সকালে মাটির উনুনে খড়ের আগুনে জ্বাল দেওয়া খেজুরের রস কিংবা পাটিসাপটা পিঠা কি কোনো বার্তা বহন করে?
তাদের এইম ইন লাইফ বা জীবনের লক্ষ্য কী? নামি স্কুল-কলেজ আর ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা শেষ করে পৈত্রিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর, অথবা কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানের দাসত্ব… এই তো? তো এই তারুণ্যের কাছে আপনি কতটা মানবিকতা, কতটা দেশপ্রেম আর কতটা বিনয় আশা করবেন?
এখন হয়তো উচ্চ আদালতের নির্দেশে গুলশানের ওই ঘটনায় মামলা হবে, ফারিজকে পুলিশ গ্রেপ্তার করবে এবং সড়ক দুর্ঘটনায় কাউকে মেরে ফেললেও যেহেতু চালকের ওই অর্থে কোনো বিচার হয় না, তাই এটি ধারণা করাই সঙ্গত যে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফারিজ জামিনে বেরিয়ে আসবে। তারপর গণমাধ্যম আর অনলাইন যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে দেশের মানুষ ‘আহা, উহু’ করবে। তারপর নতুন ইস্যু আসবে। সবাই ভুলে যাবে ফারিজকে।
সুতরাং অনলাইন যুদ্ধ, মাবনবন্ধন, মিছিল, মামলা, গ্রেপ্তার, জেল- এসব টোটকা চিকিৎসায় ফারিজদের কর্মকাণ্ড বন্ধ হবে না। বরং সমস্যার উৎস চিহ্নিত করে এর টেকসই সমাধানে মনযোগ দিতে হবে। ফারিজরা কীভাবে বেড়ে উঠছে, তাদের সামনে কী আর্দশ আর লক্ষ্য আমরা ঠিক করে দিচ্ছি, তারা নিজের দেশকে আসলে কতটা বুকে ধারণ করে, নিজের ভাষাকে তারা কতটা শ্রদ্ধা করে, কাগজে-কলমে শিক্ষিত হলেও আসলে তাদের মধ্যে সিভিক সেন্স বা নাগরিক ভব্যতা কতটা গড়ে উঠছে, বড়দের দেখলে সম্মান করার মতো খুব সাধারণ ভদ্রতাটুকু তারা শিখছে কি না, বা শেখানো হচ্ছে কি না- সেদিকে নজর না দিলে, মাতাল ষাঁড়ের মতো গোঁ গোঁ শব্দে ফারিজদের বাবা-চাচাদের টাকায় কেনা দামি গাড়ি সাঁই সাঁই করে চলবেই আর তার ধাক্কায় নিরীহ মানুষ হতাহত হতেই থাকবে।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক ও উপস্থাপক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।