উদাসীনতা কর্তৃপক্ষের খেসারত জনগণের
এবার ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তারের পর সবচেয়ে বড় সত্য হলো এই রাজধানীতে তথা এই দেশে জনস্বাস্থ্যের এক ভগ্নদশা বিরাজমান। একই সঙ্গে বড় প্রশ্ন, কে চোখ ফেরাবে জনস্বাস্থ্যের এই করুণ দশায়? প্রতিদিন মানুষের মৃত্যুর খবর আসছে। ছোট্ট ছেলেকে কবরে শুইয়ে দৌড়ে এসে হাসপাতালে ছোট কন্যার পাশে ছুটছেন পিতা। এমন খবর আমাদের সবাইকে না হোক, কিছু মানুষকে তো নাড়া দিয়েছেই। আমাদের জিজ্ঞাসা, আর কতগুলো প্রাণের মূল্যে বুঝতে হবে, রাজধানীসহ সারা দেশের স্বাস্থ্যের সংকট কোথায়?
ঈদ আসছে, মানুষ ছুটছে নিজ নিজ জেলা-উপজেলা আর গ্রামে। তার আগেই ডেঙ্গু পৌঁছে গেছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। কতজন আক্রান্ত, কতজন মারা গেছে ডেঙ্গুতে, সে নিয়ে টেলিভিশনের স্ক্রলে নিয়মিত সর্বশেষ আসছে। ঢাকা নগরীর কর্তারা, বিশেষ করে দক্ষিণের মেয়র, স্বাস্থ্যমন্ত্রী আর সেতুমন্ত্রী কত কী বলে চলেছেন। নানা ধরনের তর্ক হচ্ছে। কাউকে দোষ না দিয়ে, কারো সঙ্গে বিতর্ক না করেই বলে দেওয়া যায় এত দ্রুত, ব্যাপক এবং ঝুঁকিপূর্ণ সংক্রমণ সম্প্রতি আমরা আর কোনো রোগের দেখিনি।
এটা মহামারি কি না, জাতীয় দুর্যোগ কি না, জরুরি অবস্থা জারির মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে কি না এমন সব রাজনীতি মানুষ আর নিতে পারছে না। কিন্তু মানুষ কিছু করতেও পারছে না। কারা মশা মারার নামে মশকরা করল, মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করল, কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করল সেটা কোনো দিন আর জানা যাবে না। মানুষ শুধু এটুকু বুঝছে, মরণ রোগ আর দায়িত্বের শীর্ষে থাকা ব্যক্তিদের উদ্ভট কর্মকাণ্ডে তাদের স্বর স্তব্ধ।
সিটি করপোরেশন বারবার বলতে চেয়েছে, বৃষ্টির অভাব আর জনসাধারণের অসচেতনতাই মূলত এ সমস্যার জন্য দায়ী। দুটি কথাই অকাট্য। এ কথা ঠিক যে, আমরা সাধারণ মানুষ, বিশেষত শিক্ষিত মানুষরা ডেঙ্গু বিস্তারে যথেষ্ট সাহায্য করেছি। ফুলদানিতে পানি দীর্ঘদিন ফেলে রাখা বা বাগানে, ছাদে, কার্নিশে জমা পানি না ফেলে দিয়ে মশার বংশবৃদ্ধিতে সহায়তা করেছি। জুলাই-আগস্টের আবহাওয়া তাদের বংশবৃদ্ধিতে সহায়ক ছিল, তা-ও ঠিক।
কিন্তু বিষয়টি এটুকুতেই সীমাবদ্ধ? সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য বিভাগ তথা সরকার কি জবাব দেবে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধের জন্য যে জনস্বাস্থ্যমুখী কাজকর্ম করা দরকার, সেটা তারা কখন করল? জনসংখ্যার ঘনত্বে ঢাকা বিশ্বের বুকে এক আলোচিত শহর। পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশনসহ নাগরিক কর্মকাণ্ড এখানে এক চ্যালেঞ্জ সব সময়। ঢাকার মতো মশা পৃথিবীর আর কোনো শহরে আছে কি না, জানা নেই। বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও অপ্রতুল। এই শহরের নাগরিকদের জন্য সিটি করপোরেশনের নিজস্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বলতে কিছু আছে কি না, তা কেউ কোনোদিন চোখেও দেখেনি। সিটি করপোরেশনের দুটো নিজস্ব কাজ—বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আর মশা মারা। এ দুই কাজেই করপোরেশনকে কোনোদিনই যথেষ্ট তৎপর দেখা যায়নি। জবাবদিহি একেবারে নেই বলে স্বাস্থ্য খাতে এবং বিশেষ করে মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে দুই করপোরেশন কতটা খরচ করেছে, কতটা করতে পারত তা বোঝার কোনো উপায় নেই।
সিটি করপোরেশনের বাইরে জনস্বাস্থ্যের দেখভাল করে প্রধানত স্বাস্থ্য বিভাগ। ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তারের মধ্যেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী হঠাৎ করে দেশের বাইরে চলে গেলেন, যখন প্রধানমন্ত্রীও দেশের বাইরে। নানা সমালোচনায় মাঝপথে তিনি ফিরে এসেছেন ঠিকই, কিন্তু সাংবাদিকদের ধমক-ধামক দেওয়া ছাড়া দৃশ্যত তিনি কিছু করছেন বলে প্রতীয়মান হয় না। তবে রাজধানীর সব হাসপাতালে নিজেদের সাধ্যমতো সেবা দিতে চেষ্টা করছেন চিকিৎসক ও তাঁদের সহকর্মীরা। এই সেবা দিতে গিয়ে নয়জন চিকিৎসকেরও জীবন গেছে ডেঙ্গুতে।
কেন এত অবহেলা? আসলে একবার নির্বাচিত বা অনির্বাচিত হয়ে গদিতে বসে গেলে জনগণকে আর পাত্তা দেওয়া লাগে না। উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের অকালপ্রয়াণের পর আমরা বুঝেছি আমাদের সিটি কর্তাদের কাছে রোগ প্রতিরোধ, জঞ্জাল সাফ রাখা, দূষণ নিয়ন্ত্রণের মতো জনস্বাস্থ্যের কাজ জরুরি না। অনেক সময়ই আমরা জনস্বাস্থ্যের প্রতি বিপুল উদাসীনতা দেখেছি। এবার এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। আর গেল যখন, তখন দক্ষিণের মেয়র প্রথমে তা আমলে না নিয়ে এটা সেটা বলেছেন। আতঙ্কজনক সদৃশ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েও সমাধানে উদাসীন থেকেছে। পরে চেষ্টা করেছেন আবহাওয়া আর জনগণকে দোষ দিতে। এভাবে দায় সারা যায়?
আপাতত বর্ষার ওপর ভরসা করা ছাড়া ডেঙ্গু কমানোর আর কোনো উপায় নেই। সামগ্রিকভাবে দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে সমন্বয় ও সুসংহতির অভাব স্পষ্ট। আছে নাগরিক সমাজের অসচেতনতা। কিন্তু সবচেয়ে বেশি পীড়াদায়ক আন্তরিকতার অভাব।
এই ডেঙ্গু প্রমাণ করল যে, বেসরকারি হাসপাতালে লাখ লাখ টাকা খরচ করে চিকিৎসা করালেও জনস্বাস্থ্যের ফাঁক পূর্ণ করা যায় না। সরকার এবং সাধারণ মানুষ চিকিৎসার খরচের নিরিখে এবং অসুস্থতার জন্য হারানো রোজগারের বিচারে, এ বছর যত টাকার ক্ষতি স্বীকার করেছেন, তার অতি সামান্য অংশ খরচ করলে যথেষ্ট জনস্বাস্থ্য কর্মী নিযুক্ত করে মশা প্রতিরোধ করে, রোগ প্রতিরোধ করা যেত। এগুলো প্রাণ হারিয়ে সুপরিকল্পনার অভাবের খেসারত দিতে হতো না দেশবাসীকে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা