বিশুদ্ধ সুবিধাবাদ
রাজনীতিতে নানা পরিবর্তন আসে। কখনো উত্তেজনা, কখনো নিস্তেজতা। কিন্তু সুবিধাবাদের হাওয়া সব সময় অপরিবর্তিত থাকে। ডান, বাম, মাঝামাঝি যেদিকেই দাঁড়িয়ে থাকুন, সুবিধাবাদের বাস্তবতাকে অবহেলা করা শক্ত।
তাই রাজনীতির অঙ্গনে যিনি যত গলাবাজি করেন, যত বিপ্লবী ভাব দেখান তিনি তত সুবিধা খুঁজে বেড়ান। সরকারকে অবৈধ বলবেন, সংসদকে অবৈধ বলবেন সংসদে বসেই, আবার সাংসদ হিসেবে প্রাপ্য গাড়ির বাইরেও বাড়ি বা প্লট চাইবেন—এমন রাজনীতিবিদের দ্রুত ধাবমান সুবিধাবাদী ইতিহাস লেখাও শক্ত।
জনতার দরবারে দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিকদের এক প্রকার বিচার হয়। কিন্তু সততার মুখোশ পরা সুবিধাবাদী রাজনৈতিক নেতা বা পরিবারগুলো কী কারণে যেন সম্মান ভোগ করতে থাকে। একটা সুবিধাবাদী এবং সুবিধাভোগী শ্রেণি রাজনৈতিক দলগুলোকে অনেক আগেই তাদের কবজায় নিয়েছে। এখন শুধু তাদের স্বরূপ উন্মোচিত হচ্ছে।
আমরা বলি এবং বলেই চলেছি যে, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছে। কিন্তু সুশীল ভাবমূর্তির এই সুবিধাবাদী চরিত্রকে কী বলা যায়? যে দল বা জোট ক্ষমতায় থাকে, তাদের অনেক কাজ অপশাসনের পর্যায়ে চলে যায়। এ জন্য মানুষ বিরোধী দলকে বিকল্প ভাবতে থাকে। সংসদীয় পদ্ধতিতে এটাই বাস্তবতা। তবে বিকল্প যদি নীতি-নৈতিকতাবর্জিত এমন সুবিদাবাদী হয়, তাহলে মানুষ যাবে কোথায়?
তবে গণতন্ত্র তো সম্ভাব্যতার শিল্প। গত বছর ডিসেম্বরে হওয়া একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের কারণে মুখ থুবড়ে পড়া ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের রাজনীতি কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। মাত্র ছয়টি আসন নিয়ে যাব কি যাব নার দরকষাকষিতে জয়ী হয়েও সংসদে যাননি বিএনপির রাজনৈতিক শাখার মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে যাব না বলে, এই সংসদ অবৈধ বলে গলা ফাটিয়েছেন যাঁরা, সেই দু-একটি মুখ গেছেন এবং সংসদ সদস্য হিসেবে প্রাপ্য সুবিধাদি গ্রহণ করতে শুরু করেছেন। কাগজে-কলমে এটা অবশ্য দোষের কিছু নয়। কিন্তু চরিত্র বিচার করলে? সেই বিচার নাই বা হলো।
গণতন্ত্র তো কেবলই সম্ভাব্যতার কথা বলে। এই সুবিধাবাদও একটা সম্ভাবনা। কিন্তু এই গণতন্ত্রের চর্চায় জনগণের অবস্থান কোথায়? যদি প্রশ্ন করা হয় তারা কেমন করে রাজনীতি করছে, যখন দেশে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই? উত্তর একটাই আসবে, গণতন্ত্র আছে বলেই একুশে আগস্টের মতো ঘটনা ঘটিয়ে এখনো তারা রাজনীতি করছে। এটাই প্রমাণ করে গণতন্ত্র। সরকারকে সারা দিন গালি দিয়ে সরকারের কাছেই সুবিধা চেয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাই গণতন্ত্র।
কথায় কথায় জনগণের মতামতের কথা তারা বলে। কিন্তু আসলে তারা বিশুদ্ধ সুবিধাবাদ চর্চা করে। জনগণের কথা বলে জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে দ্রুত ধনী হওয়ার সিঁড়ি খোঁজাই তাদের রাজনীতি। এই জনগণকে ব্যবহার করে অর্থবিত্তের মালিক হয়ে শ্রেণি উত্তরণ ঘটানোই তাদের রাজনীতি। এখন কোনো এক প্রান্তে প্লট চায়, কারণ নামকাওয়াস্তে বিরোধী দলে আছে। এই চরিত্র ক্ষমতায় এলে কি চাইত? বা কী দখল করত? নির্বাচনী হলফনামায় নিজেকে দেউলিয়া না বলেও চাওয়া যায়, চেয়ে কাতর হওয়া যায়। আসলে নিজের বিকাশ ও নিরাপত্তার যাবতীয় ব্যবস্থা পাকাপাকি করে রাখাই এদের রাজনীতি।
সুবিধাবাদী রাজনীতির নীতিহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মতো দল বা সংগঠনও এখন বিলুপ্তপ্রায়। সত্তর দশক এমনকি আশির দশক বা বলা যায়, গত শতকের শেষ দশক পর্যন্তও মধ্যবিত্তের মধ্যে শিল্প-সংস্কৃতির চর্চার মধ্য দিয়ে যে প্রতিবাদী চেতনার প্রকাশ ছিল, তা এখন নেই। আসলে দল থেকেই প্রতিবাদটা আসতে পারত। দলের কর্মীরা বিরোধী অবস্থানে থাকলে নানা ধরনের অত্যাচার সইতে হয়, এটাই রাজনীতির বাস্তবতা। কর্মীদের সেই কষ্টের ওপর দিয়ে বা রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে যারা সুবিধার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, তারাই রাজনীতিতে ‘সুশীল সমাজ’ নামে একটি গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে।
অনেকে বলবেন, তরুণ বয়সের এই রাজনীতিক একটা বড় ধাক্কা খেলেন হয়তো। কিন্তু তিনি নিজে এটা বিবেচনায় নেননি। জনপ্রিয়তা কমছে না বাড়ছে, না স্থিতাবস্থায় আছে, তা অনুসন্ধান করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তার নেই। জনপ্রিয়তা নয়, পাটিগণিতই এ ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামক। তিনি ফল চান, কী পেলেন, কতটা হাতিয়ে নিতে পারছেন, সেটাই বিবেচ্য।
মানুষের মনে এখন আসলে ঘৃণাটাও নেই। কিছুটা হলেও সেই বোধটি জাগিয়ে দেওয়া গেলে সুবিধাবাদী রাজনীতিকরা সম্মান নিয়ে ভাবতেন। এখন আর সেই ভাবনা নেই। ভাবনা কেবল অর্জনের খেলা। কিসের মধ্যে প্রকৃত রাজনীতি, কতখানি মানুষের জন্য কাজ করা—মগজ খাটিয়ে তা বিচার করার রাজনীতি আর নেই। আর নেই যেহেতু, তাহলে আমরা কেন তার রাজনীতি নিয়ে ভাবছি? এ দেশে তো এমন বুদ্ধিজীবীর অভাব নেই, যারা প্লটের লোভেও নৈতিকতা খুঁজে পান বা যুক্তির সন্ধান করেন।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি, সারাবাংলা।