প্রকৃতি
সুন্দরবনে আরো কয়েকটি জাহাজ ডুবুক
নিজের ভালোর জন্য অন্যের অকল্যাণ কামনা করা কোনো ভালো মানুষের লক্ষণ নয়। কিন্তু স্বার্থটি যদি হয় দেশের, তখন এই বৃহত্তর স্বার্থে কিছু মানুষের ক্ষতি কামনা করা হয়তো দোষের নয়।
বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন রক্ষায় সুন্দরবনের নদীতে আরো কয়েকটি জাহাজডুবির প্রার্থনাটি সে জন্যই। কেননা, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের হাত থেকে সুন্দরবন বাঁচাতে যে ধরনের জনমত গড়ে ওঠা দরকার, সরকারের ওপর যে ধরনের চাপ প্রয়োগ করা দরকার, তা হয়তো এখনো গড়ে ওঠেনি। সুন্দরবনে আরো কয়েকটি জাহাজ ডুবলে হয়তো সেই জনমত তৈরি হবে।
গত বছরের ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ডুবে যায় একটি তেলবাহী ট্যাংকার। ওটি নর্দার্ন-৭ নামে ওই ট্যাংকারডুবির কয়েক মাস পর ৫ মে সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের ভোলা নদীতে ডুবে যায় সারবাহী একটি কার্গো জাহাজ। এমভি জাবালে নূর নামে জাহাজটি থেকে পটাশিয়াম পানিতে মিশে সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। আর সর্বশেষ গত ২৭ অক্টোবর রাতে সুন্দরবনের পশুর নদে ডুবে যায় কয়লাবোঝাই একটি কার্গো জাহাজ। মংলায় নির্মাণাধীন সাইলোর কাছে কয়লাভর্তি মাদার ভেসেল জি আর রাজ নামে ওই কার্গো তলা ফেটে ডুবে যায়।
সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে তেলবাহী ট্যাংকারটি ডুবে যাওয়ার পর দেশ-বিদেশের পরিবেশবাদী, বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক এবং সরকারের কর্তাব্যক্তিরা ছুটে যান সুন্দরবনে। পরিবেশবাদী আর বিশেষজ্ঞরা পানিতে তেল ছড়িয়ে পড়ার কারণে সুন্দরবনের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির আশঙ্কার কথা বললেও সরকারের দাবি, কোনো ক্ষতি হবে না।
বাস্তবতা হলো, ডুবে যাওয়া ট্যাংকারটির প্রায় সব তেল বেরিয়ে সুন্দরবনের শ্যালা নদীর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। পানিতে ভেসে থাকা এই জ্বালানি তেল অপসারণ বা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থাও বন বিভাগের নেই। ফলে দেখা গেছে, স্থানীয় মানুষজন ফোম দিয়ে ওই তেল তোলার চেষ্টা করেন এবং সরকার তা কিনে নেয়। কিন্তু এতে খুব বেশি তেল অপসারণ করা সম্ভব হয়নি।
তেল দূষণের কারণে মৃগমারী-নন্দবালা-আন্ধারমানিক ডলফিন অভয়াশ্রম মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ে।
দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দেশের নৌ-বাণিজ্য যোগাযোগ পথ ও ভারত-বাংলাদেশ নৌ-প্রটোকল রুট হিসেবে ব্যবহৃত ঘষিয়াখালী চ্যানেল ভরাট হয়ে যাওয়ায় ২০১১ সাল থেকে এটি বন্ধ। ফলে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বিকল্প পথ ব্যবহার করছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। যদিও পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকির কারণে অনেক দিন ধরেই সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌপথ বন্ধের দাবি জানানো হচ্ছে। বিশেষ করে শ্যালা নদীতে তেলের ট্যাংকারডুবির ঘটনায় জাতিসংঘের একটি বিশেষজ্ঞ দল গত বছরের ২২ ডিসেম্বর সুন্দরবন পরিদর্শন করে। ২৫ সদস্যের দেশি-বিদেশি ওই বিশেষজ্ঞ দল তাদের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে নৌযান চলাচল বন্ধের সুপারিশ করে। কিন্তু ২৮ দিন বন্ধ থাকার পর ৭ জানুয়ারি থেকে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে দিনের আলোয় শ্যালা নদীপথে নৌযান চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার। সার ও কয়লাবোঝাই জাহাজডুবির পরও তদন্ত কমিটি সুন্দরবনের নদীতে ইঞ্জিনচালিত নৌযান বন্ধের সুপারিশ করে। এ বিষয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মাহমুদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, সুন্দরবনের নদীপথে তেল, সার, কয়লাসহ যেকোনো ধরনের পণ্যবাহী নৌযান চলাচল সুন্দরবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে প্রতিনিয়তই। ফলে নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা আমাদের গর্বের ধন সুন্দরবন ঝুঁকির মুখে ফেলব কি না, সে প্রশ্নটিই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করলে এমনিতেই পরিবেশ দূষিত হয়। তার পরও বিশ্বে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় সবচেয়ে বেশি। কয়লাদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব মেনে নিয়েই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী চালু রয়েছে। কিন্তু বাগেরহাটের রামপালে ভারতের সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্বে যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেটি নিয়ে বিতর্কের একমাত্র কারণ সুন্দরবন। দেশের অন্য কোথাও এই বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির সিদ্ধান্ত নিলে এ বিতর্ক উঠত না।
কেননা, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল, ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য, তেলসহ কঠিন ও তরল বর্জ্য নিঃসরণ, শব্দদূষণ, আলোদূষণ ইত্যাদি সুন্দরবনের প্রাণীদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে অতিরিক্ত নৌযান চলাচলের ফলে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম, বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, ডলফিন, গরান বন ইত্যাদির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
রামপালে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পক্ষে সরকারের যুক্তি হলো, নদীপথে কয়লা পরিবহনে সুবিধা। বাস্তবতা হলো, কয়লা পরিবহনের সবচেয়ে সহজ মাধ্যম ট্রেন। সুতরাং ট্রেনে ভারত থেকে কয়লা এনে উত্তরবঙ্গের কোথাও এই প্রকল্প করা যেত বলে অনেকে মনে করেন।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধের দাবিতে বহুদিন ধরেই লংমার্চ, সমাবেশ, মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি হচ্ছে। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিও এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান জানিয়েছে। কিন্তু সরকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে অনড়। এর একটি বড় কারণ হয়তো এই যে, এটি বাংলাদেশ সরকারের একক কোনো প্রকল্প নয়; বরং এটি বাস্তবায়িত হচ্ছে ভারতের সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। ফলে এখন প্রধানত বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক দল এবং পরিবেশবাদী সংগঠন রামপাল প্রকল্পের বিরোধিতা করলেও আখেরে এটি যে বাস্তবায়িত হবেই, তা মোটামুটি নিশ্চিত।
গত ১০ মাসে সুন্দরবনের নদীতে তিনটি জাহাজ ডুবেছে। এর পরও সেখানে ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল বন্ধ হয়নি। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর পর প্রতিদিন শ্যালা নদী দিয়ে ৮০ হাজার টন কয়লা পরিবহন করা হবে। তখন দুর্ঘটনার আশঙ্কা আরো বাড়বে। তাই এখন প্রশ্ন হলো, আর কতটি জাহাজ ওখানে ডুবলে সরকারের মনে হবে যে, সুন্দরবনের কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত সঠিক নয়?
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক ও উপস্থাপক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।