আইএস নেই, জঙ্গি আছে
ঢাকায় আবার পুলিশের ওপর বোমা হামলা হয়েছে। গত শনিবার রাতে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে পুলিশের ওপর হামলা হয়। এবং আগের তিনটি হামলার মতো এই হামলারও দায় নিল আইএস। হামলার কিছুক্ষণ পরই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম নজরদারি সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্সের এক টুইট বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়। একই সময়ে আত তামকীন মিডিয়া নামে এক প্রতিষ্ঠান থেকে একটি টুইট বাংলায় লিখে আইইডি বিস্ফোরণের দায় স্বীকার করা হয়।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বিজিবির এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। সে সময় তাঁর নিরাপত্তার জন্য পুলিশের ছয় সদস্যের একটি দল ছিল। মন্ত্রীর গাড়ি ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে থাকায় পুলিশ সদস্যরা নিরাপত্তা দলের গাড়ি থেকে নেমে যখন ট্রাফিক কনস্টেবলের দিকে যাচ্ছিলেন, তখন বোমাটি বিস্ফোরিত হয়।
পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলাই হচ্ছে, বাংলাদেশে আইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই। তাই এ দাবি ভিত্তিহীন।
এর আগে গুলিস্তানে, মালিবাগে, খামারবাড়িতে একই ধরনের হামলা হয়েছে পুলিশের ওপর। একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন পুলিশকেই টার্গেট করা হচ্ছে? একটা উত্তর এই যে, পুলিশই হলি আর্টিজান ক্যাফে হামলার পর জঙ্গি খতমে বড় ভূমিকা রেখেছে। আবার এটাও হতে পারে যে বড় ধরনের হামলার আগে পুলিশ সদস্যদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার প্রচেষ্টা এসব হামলা। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, ‘এরা ছোটখাটো ঘটনা দিয়ে টেস্ট কেস হিসেবে বড় ধরনের হামলার ঘটনা ঘটাতে পারে।’ অবশ্য পুলিশ সেটা মনে করছে না।
তবে আইএসের দায় স্বীকার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বাংলাদেশে আইএস আছে কি নেই, এমন বিতর্ক এর আগেও আমরা দেখেছি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, জঙ্গিরা আছে। তারা একের পর লেখক-ব্লগার হত্যা করেছে, হলি আর্টিজানের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে ২০১৬-এর গুলশান ক্যাফে হামলার পর থেকে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গি দমনে বড় সাফল্য দেখিয়েছে এবং জঙ্গি মোকাবিলায় আমাদের বাহিনীগুলোর সক্ষমতাও বেড়েছে।
জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। তবে স্থানীয় ব্যক্তি, গোষ্ঠীর মদদ ছাড়া এরা বেড়ে উঠতে পারে না। জঙ্গিবাদ স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠলেও আন্তর্জাতিক অর্থায়ন সহজলভ্য হওয়ায় এগুলোর বিস্তার ঘটছে দ্রুত। আবার আঞ্চলিক পরিস্থিতিও জঙ্গিবাদের ক্ষেত্র তৈরি করে। দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতিও বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের নতুন করে নড়াচড়ায় অবদান রাখছে কি না, তা খতিয়ে দেখার ব্যাপার আছে।
আইএস আছে কি নেই, এ বিতর্কের শেষ নেই। শেষ নেই জঙ্গিদের পদচারণাও। পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একের পর এক সাফল্য দেখাচ্ছে। কিন্তু সাম্প্রতিক এই হামলাগুলো বলছে স্বস্তির জায়গা নেই। এমন সব ঘটনায় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করা নিশ্চয়ই সরকারের কাজ। কিন্তু এমন বিশাল জনসংখ্যার দেশে আনাচে-কানাচে সন্ত্রাসবাদীরা কবে কোথায় হানা দেবে, তা অনুমান করে আগাম প্রতিষেধক ব্যবস্থা গ্রহণও প্রায় দুঃসাধ্য।
আইএস একটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন। তার উপস্থিতির পরিণতি ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করে। তার সরাসরি উপস্থিতি এখানে আছে, সেটা আমরা মনে করি না। তবে আইএস মতাদর্শের রাজনৈতিক শক্তি এ দেশে আছে, যাদের দীর্ঘ সময়ের রাজনীতি আছে। একসময় ছিল জেএমবি, হরকাতুল জিহাদের মতো ভয়ানক জঙ্গিগোষ্ঠী। এর পর নাম শোনা গেল নব্য জেএমবির কথা।
সিনিয়র পুলিশ কর্তারা বলছেন, জঙ্গিবাদ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে তাঁদের। এবং কাজটা কঠিন। জঙ্গিদের কাছে তাদের কাজটা কোনো পেশা নয়। আখিরাতে জান্নাতে যাওয়ার অঙ্গীকার। তারা যেসব নেতার নির্দেশে কাজ সম্পাদন করে, সেখানে কোনো দলের বা গ্রুপের মতো নাম-ঠিকানা রাখে না।
সন্ত্রাস ও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান চায় মানুষ। কোনো ছাড় চায় না। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে, হয়তো বলতে পারে না যে শুধু মাঠে-ময়দানে পুলিশের তৎপরতা নয়, শাসক দল আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে সমস্যা মোকাবিলায় দলীয় কর্মসূচি ঠিক করতে হবে।
উদার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অনেকের মনেই সনাতনী ক্ষোভ কাজ করে। সাম্প্রতিককালে তা আরো বাড়ছে। বাংলাদেশের সমাজে ধর্মের সহাবস্থান যেমন অনেক দিনের, তেমনি বিরোধও বহু দিনের। একটি গোষ্ঠী ঐতিহাসিকভাবেই উদারতাবিরোধী। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের বাড়বাড়ন্তে তারা আরো আস্কারা পাচ্ছে। কিন্তু বেশি পায় যখন শাসক দল দুর্বল থাকে, শাসক দলের নেতাকর্মীরা রাজনীতি ছেড়ে অভ্যন্তরীণ কলহে লিপ্ত থাকে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দল ও সংগঠনের বৃহত্তর ঐক্যের যেমন খুব বেশি প্রয়োজন, তেমনি দরকার মানুষের জাগরণ। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে অগ্রসর হতে হবে। কিন্তু সরকারের একার পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। মানুষকে সঙ্গে রাখতে না পারলে শুধু পুলিশি ব্যবস্থা দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না, নৈরাজ্যকে আরো উসকে দেওয়া হবে সেই ভাবনা ভাবতে হবে। আশঙ্কা অনেক, কারণ ক্ষমতাসীন দল এখন সাংগঠনিক কাজের চেয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত বেশি।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা।