তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে
একটি সমাবেশই যে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে, সে কথা গত সপ্তাহেই লিখেছি। ‘চমকে দেওয়া রোহিঙ্গা সমাবেশ’ শিরোনামের লেখায় সমাবেশের লাভক্ষতির হিসাব কষেছিলাম। তখন পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল, বাংলাদেশ সরকার সমাবেশের বিষয়টি জানে; মিয়ানমার, চীন, ভারতকে রোহিঙ্গাদের শক্তিটা দেখাতে বাংলাদেশ সরকারই রোহিঙ্গা সমাবেশের ব্যাপারে নিষ্পৃহ থেকে আয়োজন করতে দিয়েছে।
আমার ধারণা ছিল, সমাবেশের ব্যাপারে জানলেও কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ বিষয়টি না জানার ভান করেছে। কিন্তু লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করছি, আমার ধারণা ভুল। সরকারের দক্ষতা এবং কূটনৈতিক কৌশল নিয়ে আমি অনেক উচ্চ ধারণা পোষণ করেছিলাম। আমার বিবেচনায় তারা ওভাররেটেড ছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, তিনি রোহিঙ্গা সমাবেশের কথা কিছু জানেন না, আমি সেটা ঘুণাক্ষরেও বিশ্বাস করিনি। আমি ভেবেছি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেনেও ডিপ্লোম্যাটিক কারণে অসত্য কথা বলছেন। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে সত্যিই জানেন না, তার এই স্বীকারোক্তিতে যে শিশুসুলভ সারল্য ছিল, তা আমার ভালো লেগেছে।
সমাবেশের পর সরকারের নানা তৎপরতায় স্পষ্ট যে তারা আসলেই কিছু জানত না। এটা আসলেই অবিশ্বাস্য। কারণ রোহিঙ্গা ঢলের দুই বছর পূর্তিতে রোহিঙ্গা মহাসমাবেশ করেছে, তা সুপরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল। তাদের সবাই একই রকমের নতুন পোশাক পরে সমাবেশে এসেছে। আগের লেখায়ও লিখেছি, সমাবেশে কোথেকে কত মানুষ আসবে, মঞ্চ কেমন হবে, স্লোগান কী হবে; সবই আগেই ঠিক করা। এমন একটি সমাবেশের জন্য লম্বা সময়ের প্রস্তুতি লাগে। সেখানে কাজ করা এনজিওগুলো আগে থেকেই সমাবেশের কথা জানত, এমনকি সমাবেশ আয়োজনেও তাদের সহায়তা আছে। জানত সাংবাদিকরাও। তাই তো অনেক টিভি চ্যানেল সেই টেকনাফ থেকে রোহিঙ্গাদের সমাবেশ সরাসরি সম্প্রচার করতে পেরেছে। জানত না শুধু সরকার। এটা ভয়ঙ্কর। প্রায় ১২ লাখ নির্যাতিত রোহিঙ্গা বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী ক্যাম্পে আছে, কিন্তু সরকার তাদের তৎপরতা সম্পর্কে কিছুই জানছে না, এটা আসলেই বিপজ্জনক। টেকনাফ-উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পের দায়িত্বে যারা ছিল, তারা যদি সমাবেশের কথা জেনেও সরকারের নীতিনির্ধারকদের না জানিয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই তারা দায়িত্বে অবহেলা করেছে বা এত বড় দায়িত্ব পালনের মতো যোগ্য তারা নয়। আর যদি তারাও সমাবেশের খবর না জেনে থাকে, তাহলে সেটা আরো বড় অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে। দেরিতে হলেও সরকার এটা বুঝতে পেরেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যেই বদলি করা হয়েছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালামকে। সরকার বলছে, এটি রুটিন বদলি। তবে তাকে ওএসডি করা হয়েছে। তার মানে এটি রুটিন বদলি নয়, শাস্তিমূলক বদলি। শুধু আবুল কালাম নন, আরো ৬ জন ক্যাম্প ইনচার্জকেও বদলি করা হয়েছে। সরকার যতই বলুক, রোহিঙ্গা সমাবেশের পরপর এই বদলিগুলোকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক বদলি বলা যাবে না। তারা সমাবেশের খবর না রেখে বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে অদক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। তাই কিছুটা হলেও শাস্তি তাদের পেতেই হবে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট যে সংকটের শুরু, দুই বছর যেন সে সংকটকে আমরা সংকটই মনে করিনি। সেখানে কী হচ্ছে, রোহিঙ্গারা কী করছে, রোহিঙ্গাদের নিয়ে দেশি-বিদেশি এনজিওগুলো কী করছে; কিছু নিয়েই যেন এত দিন আমাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। রোহিঙ্গাদের সমাবেশ যেন আমাদের সরকারের চোখ খুলে দিয়েছে। এখন অনেক প্রশ্ন, অনেক কৌতূহল। রোহিঙ্গাদের নেতা মুহিবউল্লাহ কীভাবে হোয়াইট হাউস পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন? তিনি পাসপোর্ট পেলেন কীভাবে? কেউ বলছেন, মুহিবউল্লাহ ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে, মুহিবউল্লাহর যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়েও ওয়াকিবহাল নয় সরকার। এখন জানা যাচ্ছে, দেশি-বিদেশি বেশ কয়েকটি এনজিও সরকারের স্বার্থবিরোধী কাজ করছে। রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানমারে ফিরে না যায়, সে ব্যাপারে এনজিওগুলো তাদের বোঝাচ্ছে। একটি এনজিওর বিরুদ্ধে তো রোহিঙ্গাদের মধ্যে ধারালো অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ রয়েছে। এমন নানা অভিযোগে বেশ কয়েকটি এনজিওর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এই এনাজিওগুলো তো এবার সেখানে তাদের কার্যক্রম শুরু করেনি; দুই বছর ধরেই তো তারা কাজ করছে। এত দিন সরকার তাদের কিছু বলেনি কেন? ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্তত ছয় লাখের হাতে মোবাইল ফোন রয়েছে, অনেকের হাতে আছে আধুনিক স্মার্ট ফোন। তাদের আছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমোসহ যোগাযোগের আধুনিক সব ব্যবস্থা। আছে নানান গ্রুপ। যেকোনো সিদ্ধান্ত মুহূর্তেই জেনে যায় সবাই। আছে তাদের নিজস্ব টিভি, যেখানে রোহিঙ্গা ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়। রোহিঙ্গাদের নিছক ক্যাম্পে থাকা শরণার্থী ভাবলে ভুল করবেন। তাদের অনেকে মাদক ব্যবসা করে কোটিপতি বনে গেছে। যারা মাদক ব্যবসা করে না, তারাও ক্যাম্পে দোকান বসিয়ে জম্পেশ ব্যবসা করছে। অনেকের পেশা ডাকাতি। কদিন আগে এক যুবলীগ নেতাকে হত্যার ঘটনায় অন্তত তিন রোহিঙ্গা ডাকাতকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন নুর আলম। ৯২ সালে বাংলাদেশে আসা নুর আলমের একটি বাগানবাড়িসহ মোট চারটি বাড়ি আছে, আছে স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র। কীভাবে এসব সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? নুর আলমের মেয়ের কান ফোড়ানোর অনুষ্ঠানে এক কেজি (ঠিকই পড়েছেন, এক কেজি) স্বর্ণালংকার এবং ৪৫ লাখ টাকা উপহার পেয়েছেন। নুর আলম নিশ্চয়ই একদিনে এত বড় ডাকাত হননি। তাহলে প্রশ্ন হলো, এত দিন সরকার এদের থামায়নি কেন? রোহিঙ্গারা মোবাইল সিম পেল কোত্থেকে, তাদের ব্যবসা করার অনুমতি দিল কে, তারা একেকজন ডাকাত হয়ে উঠল কীভাবে? এত দিন এই প্রশ্নের কোনো উত্তর ছিল না। আসলে এত দিন এই প্রশ্নগুলোই ওঠেনি। কারণ বাংলাদেশের নজরই ছিল না রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দিকে। ২৫ আগস্টের সমাবেশের পর সরকার নড়েচড়ে বসেছে। এখন রোহিঙ্গাদের মোবাইল ফোনসেবা বন্ধ করা হচ্ছে, ইন্টারনেট সুবিধা সীমিত করা হচ্ছে, এনজিওদের কার্যক্রম নজরদারি করা হচ্ছে। এই নজরদারিটা আরো আগে থেকেই করা উচিত ছিল। করলে রোহিঙ্গারা এমন বিপজ্জনক হরয়ে উঠতে পারত না। প্রায় ১২ লাখ মানুষকে বছরের পর বছর ক্যাম্পে আটকে রাখাটা অবশ্যই বিপজ্জনক। এই বিপদ থেকে বাঁচতে কঠোর নজরদারি করতে হবে। রোহিঙ্গারা যাতে বেআইনি কিছু করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।