ভারত
বিহারে বিজেপির ভরাডুবি হলো কেন?

ভারতের বিহারে সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নীতিশ কুমারের হেট্রিক জয়ে অতি আত্মবিশ্বাসী মৌলবাদী রাজনীতি চর্চাকারী বিজেপি ওয়ালাদের এখন মাথায় হাত। বিপুল ভোটে বিজয়ী আঠার মাস বয়সী বিজেপি সরকারের হিন্দুত্ববাদী উগ্র সাম্প্রদায়িকতার মেরুকরণ যে, নেতিবাচক হিসেবে বিহারেই বুমেরাং হবে তা বোধহয় ঘূণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি মোদি বা অমিত শাহরা।
জোটবদ্ধ নির্বাচনে ২৪৩টি আসনের মধ্যে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের জেডিইউ ৭১টি, লালু প্রসাদ যাদবের আরজেডি ৮০টি এবং কংগ্রেস ২৭টি আসন পেয়েছে। বাকি আসন বিজেপিসহ অন্যদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছে। বিহারের এই ভরাডুবিতে মারাত্মক প্রশ্নের মুখে পড়েছে মোদি, অমিত ও অরুণ জেটলির ত্রিধারা রণকৌশল। ইতিমধ্যে বিজেপির অভ্যন্তরেই কাটাছেড়া শুরু হয়েছে, বর্তমান সরকারের দেড় বছরের মাথায় জনমনে কী এমন অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে যে, যার কারণে পুরো জনসমর্থন সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে বিজয়ী মোদির জাদু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল!
মৌলবাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ, বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা শিবসেনার মতো অতি সাম্প্রদায়িক দল পরিবেষ্টিত বিজেপির বোধোদয় না হলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবি ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদিতাই মোদির জন্য কাল হচ্ছে।
মোদীপন্থীরা এখন যদিও অহঙ্কারের সাথে বলে যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তায় হয়তো এখনো ভাটা পড়েনি। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের আগের সেই গুজরাটি ম্যাজিক্যাল অস্ত্রটি যে ভোঁতা হয়ে গেছে বিহারের গো-হারই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
সাম্প্রতিককালে গরু নিয়ে সংঘ পরিবার যে নোংরা রাজনীতি শুরু করেছে, তার জেরে দাদরির মুসলমান হত্যাকাণ্ড প্রগতিশীলদের চেতনার বারুদ উসকে দিয়েছে। দেশজুড়ে দেদার চলছে প্রকাশ্যে গরু খাওয়া উৎসব। মোদির দলের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে অব্যাহত ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদে গুণী শিল্পী-সাহিত্যিকরা তাঁদের দেওয়া সরকারের সব পদক বা সম্মাননা ফিরিয়ে দিচ্ছেন।
তারপরও বিহার নির্বাচনে উগ্র হিন্দুত্ববাদী প্রচারণা থেকে সরে আসেনি বিজেপি। মুসলমানরা যতই দাবি করুন, আমরা কী খাব না খাব, তা অন্যরা নির্ধারণ করে দিতে পারে না। কিন্তু সংঘ পরিবার তাদের মৌলবাদী নিষ্পেষণ বন্ধ করবার প্রয়োজনবোধ করেনি। ফলে বিহারের মুসলিমদের ১৬.৯ ভাগ ভোট অবধারিতভাবেই নীতিশ কুমার জোটের ভাগে পড়েছে।
অন্যদিকে সম্প্রতি ফরিদাবাদে দুই দলিত শিশুকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী ভিকে সিংহ বলেছিলেন, কুকুরের দিকে পাথর ছুঁড়ে মারলে সরকারের দায় থাকে না। এই মন্তব্যের প্রভাব সরাসরি ব্যালটে পড়েছে। পুরো দলিত-ভোট বিজেপির বিরুদ্ধেই গেছে।
নরেন্দ্র মোদির সরকার যেখানে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়েছিল, সেখানে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানো ছাড়া তারা আর কিছু মানুষকে দেখাতে পারেনি, যা সাধারণ জনগণকে প্রলুব্ধ করতে পারে।
অপরদিকে নীতিশ কুমারের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে রাজ্যে শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ছাত্রীদের। পাশাপাশি নারী শক্তিকে আরো পোক্ত করার ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা প্রশংসনীয় বলে দাবি করছেন খোদ নারীরাই। পুলিশে চাকরির পাশাপাশি নানা ক্ষেত্রে মহিলাদের কাজের সুযোগ বেড়েছে ব্যাপকহারে। এমনকি, নির্বাচনে জিতলে মহিলাদের জন্য সরকারি চাকরিতে ৩৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের কথাও ঘোষণা করে রেখেছেন আগে থেকে। ছাত্রীরা সাইকেল পেয়েছে। দেওয়া হয়েছে বই। সঙ্গে পোশাক কেনার টাকা। স্কুলগুলোতে নতুন করে শিক্ষকও নেওয়া হয়েছে।
এমন উন্নয়নের বিপরীতে অধিকতর উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি না দিয়ে বিজেপি হেঁটেছে কি না ধর্মীয় মেরুকরণ আর সামাজিক জাত-পাতের সেই পুরোনো বিভাজনের খেলায়। এর ফলও মিলল হাতেনাতে।
সর্বভারতীয় মনোভাবে যে ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে পরস্পরের প্রতি সহনশীলতার চেতনাটিই জাগ্রত রয়েছে বিহার নির্বাচন তার বড় উদাহরণ হয়ে উঠল।
এখনই সংঘ পরিবারের হিন্দুত্ববাদী উগ্রবাদিতার বলয় থেকে বেরিয়ে এসে উন্নয়নের পথ না ধরলে মোদি তথা বিজেপির ভাগ্যে যে বিপর্যয় আসছে তা বলবার অপেক্ষা রাখে না।
কারণ মৌলবাদের বিষ আজন্মই বয়ে বেড়াচ্ছে বিজেপি। এই উত্তরাধুনিক যুগে প্রাগৈতিহাসিক পুরোনো ধ্যান-ধারণা আর ধর্মান্ধতার উন্মাদনা দিয়ে মানুষকে বশ করার দিন ফুরিয়েছে।
১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পর রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ তাদের গঠনতন্ত্রে প্রতিশ্রুতি দিয়ে লিখেছিল যে, তারা কখনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবে না। সেই সময় আরএসএসের সহিংস কাজের ধরন গান্ধীর নিহত হওয়ার বাস্তবতা তৈরি করেছিল, ফলে দলটি তখন নিষিদ্ধ হয়েছিল। তারা বলেছিল সম্পূর্ণ রাজনীতি থেকে শতহস্ত দূরে থেকে সম্পূর্ণভাবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত থাকবে তারা। অথচ বর্তমান প্রেক্ষাপট বিচারে দেখা যায় নরেন্দ্র মোদির সব শলা-পরামর্শের প্রধান আশ্রয় প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করা এই আরএসএস।
ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত দীর্ঘদিনের। চারবার যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া এই দুই দেশের মধ্যে সেই বিরোধ জিইয়ে রাখতে সংস্কৃতি বা খেলাধুলার অঙ্গনেও বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে এই সংঘ পরিবারের হিন্দু মৌলবাদীরা। আর এই পরিবারের ছত্রছায়ায় অন্তত ৩৭টি উগ্র সাম্প্রদায়িক দল মানবীয় সহিষ্ণুতার মূলে কুঠারাঘাত চালিয়ে যাচ্ছে।
এরই ধারাবাহিকতায় বিহারের ভোট শেষ হওয়ার দিন কয়েক আগে ভোটের প্রচারে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ বলেছিলেন, বিহারে বিজেপি হারলে বাজি ফাটবে পাকিস্তানে। কিন্তু অমিত শাহরা বোঝেন না, সাধারণ মানুষ এখন ধর্ম বা দেশ বিদ্বেষের ঘোল আর খায় না।
কংগ্রেস সরকারের দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, নীতি নির্ধারণে বন্ধ্যাত্বের মুখে গগনচুম্বী প্রত্যাশা নিয়ে মোদি ক্ষমতার মসনদে বসেছিলেন। আর এখন শুধু হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক নীতির প্রাধান্য দেওয়ার ফলে বিহারে দলের বিপর্যয়ে বিজেপিতে অপেক্ষাকৃত উদারপন্থী সুষমা স্বরাজ, রাজনাথ সিংহ, নিতিন গড়কড়ীর চাপের মুখে ত্রিরত্ন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ কিংবা অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির অবস্থা নড়বড়ে।
সংঘ পরিবারের উগ্র হিন্দুত্ববাদিতার সর্বশেষ বলি ভারতীয় ফিল্মের সুপার স্টার শাহরুখ খান। ২ নভেম্বর সোমবার নিজের ৫০তম জন্মদিনে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নিয়ে শাহরুখ খান নিজের ক্ষোভ ঝেড়েছিলেন এভাবে ‘দেশে চরম অসহিষ্ণুতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আমরা আর কদিনের মধ্যে অন্ধকার যুগে ফিরে যাব। অসহিষ্ণু হওয়াটা অত্যন্ত নির্বোধের কাজ। আমাদের মতো দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা দেখাতে না পারার চেয়ে জঘন্য অপরাধ আর নেই।’
এই কথার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই শাহরুখকে বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়ে পাকিস্তানের এজেন্ট বানিয়ে দিলেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেত্রী সাধ্বী প্রাচী। আর বিজেপি নেতারা প্রাচীর সুরে তাল মিলিয়ে সমস্বরে ঘোষণা করে দিলেন শাহরুখ খান দেশদ্রোহী।
ক্ষমতায় আরোহণের বছর খানেকের মাথায় নয়াদিল্লির মহাধাক্কা ও দেড় বছরের মাথায় বিহারের নির্বাচনে এমন ধরাশায়ী অবস্থার পরও উগ্র হিন্দুত্বের অবস্থান থেকে যদি বিজেপি সরে না আসে, নরেন্দ্র মোদি যদি এখনো তাঁর গা বাঁচিয়ে সম্মতির লক্ষণ হিসেবে মৌনব্রত পালন করেই যান, উন্নয়নের কৌশল ছেড়ে হিন্দু পরিষদ বা সংঘ পরিবারের মন জোগাতে ধর্মীয় বিষধর সর্পের ফ্যাংকে সংখ্যালঘুগোষ্ঠীর নিধনে ব্যাপৃত রাখেন, জাত-পাতের বিভাজনকে জিইয়ে রেখে ভোটের অঙ্ক কষেন, তবে বিজেপির বৃহস্পতি মরে গিয়ে নিশ্চিতার্থে শনি গ্রহেই পর্যবসিত হতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা এমনটাই।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন