প্রতিক্রিয়া
নূর হোসেন দেশে : এবার আসল সত্য আলোর মুখ দেখুক
নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ফেরত পেল বাংলাদেশ। নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনার ঘটনায় দেশের কতটুকু লাভক্ষতি হলো, তা বিচার করবে ভবিষ্যতের ইতিহাস।
বড় মাপের এই খুনিকে দেশের বিচারালয়ের আওতায় আনার মধ্য দিয়ে হয়তো সাত খুন মামলার অনেক অজানা রহস্যেরই দ্বার উদঘাটিত হবে। দৃশ্যমান ঘটনার পেছনের গোপন পরিকল্পনার আসল সত্যটাও আলোর মুখ দেখবে।
নূর হোসেনকে দেশে ফেরত আনায় নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম সন্তোষ প্রকাশ করে মিডিয়ায় এরই মধ্যে বলে দিয়েছেন, নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক। এই হত্যাকাণ্ডে তাঁর সঙ্গে আর কারা জড়িত, পরিকল্পনাকারী কারা, তা বের করা হোক। তাঁর স্বামীর সঙ্গে র্যাবের কোনো বিরোধ ছিল না। তাই নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী কারা, তা বের করা হোক। কারণ, মামলার অভিযোগপত্রে পরিকল্পনাকারী কে, তা আসেনি।
গত বছরের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে দুটি গাড়িতে থাকা প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়। তিন দিন পর অপহৃত ব্যক্তিদের লাশ ভেসে ওঠে নারায়ণগঞ্জের উপকণ্ঠে শীতলক্ষ্যা নদীতে। এ ঘটনায় সারা দেশে হৈচৈ পড়ে যায়। কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম সে সময় র্যাবের বিরুদ্ধে ‘ছয় কোটি টাকা নিয়ে’ অপহরণ ও হত্যার অভিযোগ করেন। অর্থায়নকারী হিসেবে তিনি নূর হোসেনকে অভিযুক্ত করেন। পরে তদন্তে এ ঘটনার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জে র্যাব-১১-এর কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা বের হয়ে আসে। র্যাব-১১-এর তৎকালীন অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার এম এম রানাসহ অন্য সদস্যরা মিলে ওই সাতজনকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেন বলে তদন্তে বেরিয়ে আসে। প্রায় এক বছর তদন্তের পর গত এপ্রিলে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। এতে র্যাবের ওই তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। নূর হোসেন হলেন অভিযোগপত্রভুক্ত ১ নম্বর আসামি।
ওই ন্যক্কারজনক খুনের ১ নম্বর আসামি নূর হোসেন এতদিন ভারতের দমদম জেলে বন্দি থাকায় মামলার কার্যক্রম এক জায়গায় এসে স্থিতিশীল অবস্থায় ছিল। এখন তাঁকে বাংলাদেশ ফেরত পাওয়ায় নূর হোসেনকে যথার্থ অর্থে রিমান্ডে নিলে মামলার গতি নতুন মোড় নিতে পারে। ওই খুনের ঘটনার পর নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের এমপি শামীম ওসমানের পরামর্শ বা প্ররোচনায় নূর হোসেন ভারতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় বলে অভিযোগ ওঠে। সে সময় নূর হোসেন ও শামীম ওসমানের টেলিফোন কথোপকথন মিডিয়ায় ফাঁস হলে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পরে নিজের গা বাঁচাতে শামীম ওসমান সংবাদ সম্মেলন করে মোবাইল রেকর্ড ফাঁস বা নূর হোসেনকে না ধরার ক্ষেত্রে র্যাবের এডিজি কর্নেল জিয়াউল আহসানকে দায়ী করে সংবাদ সম্মেলন করেন। শামীম ওসমান বলেছিলেন, ‘র্যাবের এডিজিও বলেছেন, ও ইন্ডিয়ায় আছে। তো, আমি উনার কথা বিশ্বাস করব, কারণ উনারা তো আমার কথা ছেড়ে দেন রেকর্ড করে, ওনাদের কাছে আধুনিক যন্ত্রপাতি আছে। আমার কথা হচ্ছে, এই আধুনিক লোকগুলো আমি দেখলাম চ্যানেলে তাঁরা বলছেন, নূর হোসেন যখন আমাকে ফোন করেছে, তখন সে গুলশানে ছিল। ঘটনার আগের দিন ছিল ধানমণ্ডিতে, তারা তাকে কেন ধরল না?’
কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নূর হোসেনের ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে শামীম ওসমান বা র্যাবের বড় পোস্ট এডিজি সমমর্যাদার কর্মকর্তার নাম জড়িয়ে গেল, তা জানার ঔৎসুক্য এ জাতির থাকবে বা আছেই। এ ছাড়া সে সময় এই খুনের ঘটনার সঙ্গে সবকার দলীয় প্রভাবশালী একজন মন্ত্রীর সম্পৃক্ততা থাকার অভিযোগ ওঠে। যদিও তিনি তা বারবার অস্বীকার করে গেছেন। অভিযোগপত্রেও সেসবের বালাই নেই। এখন নূর হোসেন দেশে আসায় সব চাপ উপেক্ষা করে ওই ব্যাপারটিতে নতুন তথ্য বের করার দায় কি কেউ নেবেন?
খুনের ঘটনার পর কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম নূর হোসেনের অর্থায়নে র্যাবের বিরুদ্ধে ‘ছয় কোটি টাকা নিয়ে’ অপহরণ ও হত্যার অভিযোগ করেছিলেন। ১৯৯২ সালে বিএনপি এবং ১৯৯৬ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় থাকা একসময়ের ট্রাকচালকের সহকারী হিসেবে জীবন শুরু করা এই নূর হোসেন ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে র্যাব কর্মকর্তাদের সহায়তায় অর্ধডজনের বেশি মানুষ একসঙ্গে খুন করার দুঃসাহসী হবে, এমনটা নাও হতে পারে। এর পেছনের কারিগর হিসেবে শক্ত বুকের পাটাওয়ালা কারো পরিকল্পনা থাকবে না, ঝানু অপরাধবিজ্ঞানীরাও কি এমনটা ভাবতে পারবেন?
নূর হোসেনকে বিজিবির মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার পর তিনি নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপারের তত্ত্বাবধানে থাকলেও র্যাবের সদস্যরাও তাকে নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা ভালো, তবে ভাবনারও। আমরা আশা করছি, সহসা কোনো নিশুত রাতে নূর হোসেনকে নিয়ে গিয়ে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে কোনো ধরনের অস্ত্র উদ্ধার বা বন্দুকযুদ্ধে অংশ নিতে যাবে না র্যাব। সে যত মারাত্মক অস্ত্রেরই জোয়ার বয়ে যাক না কেন শীতলক্ষ্যা পাড়ে।
যথার্থ বিচার সম্পাদনের মাধ্যমেই কেবল নূর হোসেন গংয়ের হাতে নিঃশেষে প্রাণ দেওয়া নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকার বা সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাতজন মানুষের আত্মা শান্তি পেতে পারে। শীতলক্ষ্যা নদীর কলঙ্কমোচন হতে পারে। তার আগে রাগ বা বিরাগের বশবর্তী ছাড়া নূর হোসেনের মগজ বা হৃদয়ে সযত্নে রাখা আসল সত্য আলোর মুখ দেখুক। সব ধরনের চাতুর্যতা পরিহার করে প্রকৃত অপরাধী বা পরিকল্পনাকারীর মুখোশ উন্মোচনের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হোক। আমাদের চাওয়ার এই অধিকার পূরণ করার দায়িত্ব প্রিয় রাষ্ট্রেরই।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।