সোজা কথা
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও পরবর্তী করণীয়
চুয়াল্লিশ বছরের দীর্ঘশ্বাস, চাপা কান্না। স্বজন হারানোর বেদনায় ভারাক্রান্ত কতশত পরিবার। চোখের সামনে স্বজনদের খুনিদের বীরদর্পে ঘুরে বেড়াতে দেখা এক দুঃসহ যন্ত্রণারই আরেক নাম। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে কতজন না-ফেরার দেশে চলে গেছে। যাঁরা বেঁচে ছিলেন, আশার পিদিম মিটিমিটি করে জ্বলেছে, আর কি কখনো হবে খুনিদের সাজা? হয়েছে, এই বাংলার মাটিতেই এ দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে বিরোধিতাকারীদের সাজা হয়েছে। পাকিস্তানের দোসর, নিজের দেশের মানুষের হত্যাকারী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি হয়েছে। বিচারের সব ধাপ পেরিয়ে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও যখন শুধু ফাঁসি কার্যকরের প্রহর গোনার অপেক্ষা, তখনো সাধারণ মানুষের মনে সন্দেহ যায় না। এমন দাপুটে দুই অহংকারীর ফাঁসি কি কার্যকর হবে? আওয়ামী লীগ সরকার কি পারবে এই ফাঁসি কার্যকর করতে? দেশি-বিদেশি চাপ সহ্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি পারবেন দাম্ভিক সাকা ও মুজাহিদকে ফাঁসিতে ঝোলাতে? তিনি পেরেছেন, সব হুমকি-ধমককে তোয়াক্কা না করে, আবেগের বশবর্তী না হয়ে সব আইনের ধারা মেনেই তিনি সবচেয়ে প্রভাবশালী দুই যুদ্ধাপরাধীকে সাজা দিয়েছেন। ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আপনার কাছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা বলেই আপনি প্রমাণ করতে পেরেছেন, এ দেশের মানুষের কাছে করা ওয়াদার মর্যাদা রাখতে আপনাকে দমানো সম্ভব নয়।
২০১৫ সালের ২১ নভেম্বর। দিনভর শ্বাসরুদ্ধকর কত নাটক। সাকা-মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার চেয়ে সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল এ দুই যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চান কি না। এর আগে ১৮ নভেম্বর সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের করা ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত। ১৯ নভেম্বর সেই রায়ের অনুলিপি কারাগারে পৌঁছে এবং বৃহস্পতিবার রাতেই সাকা চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে সেই রায় পড়ে শোনানো হয়। এর পর থেকেই ‘টক অব দা টাউন’ হয়ে ওঠে এ দুই হেভিওয়েট যুদ্ধাপরাধী প্রাণভিক্ষা চান কি না, সে বিষয়টি। শুক্রবার থেকে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সাধারণ মানুষের উৎকণ্ঠা, গণমাধ্যমকর্মীদের দৌড়ঝাঁপ সবকিছুই চলতে থাকে একটা গুঞ্জনে, শেষ পর্যন্ত এ দুই অপরাধী ফাঁসিতে ঝুলবে তো? এর অবশ্য কারণও আছে। মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরামর্শদাতা পরিকল্পনাকারী এবং উৎসাহদাতা হিসেবে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি থাকার কারণেই দুদফা দেশের সর্বোচ্চ আদালত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসির আদেশ বহাল রেখেছেন। কিন্তু দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে এই দুই দাম্ভিক নেতা এই স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রী হয়েছেন, দম্ভোক্তি করেছেন—দেশে কোনো যুদ্ধোপরাধী নেই। এমনকি ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজের সময়ও তারা তাদের আচরণ সংযত তো করেনই নাই, বরং বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে উপহাস করে গেছেন সারাটা সময়। এত দীর্ঘ সময় ধরে তাঁরা আস্ফালন করে এসেছেন যে তাঁদের কেউ কিচ্ছুটি করতে পারবে না, এই প্রচারণাই সাধারণ মানুষের মনে ছাপ ফেলেছে, আসলেই কি কেউ কিছু করতে পারবে? যাই হোক, শেষ পর্যন্ত আইনের কাঠগড়ায় তারা মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু সাকার ভাষায় বলতে হয়, কুকুরের লেজ যত কিছুই করা হোক না কেন, বাঁকাই থাকে, সোজা আর হয় না। তার প্রমাণ সাকা-মুজাহিদ শেষ পর্যন্ত তাঁদের প্রাণভিক্ষা নিয়ে নাটকের মধ্য দিয়ে করে গেলেন। বৃহস্পতিবার গেল, শুক্রবার গেল, সাকা-মুজাহিদ প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না, তার কোনো উত্তর আসে না। শেষ পর্যন্ত এই ধাঁধার সমাধান দিলেন আইনমন্ত্রী নিজে, বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৯-এ মহামান্য রাষ্ট্রপতির যে ক্ষমা করার ক্ষমতা, সেই ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য তাঁরা আবেদন করেছেন। যদিও সাকা-মুজাহিদের পরিবার এবং জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, সাকা-মুজাহিদ প্রাণভিক্ষা করেনি। মৃত্যুর আগপর্যন্তও এই মানুষ দুটি তাঁদের ‘চরিত্র’ থেকে বের হতে পারলেন না। সাকা-মুজাহিদ দুটি রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা। দুই দলের পক্ষ থেকেই যখন বারবার বলা হচ্ছে, সাকা-মুজাহিদ কখনোই প্রাণভিক্ষা চাইবেন না, তখন তাঁরা কিন্তু ঠিকই প্রাণভিক্ষা চাইলেন এবং স্বাভাবিকভাবেই তা অস্বীকার করল তাঁদের পরিবার। শেষ পর্যন্ত তাঁরা প্রমাণ করলেন, নৈতিকভাবে তাঁরা কতটা দুর্বল মানুষ।
দেশের যেসব সূর্যসন্তান বুদ্ধিজীবীকে খুন করেছিলেন তাঁরা, তাঁদের পরিবারের মধ্যে দীর্ঘ ৪৪ বছর পর স্বস্তি মিলল। সারা দেশের মানুষের মধ্যেই এক দায়মুক্তির সান্ত্বনা। কিন্তু পথ এখনো অনেক বাকি। বাকি যে যুদ্ধাপরাধীরা বিচারাধীন আছেন, তাঁদের মধ্যে এই মেসেজটা নিশ্চয়ই চলে গেছে, সাজা তাদের পেতেই হবে। তবে সে সঙ্গে সরকারের ওপর একটা অনেক বড় চাপ এখন এসে পড়বে। কারণ, বিদেশি গণমাধ্যমগুলোতে এরই মধ্যে এ দুই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির সংবাদটি প্রচার পেয়েছে এমনভাবে যাতে মনে হচ্ছে, দুই রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে তাঁরা সাজা পেয়েছেন। এমনকি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমেও তাঁদের দুটি বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবেই পরিচিতি এসেছে। এই আলামতটি কিন্তু স্বস্তিদায়ক নয় বাংলাদেশের জন্য। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের গতি যদি অন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারিক কাজে এতটুকু গতি শ্লথ হয়, তাতে সমালোচনার সম্মুখীন হবেন তাঁরাই। কারণ, তখন যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ থেকে প্রপাগান্ডা চালানো জুতসই হবে যে রাজনৈতিক প্রতিশোধ চরিতার্থ করতেই শেখ হাসিনা সাকাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। এরই মধ্যে সাকার পরিবারের পক্ষ থেকে এ কথা বারবারই বলা হচ্ছে, সাকা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার কারণেই ন্যায়বিচার পাননি। কাজেই সরকারকে সতর্ক হতে হবে। বিচারিক কাজে কোনো ফাঁক রাখা চলবে না। কারণ, মিথ্যা প্রতিষ্ঠা করা অনেক বেশি সহজ কাজ, সত্যকে সামনে আনার চেয়েও।
যুদ্ধাপরাধী সাকা-মুজাহিদের ফাঁসির মধ্য দিয়ে আরেকটা প্রত্যাশা কিন্তু বড় হয়ে উঠছে সাধারণ মানুষের মধ্যে, তা হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে আরো একধাপ এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। তাই যুদ্ধাপরাধীদের পাশাপাশি যত হত্যাকাণ্ড ঘটছে এ দেশে, তার সুষ্ঠু বিচার হবে তার প্রত্যাশা করাটা কি খুবই অপ্রাসঙ্গিক? মোটেই না, সাম্প্রতিক সময়ে ব্লগারদের যেভাবে দিনের আলোতে মেরে ফেলা হয়েছে, যেভাবে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে, তার থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে বের করতে হবে সরকারকেই।
দেশে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার লাগাম টেনে ধরতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। যদিও সরকারের মন্ত্রী, আমলা থেকে শুরু করে খোদ প্রধানমন্ত্রীও দাবি করছেন, দেশে সহিংসতা এবং যত হত্যাকাণ্ড ঘটছে তার দায়ভার বিএনপির। তাই যদি হয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোর আবেদন, দোষীদের শনাক্ত করে তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করান, যদি তারা দোষী প্রমাণিত হয় তাদের শাস্তি দিন। কিন্তু গণহারে বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করে জনমনে আতঙ্ক তৈরি করার প্রয়োজন আছে কি? দোষ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সাধারণ মানুষের কাছে এটা রাজণৈতিক প্রতিহিংসা ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না।
আর এখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার চায়; রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছ থেকে জানমালের নিরাপত্তা চায়। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন, দোষী সে যে দলেরই হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিন, সাধারণ মানুষ আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। আর সেই দুষ্কৃতকারী যদি আপনার দলের হয়, তাহলে আরো কঠোর হন। কারণ, যে আপনার দলের নাম ব্যবহার করে অপকর্ম করে, সে কখনো আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারে না, তার পরিচয় একটাই—সে সুবিধাভোগী। আর এ ধরনের সুবিধাভোগীরা কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তার প্রমাণ আজ পেয়েছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। দলের মধ্যে বিভীষণদের শনাক্ত করার এটাই বড় উপযুক্ত সময়। বিএনপি আজ তার শত্রু-মিত্র চিনতে না পারায় বড় মাশুল দিচ্ছে। তবে বিএনপির জন্য এই খারাপ সময়টিও ভুল সংশোধনের ভালো সময় হয়ে উঠতে পারে, যদি তারা দলের ভেতরকার আগাছাগুলো উপড়ে ফেলতে পারে। মানুষেরই ভুল হয়, ভুল হয় না শুধু ফেরেশতা আর শয়তানের। আর এ কারণেই মানুষ সেরা জীব, কারণ তারা ভুল স্বীকার করে সংশোধন করে নিতে পারে।
ইতিহাসের দায়মুক্তির পথে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া থেমে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। আমরা অনেক আশা নিয়ে বসে আছি সব যুদ্ধাপরাধী তাদের কৃতকর্মের শাস্তি পাবে। আমাদের বীরেরা, যাঁরা জীবনের বিনিময়ে এই দেশটা আমাদের উপহার দিয়েছেন, তাঁরা শান্তিতে ঘুমোবে। তোমরা ঘুমাও, আমরা জেগে আছি, জেগে থাকব অতন্দ্র প্রহরীর মতো, যতদিন তোমাদের হত্যাকারীদের শাস্তি না হয়।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ।