বিরুদ্ধভূমিতে আর্তনাদ- ‘আমাদের গুলি করে মেরে ফেলো’
সুফি, বাউল, বৈষ্ণবের মরমি সুর আর সবুজে ভরা গাছ-গাছালি, নদী-নাও, পলিমাটির ঘ্রাণে বেড়ে ওঠা বাঙালির হাহাকার সাতসমুদ্র তেরো নদী কিংবা অটল হিমাদ্রি পেরিয়ে আছড়ে পরে আরেক বাঙালির অন্তরে। এই প্রাণছোঁয়া প্রাণ শতসহস্র বছর ধরে বয়ে চলছে বাঙালি। সহমর্মী এই সুর যার হৃদ-তন্ত্রীতে বাজে না, তিনি বাঙালি নন, ভিনদেশি কেউ। গত কদিন ধরে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে গ্রিস সীমান্তে আটকে পড়া অসংখ্য অভিবাসনপ্রত্যাশীর মর্মভেদি অসহায়ত্বের ছবি। যাঁরা আমাদের পলি-জলে বেড়ে ওঠা বাঙালি। ‘আমাদের গুলি করে মেরে ফেলো, আমরা কখনোই ফিরে যাব না’ বলে বলে এদের আর্তনাদে আমাদের চিত্ত-চৈতন্য কেঁপে ওঠার কথা। অথচ কেঁপে উঠছে না, কোথাও কোনো ঐকতান নেই, নেই সহমর্মী সুর। ভিনদেশের মাটিতে শ্যামলমাটির এই মানুষদের মাথার ওপরে কোনো ছায়া নেই। আছে কেবল মেঘহীন অচেনা আসমান আর পায়ের নিচে পলিহীন রুক্ষ-রুষ্ঠ মাটি। সামনে-কাঁটাতার আর বন্ধুকধারী সান্ত্রী, পেছনে মরণফাঁদ-সমুদ্র ছাড়া তাদের পাশে কেউ নেই। সরকার নেই, মন্ত্রণালয় নেই, দূতাবাস নেই, মানবাধিকারের ছত্রধরেরা নেই।
রয়টার্স ও এএফপির মতো পশ্চিমা গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, তুরস্ক থেকে বিপদসংকুল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে হাজার হাজার অভিবাসী গ্রিসে পৌঁছার পর পশ্চিম ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বেশির ভাগই যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিক। এঁদেরই সঙ্গে রয়েছেন ইরান, পাকিস্তান, মরক্কো, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ‘অর্থনৈতিক অভিবাসী’। এদের গন্তব্য জার্মানি ও সুইডেন। প্যারিসে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার আগে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কেবল সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানসহ যুদ্ধপীড়িত দেশগুলোর নাগরিকদের সীমান্ত অতিক্রম করতে দিয়েছিল। এই দেশগুলোর ছাড়া অন্যান্য দেশের নাগরিকদের আটকে রেখেছিল সীমান্তের বাইরেই। ফলে, বিভিন্ন সীমান্তে আটকা থাকেন অভিবাসনপ্রত্যাশী শত শত মানুষ। আর প্যারিস হত্যাকাণ্ডের পর সীমান্ত পেরুনোর বিষয়টি হয়ে পড়েছে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন। এঁরা মেসিডোনিয়ার সীমান্তবর্তী গ্রিক শহর জেভজেলিজায় প্রচণ্ড শীতের মধ্যে তাঁবুতে এবং আগুন জ্বালিয়ে তার পাশে রাত কাটাচ্ছেন। গত ২৩ নভেম্বর পশ্চিম ইউরোপে যাওয়ার দাবিতে আটকে পড়া অভিবাসীরা একটি রেলপথ অবরোধ করে। এই অবরোধে অংশ নেয় বাংলাদেশি অভিবাসীদের বড় একটি দল। এই বাংলাদেশিদের খোলা বুকে লাল রঙে লেখা ছিল, ‘আমাদের গুলি করে মেরে ফেলো, আমরা কখনোই দেশে ফিরে যাব না’, ‘আমাদের গুলি করে মেরে ফেলো’ অথবা ‘আমাদের রক্ষা করো’সহ নানা স্লোগান। কেবল স্লোগানের ভাষাতেই নয়, তাঁদের অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে প্রবল আকুতি আর মর্মভেদী হাহাকার।
গ্রিস অভিমুখী বাংলাদেশিদের যাত্রা এবং বিড়ম্বনার ঘটনা এবারই নয়। ২০১১ সালে গ্রিস উপকূলে ১০ বাংলাদেশি সমুদ্রে ডুবে মারা যান। ২০১৩ সালে গ্রিসের একটি খামারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ওপর খামার মালিক গুলিবর্ষণ করে। সে গুলিতে ৩২ জন আহত হন। ২০১৪ সালে খামারের মালিককে সে দেশের আদালত বেকসুর খালাস দিয়ে দেয়। এই তো কদিন আগের আগস্টে গ্রিসের কুস দ্বীপে ২০০ বাংলাদেশি অভিবাসীর আটকে পড়ার খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসে। বাঙালিদের গ্রিস অভিমুখী যাত্রার একটি প্রেক্ষাপটও আছে। বেশ কয়েক বছর আগে গ্রিসে ঠাঁই পাওয়া বাংলাদেশিদের মালিকানায় ছোট-বড় প্রায় তিনশটি পোশাক কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কারখানাগুলোয় কাজ করেন পাঁচ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক। ২০১৪ সালে গ্রিসের ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা এবং বাংলাদেশ থেকে ওই সব কারখানায় পোশাক কেনার অর্ডার কমে আসায় সেখানে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাকরি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এসব কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে এমন শঙ্কায় হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক ইউরোপে পাড়ি জমাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তাঁদের সঙ্গে লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাকসহ বিভিন্ন যুদ্ধমান দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি শ্রমিকরাও নতুন কর্মক্ষেত্রের সন্ধ্যানে মরিয়া। এঁদের লক্ষ্যও ইউরোপ।
গন্তব্যে যাওয়ার পথে তাঁদের যাঁরা আটকে রেখেছেন, তাঁদের আটকে রাখার যৌক্তিকতাকে বর্তমান বাস্তবতায় কেবল মানবিকতার প্রশ্নেই প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়, নৈতিকতা কিংবা বৈধতার তুলাদণ্ডে নয়। কারণ এঁদের পরিচয় এঁরা অর্থনৈতিক অভিবাসী, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষ নয়। এঁদের দায় তারা নেবে কেন। তারপরও প্রশ্ন থাকেই। তৃতীয় বিশ্বের মানুষদের অর্থনৈতিক উদ্বাস্তু হয়ে ওঠার পেছনে শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে ঔপনিবেশিক শোষণ, লুটপাট, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, নিবর্তন, যুদ্ধ-ধ্বংসের কি কোনো ভূমিকা নেই, ইউরোপের ওপর এই দায় কেন বর্তাবে না। অবশ্যই বর্তাবে। তবে সে বিতর্কের সময় এটা নয়।
আমাদের কেউ কেউ এমন প্রশ্নও তোলেন, ‘আমরা কেন অভিবাসী হতে অবৈধভাবে বিপদসংকুল পথ পেরিয়ে, উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ ডিঙিয়ে ভিনদেশের কাঁটাতারের সামনে ভিখারির মতো দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করি।’ কিন্তু আমরা ভুলে যাই ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাখ লাখ বাঙালি, বাংলাদেলিদের অবস্থান। এদের অনেকেই আজ আত্মসম্মানের সঙ্গে সেসব দেশে সুপ্রতিষ্ঠিতও। ষাটের দশক থেকে ইউরোপ-আমেরিকায় এই লাখো বাঙালির প্রবাস অভিযাত্রা যতটা না বৈধ পথে ঘটেছিল, তার চেয়ে শতগুণ বেশি ঘটেছিল অবৈধ পথে কিংবা এমন ধরনের কৌশলেই। বৈধতার প্রশ্নে মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থা হয়তো কিছুটা ভালো। তবু বলতেই হয় মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ-আমেরিকা প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সেই ফুলেফেঁপে উঠেছে আমাদের রাজভাণ্ডার। বেড়েছে আমাদের বিলাস, জীবনমান, কমেছে দারিদ্র্য। গ্রিস-মেসিডোনিয়া সীমান্তে আটকে পড়া এই অসহায় বাঙালিদের সঙ্গে রেমিটেন্স পাঠানো বাঙালিদের পার্থক্য হচ্ছে সময় এবং নিয়তি। এরা ভুল সময়ের ভাগ্যবিড়ম্বিত অভিযাত্রী। ভাগ্য এঁদের কোথায় নিয়ে যাবে তারা জানে না। আমরাও জানি না।
আমাদের জীবনসন্ধ্যানী সন্তানরা গ্রিসের পাষাণ দুয়ারে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে। গভীর সংকটের অজগর যে তাদের ধীরে ধীরে গ্রাস করছে সেটা দেশবাসী জেনেছেন। বিরুদ্ধভূমিতে গণমাধ্যমের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে করে আমাদের সন্তানরা আমাদের সে খবর জানিয়েছেন। এবার আমাদের দায় তাদের পাশে দাঁড়ানো। আমরা পঙ্গু বিকলাঙ্গ কোনো দাসভূমির সন্তান না। রক্তস্রোত পেরুনো একটি রাষ্ট্রের সন্তান তারা। রাষ্ট্র তাদের পাশে দাঁড়াবে সে আশা তারা করতেই পারে। অথচ আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অথবা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এখনো নিশ্চুপ। কুম্ভকর্ণ নিদ্রায় মগ্ন। এই মৌন, এই মগ্নতা বড্ড ভয়ংকর।