বিজয়ের মাস
বিজয়ে রাঙানো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/12/01/photo-1448969079.jpg)
শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে গণজাগরণ মঞ্চের জয়জয়কার তখন। বিশিষ্টজনরা আসছেন, একের পর এক চলছে উদ্বুদ্ধ করার কথামালা। এলেন লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। বললেন, ‘আজ আমি এসেছি তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইতে! আমি পত্রিকায় লিখেছি এই যে নতুন জেনারেশন খালি ফেসবুকে লাইক দেয়, এরা আর কিছু করে না। আমি লিখেছি এরা খালি ব্লগ করে, এরা আর কিছু করে না। এরা রাস্তায় নামে না। তোমরা আমাকে ভুল প্রমাণিত করেছ।’সেই সময় তরুণদের যে জাগরণ বা দেশকে নাড়িয়ে দেওয়া, দেশের মুক্তিকামী মানুষকে এক কাতারে নিয়ে আসা, এর মূল কারণ কিন্তু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। আরো বিশেষ করে বলতে গেলে ফেসবুক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে অপ্রতিরোধ্য শক্তি। এটা এমন এক মাকড়ের জাল যার সুতোর এক প্রান্তে আগুন দিলে তা ছড়িয়ে পড়ছে পুরো বিশ্বে। মূল যোগাযোগ মাধ্যম যখন মালিকানা, মতাদর্শ বা বিজ্ঞাপনের কারণে কণ্ঠ উঁচু করতে পারছে না সেখানে বিকল্পশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
২০০৪ সালের পর থেকে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশে অন্তর্জালিক এই যোগাযোগ মাধ্যমটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে থাকে। বর্তমানে এমন হয়েছে যে একটি দিন ফেসবুকহীন কেমন যেন আলুনি লাগে। দিন বদল, সমাজ বদল বা সময় বদলের যে ধারণাগুলো এত দিন শুধু গণ্ডিতে সীমিত ছিল এখন মুহর্তে তা ছড়িয়ে পড়ছে দেশ থেকে দেশান্তরে। এর মধ্যে মত-দ্বিমতের পর কোনো কোনো বিষয়ে একমত হলেই এককাতারে মিলছে সম্মিলিত ঢেউ। গর্জে উঠছে বাংলাদেশ, বা আরো ব্যাপক অর্থে পুরো বিশ্ব।
আমাদের মহান বিজয়, স্বাধীনতা, একুশে ফেব্রুয়ারি বা জাতীয় যে কোনো দিবস ভার্চুয়ালি প্রকাশ হয়ে উঠছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। ফুটে উঠছে হতাশা, আনন্দ বেদনার কাব্যের সাথে ওই সময়টা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বা জীবনজিজ্ঞাসাও। এতে করে একদিকে যেমন পরিচিতজনদের সঙ্গে নিজের ভাবনা বিনিময় হচ্ছে তেমনি ভাবনার দূরত্বও মেপে নেওয়া যাচ্ছে এক নিমেষে। তবে আমাদের দেশের চেয়ে কিছুটা হয়তো অগ্রসরমান উদাহরণ হয়ে থাকবে আরব বসন্ত। যার জন্ম আসলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের হাত ধরে। ফেসবুকে প্রায় ২ বিলিয়ন লোকযুক্ত, যা বেশ কয়েকটি দেশের জনসংখ্যার যোগফলের সমান। আর ফেসবুক যদি নিজেই একটি দেশ হয় তাহলে সেটা কেমন হবে তা সহজে অনুমেয়। আরব বসন্ত প্রমাণ করে দিয়েছে ফেসবুকের রাজনৈতিক ক্ষমতা। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনের সময় পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে ওই নির্বাচনে ৬০ ভাগ ভোট বেশি পড়েছিল। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে শাসকগোষ্ঠী ভয় পাওয়ার কারণে ‘দেশের বৃহত্তর স্বার্থে’ তা সাময়িক বন্ধ রাখার ঘটনাও ঘটেছে বিভিন্ন দেশে। আবার অতিব্যবহারে মর্যাদাহানির ঘটনা ঘটার আশঙ্কায় আমাদের দেশেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধের ঘটনা ঘটেছে। এ কথা ঠিক যে, এই মাধ্যমই যেকোনো সময় অনর্থ ঘটাতে পারে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমের ভয়ংকর ব্যবহারে সাম্প্রদায়িক উসকানির মতো ঘটনাও ঘটেছে। তবে এসব কিছু ছাপিয়ে জনমত গঠন, অধিকার ও দাবি আদায়ের মাধ্যম হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এর একটি বড় প্রমাণ যুদ্ধাপরাধীদের বিপক্ষে জনমত গঠন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যাপক বিস্ফোরণ দেখা যায় সে সময়। প্রথম শুরু হয় কাদের মোল্লার রায়কে ঘিরে। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হলে ফেটে পড়ে দেশ-বিদেশের সচেতন জনগণ। এই ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুক, টুইটার, ভাইভারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যদিও পরে কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়। পরবর্তী যুদ্ধাপরাধের বিচারের পাশাপাশি দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে তরুণরা একাট্টা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সামাজিক গোষ্ঠীর কাছে বার্তা পৌঁছানো এবং এর ফলে বৃহত্তর অঘটন থেকে দেশকে বাঁচানোর চেষ্টাও লক্ষ করা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে। বিরূপ কিছু যে হয়নি তাও না। সেটি যারা ব্যক্তি স্বার্থকে দেশের চাইতে বড় করে দেখে তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
‘দেখা হবে রাজপথে, কথা হবে মিছিলে’, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক-গণতন্ত্র মুক্তি পাক’, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’, ‘চে, তোমার মৃত্যু আমাদের অপরাধী করে দেয়’ এমন রক্ত টগবগে কথা এখন বই, টি-শার্ট আর রাজপথের পাশাপাশি উঠে এসেছে ফেসবুকেও। ছবি যেমন হাজার কথা বলে দেয়, তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই রাঙানোতেই ফুঠে উঠে ব্যক্তির মনোভাব, তার সামাজিক অবস্থান বা জিজ্ঞাসা। মাথায় জাতীয় পতাকা, খুকির তুলতুলে গালে আঁকা শহীদ মিনার, পোশাকে লাল-সবুজ বা স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনারে পতাকা শোভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে তোলা ছবিকে শুধু আত্মকেন্দ্রিক ভাবনা বলার সুযোগ কিন্তু নেই। ফেসবুক, টুইটার, স্কাইপ, ভাইবার, গুগল প্লাস বা আরো আরো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া ভাবনাগুলো নিজের ভাবনার পাশাপাশি হয়ে উঠছে দেশের প্রতি ভালোবাসা বা দায়িত্বশীল অনুভূতির প্রকাশও।
বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস থেকে শুরু করে বিজয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন দিবস, অঞ্চল মুক্ত দিবস বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কোনো দেশকে সমর্থন জানিয়ে সে দেশের পতাকার নিজের প্রোফাইল রাঙানোও (সম্প্রতি ফ্রান্সে হামলার পর মার্ক জাকারবার্গ থেকে শুরু করে অনেকে ফেসবুকের ছবি ফ্রান্সের পতাকায় রাঙায়) এক ধরনের দায়বদ্ধতা বলা যায়। বিশেষ বিশেষ দিনে অনেকে নিজের ভাবনাকে জানিয়ে দিচ্ছে অনেকের কাছে। সে কারণে এ কথা বলা যায় যে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ বা দেশপ্রেমের প্রামাণ্য চেতনার এক বিস্ময়কর ভাণ্ডার হিসেবে গড়ে উঠছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম কোনো দ্বিধা না রেখেই তার ভাবনাগুলো জানিয়ে দিচ্ছে প্রকাশ্যে। যার ফলে ভাবনা বিনিময় কেন্দ্র হয়ে উঠছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। মানবীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক সীমারেখা মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
আমাদের তরুণরা এতোটাই সোচ্চার যে দেশমাতৃকার বিরুদ্ধে কেউ কোথাও কোনো বিষোদগার করলে তাতেও ক্ষোভে ফেটে পড়ে উপযুক্ত জবাব দিচ্ছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সাইবার যুদ্ধেও জয় ছিনিয়ে এনেছে আমাদের তরুণরা। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে পাকিস্তান বা বিভিন্ন পেইড সংস্থার বক্তব্যের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার তরুণ প্রজন্ম। ভারতে যশরাজ ফিল্মের ব্যানারে আলী আব্বাসের ‘গুন্ডে’ সিনেমায় মহান মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলায় ঝড় উঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানো হয়। আবার হয়তো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কোনো ভালো ছবির প্রচার চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অনেক তরুণ মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে তৈরি প্রামাণ্যচিত্র সম্প্রচারের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছে ইউটিউবকে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দেশমাতৃকা নিয়ে কোনো বক্তব্যও সংবাদ মাধ্যমগুলো গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করছে তরুণ সমাজের ঝোঁকের কথা মাথায় রেখে।
খালি পায়ে প্রভাতফেরি, ফুল হাতে শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধে সালাম জানিয়ে দেওয়া ছবিও হয়তো ধারণ করছে ইতিহাস। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আছে বলেই না এত আয়োজন। অনেকের কাছে কিছুটা বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে এই কৃত্রিম শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। কিন্তু এই কৃত্রিমতা থেকে শুরু করেই তো একদিন ফুটে উঠবে সত্যিকারের ভালোবাসা। সেটাই বা কম কিসে?
বিজয়ের অর্জনের প্রতিটা ধাপে ধাপে ১৯৭১ যারা দেখেনি তারা সেটিকে ধারণ করে ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার বা কাভার পিকচারটিকে সে দিনের রঙে সাজিয়ে হয়তো ফিরে যেতে চেয়েছে সময়ের কাছাকাছি, স্বজনহারাদের পাশে স্বজনের মতো থেকে দিতে চেয়েছে সান্ত্বনা। বলতে চেয়েছে, সবকটি জানালা খোলা, ওরা হয়তো আর ফিরে আসবে না। কিন্তু আমরা আছি, যে আলোকবর্তিকা আমাদের পূর্বসূরিরা তুলে দিয়ে গেছেন তা উত্তরসূরিদের কাছে দিয়ে যাওয়াই আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, সময় টেলিভিশন।