পৌরসভা নির্বাচন
চায়ের কাপে ধোঁয়ায় ভোটের হাওয়া
বাঙালি উৎসব প্রিয় জাতি। যেকোনো একটা উপলক্ষ পেলেই মেতে উঠি আনন্দ-উল্লাসে। এই আনন্দের কারণেই হয়তো শত অভাব অনটনের মধ্যে থেকেও গ্যালারিতে বসে বলে উঠতে পারি ‘হাইজ দ্যাট’। আবার প্রতিহিংসার বিপরীতে দাঁড়িয়ে গর্জে উঠে বলতে পারি, মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি। সেই উৎসব এখন শুরু হয়ে গেছে গ্রামের আনাচে কানাচে। ভোটের উৎসব। আসলে উৎসব শুরু হয়েছে অনেক আগেই। পৌর এলাকার চায়ের দোকানে নতুন চেয়ার-টেবিল বা কাপ-পিরিচ এসেছে। কিছুটা ভাঙাচোরা যে দোকানগুলো, সেগুলোও সারানো হয়েছে, নতুন বয়-বেয়ারা নিয়োগ হয়েছে। এসবই সত্যি খবর। আড্ডা চলছে, চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বাগবিতন্ডা যে চলছে না তাও নয়। মনোনয়নপত্র জমা, যাচাই বাছাই শেষে তা আরো ব্যাপক মাত্রা পেয়েছে। এত দিন যে অনানুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা ছিল তা ধীরে ধীরে আনুষ্ঠানিক মাত্রা পেতে যাচ্ছে। কী কারণে ভোটের মাঠ এত সরগরম? তা এবার একটা ব্যাপার আছে বৈকি! দীর্ঘ নয়বছর পর ভোটের মাঠে আবারও দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আগামী ৩০ ডিসেম্বর দেশের ২৩৫টি পৌরসভায় ভোট হতে যাচ্ছে এবার। সংশোধিত আইন অনুযায়ী এবারের নির্বাচন হচ্ছে দলীয় প্রতীকে। তাই ভোটের হাওয়া চরম গরম।
ভোটের দিন নতুন জামাকাপড় পরে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার দিন কি তবে ফিরে এলো? বিএনপি বলছে, না! সংশয়ে সদা টলছে দলটি। স্থানীয় সরকারের হাওয়া এসে লেগেছে রাজধানীর নয়াপল্টনেও। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলছেন, এই নির্বাচন কমিশন দলীয় আজ্ঞাবহ। এদের দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। তবুও গণতন্ত্রের স্বার্থে তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। শুরু থেকেই দলীয় মনোনয়নে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের নিন্দা জানিয়েছিল দলটি। অবশ্য জবাবে ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্র মাহবুব-উল-আলম হানিফের সাফ জবাব, ‘দোষারোপ করা বিএনপির পুরোনো অভ্যাস।’
স্থানীয় সরকার নিয়ে সরকারের যতটা না চ্যালেঞ্জ তার চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ বিএনপির। এবার তাদের ঘাড়ে নেই যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামী। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল না হওয়ায় তারা সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। অবশ্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী নির্বাচন করতে পারবেন। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও সিলেটের কানাইঘাটসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী নির্বাচন করছেন। কিন্তু তাদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত সাতকানিয়া ও বাঁশখালীতে কোনো প্রার্থী নেই। হাইকোর্ট ২০১২ সালের ১ আগস্ট জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে সংক্ষিপ্ত রায় দেন। এরপর ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন। পরে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের তালিকা থেকে জামায়াতকে বাদ দেয়। বর্তমানে বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। যাহোক, জামায়াত না থাকার বিষয়টি কতটা সুফল দেয় তা বোঝা যাবে নির্বাচনের পর। কারণ জামায়াত ছাড়া দীর্ঘ সময় পর নির্বাচনে যাচ্ছে বিএনপি। এর ফলে আওয়ামী লীগসহ সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার যে প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছিল, নির্বাচনে বৈতরণী সফলভাবে পার হলে বিএনপি হয়তো সেটা ভেবে দেখার সুযোগ পাবে। তবে জামায়াত থেকে সাবধান থাকতে হবে এই কারণে যে বিএনপি যে তাদের ছাড়া চলতে পারে সেটা প্রমাণ করার সুযোগ না দিতে বিপক্ষ শক্তি উঠেপড়ে লাগতে পারে।
এ ছাড়া এলাকায় বিএনপির চেয়ে এখন ক্ষমতাসীন দলের লোকজনদের দাপট বেশি। প্রশাসনেও তাদের লোকজন রয়েছে। এই বিষয়টি মাথায় রেখে বিএনপিকে এগুতে হবে। তেমন একটি উদাহরণ বরিশালের গৌরনদীতে বিএনপির কোনো নেতাকর্মী বা সমর্থক কোনো ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী হননি। তাদের ধারণা, এবারের নির্বাচনে ভোট কারচুপি ও ব্যালট ছিনতাই হতে পারে। দলীয় মতানৈক্যের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে বিএনপিকে। দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা তো রয়েছেই। কিশোরগঞ্জের ভৈরবে পৌর নির্বাচনে দুই মেয়র ও তিন কাউন্সিলর পদপ্রার্থীসহ বিএনপির ৫৬ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা, ভাঙচুর ও মারধরের অভিযোগে মামলাটি করেন যুবদল নেতা রুবেল মিয়া। আবার নাটোরে বিএনপি নেতা-কর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এমন আরো অভিযোগ প্রতিদিন করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় বিএনপির পক্ষ থেকে।
দুই.
ভোটের মাঠে এখন চায়ের কাপে ঝড় নানা কারণে, দলীয় প্রার্থী নিয়ে নানা কথা-কুকথা তো ছড়াচ্ছেই। তাই চায়ের দোকানগুলোও খোলা থাকছে সারারাত। কী করলে কী হবে, বা কাকে ভোট দিলে কে জিতবে তার পাশাপাশি উঠে আসছে নানা রঙ্গরসও। টাঙ্গাইলের সখীপুরে পৌরসভা নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে সহোদর ভাই-বোন লড়ছেন, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে মা জুলেখা খাতুন কাউন্সিলর ও ছেলে লড়ছেন মেয়র পদে। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় আপন দুইভাই প্রার্থী হয়েছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো বাবার সমর্থন যুবলীগ নেতা সেজ ছেলের প্রতি। তার যুক্তি যেহেতু দলীয় নির্বাচন তাই দল সমর্থকের পক্ষে থাকতে হবে। বরিশালের গৌরনদীতে যুবলীগ নেতা ও তার স্ত্রী পরস্পরের প্রতিদ্বন্ধী হিসেবে নির্বাচনে নেমেছেন। বান্দরবান ও বরগুনার পাথরঘাটায় লড়ছেন চাচা-ভাতিজা। দুজন দুই দলের। চাঁদপুরের মতলবে ভোটযুদ্ধে নেমেছেন চাচি-ভাতিজি। কুমিল্লার হোমনায় নেমেছিলেন দেবর-ভাবি। যদিও তাঁদের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। এগুলো আসলে ভোটযুদ্ধে আলোচনার খোরাক। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সময় পার করার জন্য কিছু তো লাগবে। তবে অনেকে এতে এক ধরনের সুবিধাবাদও দেখে থাকেন। যেমন এক পরিবারে যদি বেশ কয়েকটি দলের সমর্থক থাকে তবে যে দলই ক্ষমতাই থাকুক না কেন হালুয়া-রুটির ভাগ তো পাবেই।
তিন.
চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে নারীদের জন্য প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে সমালোচনার রেশ কাটতে না কাটতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আবারও একই ধরনের ভুল করে বসল কমিশন। যদিও তখন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল পরবর্তী সময়ে সংশোধন করা হবে। কিন্তু যেই লাউ সেই কদু! এবারের নির্বাচনে নারী কাউন্সিলর পদে প্রার্থীদের জন্য প্রতীক বরাদ্দ রাখা হয়েছে, গ্যাসের চুলা, কাঁচি, চকলেট, চুড়ি, পুতুল, ফ্রক, ভ্যানিটি ব্যাগ, মৌমাছি, আঙুর ও হারমোনিয়াম। এ নিয়ে ইতিমধ্যে সমালোচনা শুরু হয়েছে। নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন বিশিষ্টজনরা বলছেন, এ ধরনের প্রতীক বরাদ্দ নারী অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ও উসকানিমূলক। মনে হয়, নির্বাচন কমিশনকে বিষয়টা নিয়ে জোরালোভাবে ভাবতে হবে, নারীদের মহলে থাকা মহিলা নয়, নরের সমকক্ষ নারী ভাবতে হবে।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, সময় টেলিভিশন।