বিজয়ের ৪৪ বছর
তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?
বুদ্ধিজীবী দিবসের প্রথম প্রহরে বা পরদিন প্রভাতফেরিতে শামিল হয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীর যে সন্তানরা স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন তাঁদের দেখে মনে হয়েছে, এবার তাঁরা কিছুটা বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পেরেছেন। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় ভারাক্রান্ত মনের পাশাপাশি কিছুটা উৎফুল্ল এ কারণে যে, সাকা চৌধুরী, মুজাহিদ, কাদের মোল্লা বা কামারুজ্জামান যাঁরা বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাঁদের ফাঁসি হয়েছে। শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ বললেন, ‘আমার বাবাকে তো ধরে নিয়ে গেছে, তাঁর মরদেহ পাইনি, রায়েরবাজার এলে মনে হয় এখানে তিনি ঘুমিয়ে আছেন।’ স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বুদ্ধিজীবীদের এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হলে ’৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর তা বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৮ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু হলে চলতি বছরই প্রথম বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী তৎকালীন আলবদর বাহিনীর প্রধান আলী আহসান মুজাহিদকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
স্বাধীনতার ৪৪ বছরে এসে এই অর্জনটিই সবচেয়ে বড়। আর তা সম্ভব হয়েছে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তার ফলেই। এত এত বাধাও যেন ‘দাবায়া’ রাখতে পারেনি তাঁকে। আর এবারের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে যে দাবিটি জোরালো হয়ে উঠেছে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের মাঝে, তা হলো পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পাশাপাশি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা। ওইদিন অবশ্য একটা বার্তা দিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তারা শিক্ষা সম্পর্কিত সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে পাকিস্তানের সঙ্গে।
স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছরে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ এসেছে বেশ কয়েকবার। বেড়েছে পাসের হার। জ্ঞানের সৃষ্টি ও বিকাশের জন্য কাজ করা মাত্র ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও এখন মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা আটাশিটি। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে থেকে গেছে প্রশ্ন আর পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ম্লান করে দিয়েছে অনেক অর্জনকে। তবে নতুন বছরের শুরুতে বই উৎসব যেন সত্যিকার অর্থে খুদে শিক্ষার্থীদের আনন্দ উৎসবে পরিণত হয়েছে (এবার হবে ২ জানুয়ারি)। এ ছাড়া পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা যোগ করেছে নতুন উদ্দীপনা।
জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশ বিশ্বাস করে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়। এই হলো আমাদের পররাষ্ট্রনীতি। কিন্তু নগর পুড়লে দেবালয় কি আর রক্ষা হয়? তাই বিশ্বসন্ত্রাসের থাবা বারবার আমাদের ক্ষতবিক্ষত করতে চেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সেটা নতুন মাত্রা পেয়েছে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায়। দুনিয়া জোড়া উগ্রবাদ ও ধর্মের নামে সন্ত্রাস ছড়ানো গোষ্ঠীগুলো গেড়ে বসতে চাচ্ছে বাংলাদেশেও। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে কিছু কিছু সংগঠনের অস্তিত্ব নেই বলে আশ্বস্ত করা হচ্ছে। বাংলাদেশে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মধ্যে সবশেষ সংযোজন পুলিশ ব্যুারো অব ইনভেস্টিগেশন-পিআইবি। তবে ৪৪ বছর ধরে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো নানা পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে কোনো সামগ্রিক নিরাপত্তানীতি ছাড়াই। সে কারণে বাহিনীগুলোর মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়িও কোনো কোনো সময় সমালোচনা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সঙ্গে স্থলসীমান্ত এবং ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে সাফল্য এসেছে। কিন্তু এখনো কোনো সুরাহা হয়নি রোহিঙ্গা ইসুটি। ভারতের সঙ্গে ৫৪ অভিন্ন নদী ইস্যুও সফলতার মুখ দেখেনি। এ ছাড়া তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যাও আমরা বুঝে পায়নি। তাই এসব সমস্যা সমাধানে দ্রুত এগোতে হবে। নইলে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের মতো বিষয়গুলো আমাদের অগ্রযাত্রাকে আরো থামিয়ে দেবে।
স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও প্রতিষ্ঠিত হয়নি মানুষের অধিকার। মুখে যতই স্বাধীন মানবাধিকার কমিশনারের কথা বলা হোক না কেন, তা যে কাগুজে বাঘ সেটা সহজেই অনুমেয়। নাগরিকদের অধিকার আদায়ে রাষ্ট্র যথাযথ পদক্ষেপ নেয় না বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, খুন, গুমের মতো ঘটনা মানবাধিকার পরিস্থিতিকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
তবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন যেন ঈর্ষণীয়। যার ফলে বিশ্বের মোড়লরাও অকুণ্ঠচিত্তে প্রশংসা করতে কার্পণ্য করছেন না। আর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার সাহস দেখিয়ে আমরা যেন আরেক ধাপ এগিয়েছি ‘সাহস’ দেখানোর ক্ষেত্রে। আশির দশকে শিল্পনীতির পরিবর্তনের ফলে আমাদের বিনিয়োগ গতি পায়। শুরু হয় বেসরকারি খাতে বিনিয়োগও। তবে বেসরকারি বিনিয়োগের ফলে সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় প্রতিযোগিতায় ঠিকতে না পেরে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে বিনিয়োগ যেখানে ছিল জিডিপির ৮.২ শতাংশ, চার দশকের ব্যবধানে এখন তা প্রায় ৩০ শতাংশ। উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে মোট বিনিয়োগ চার লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। তবে বিদেশি বা বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও বিনিয়োগ উপযোগী পরিবেশ তৈরি ও বিনিয়োগ কাঠামোর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। যোগাযোগ খাতেও বাংলাদেশের সাফল্য এসেছে। যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু এবং সাম্প্রতিক সময়ে শুরু করা পদ্মা সেতু তো যোগাযোগের ক্ষেত্রে মাইলফলক হয়ে থাকবে। তবে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি রেল খাতে। বারবার বলা হলেও কোনো এক অদৃশ্য শক্তি যেন রেলযোগাযোগকে অলাভজনক খাতে পরিণত করতে উঠেপড়ে লেগেছে।
স্বাধীনতার পর নব্বই দশকের দিকে পুঁজিবাজারের আকার বড় হতে থাকে। ১৯৯৩ সালে গঠন করা হয় সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন। কিন্তু ১৯৯৬ সালে বড় বড় বিনিয়োগকারীদের কারসাজির ফলে প্রথম ধাক্কা খায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। অনেকের পথে বসার উপক্রম হয়। এর মধ্যে শুরু হয় স্বয়ংক্রিয় লেনদেন। সবশেষ দুই পুঁজিবাজারকে ডি-মিউচুয়ালাইজেশন করা হয়। বিনিয়োগ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গঠন করা হয় তদন্ত কমিশন ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু দুষ্টচক্র রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। দুই স্টক এক্সচেঞ্জ-এর পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিকে পুনর্গঠন করা হলেও আসেনি কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। আর এর পেছনে দক্ষতা ও সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে আমাদের ব্যাংকিং সেক্টর এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে। ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংক আর সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার আমানত নিয়ে যাত্রা শুরু করে ব্যাংকিং সেক্টর। বর্তমানে দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা ৫৬। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ পৌঁছেছে ২৬ বিলিয়ন ডলারে। সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি, এই খাতে হাজার হাজার চাকরিজীবী তাদের দিনযাপনের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। এখনো ব্যাংকিং খাতের চাকরি যে কোনো চাকরির চেয়ে আকর্ষণীয় ভাবা হয়।
রফতানির ক্ষেত্রেও আমাদের অগ্রগতি এসেছে। শুরুর দিকে রপ্তানি খাত শুধু কাঁচা চামড়া ও পাটনির্ভর হলেও পরে যুক্ত হয়েছে তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, চামড়াজাত পণ্য, জাহাজ নির্মাণসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি নানা শিল্প। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে মাত্র ৩৪ কোটি রপ্তানি আয় গেল অর্থবছরে পৌঁছেছে তিন হাজার ২০০ কোটি ডলারে।
শ্রম রপ্তানিও বিকাশ লাভ করেছে বাংলাদেশে। বর্তমানে ছাড়িয়েছে ৯০ লাখ। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় আড়াই লাখ শ্রমিক যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে। এ খাতের বিকাশে যে সরকার সচেষ্ট সেটা বোঝা গেছে আলাদা মন্ত্রণালয় ও ব্যাংক প্রতিষ্ঠাসহ শ্রম বাজার বিকাশে নানা উদ্যোগ নেওয়ার কারণে। এরপরও নতুন নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি না হলেও যে কোনো সময় বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে। জ্বালানি খাতে উন্নতি হলেও এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা। প্রাথমিক জ্বালানির ভবিষ্যৎ ঘাটতি নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
কর্মসংস্থানের পাশাপাশি পণ্যকে বহুমুখীকরণে ভূমিকা রাখছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত। এখানে কাজ করছেন ৭০ লাখের বেশি উদ্যোক্তা। তবে এই খাতে পৃষ্ঠপোষকতার অভাব রয়েছে এখনো। ফলে এই খাত ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ এমন একটি মানসিকতা থেকেই যাচ্ছে। তবে অবারিত ইন্টারনেটের যুগে ই-কমার্স বেশ ভালো ভূমিকা রাখছে অর্থনৈতিক উন্নয়নে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের যে স্বপ্ন নিয়ে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তা যেন ধাপের পর ধাপ এগিয়ে চলছে। এখন অনেক কাজই ঘরে বসে শেষ করা যাচ্ছে। সাবমেরিন ক্যাবলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় আমাদের ইন্টারনেটও হয়েছে অবারিত। মোবাইল কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা এসেছে। এখন প্রায় অল্প দামে সবার হাতে হাতে মোবাইল পৌঁছে গেছে।
এবার আসা যাক মিডিয়াশিল্পে। স্বাধীনতা-পরবর্তী ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে বাংলাদেশের মিডিয়াজগৎ। সংবাদপত্র, অনলাইন, রেডিও আর টেলিভিশনের জয়জয়কার। কিন্তু আসলে কতটা করপোরেট রূপ নিতে পারছে এই সংস্থাগুলো? অনেক সংবাদমাধ্যম এখনো মৌলিক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠতে পারেনি। এর ফলে কর্মসংস্থান পড়েছে ঝুঁকির মধ্যে। শুধুমাত্র কিছু সংখ্যক ব্যক্তি-মানুষের পকেট ভারী হচ্ছে।
রাজনীতি আর সংস্কৃতিকে মিলেমিশে থাকতে হয়। দুটো ভিন্ন স্রোত হলে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। ’৫২-তে সংস্কৃতিকর্মীদের প্রতিবাদী গান, ’৬৩-তে ছায়ানটের রবীন্দ্রসংগীত আন্দোলন, ’৬৯-এর সর্বাত্মক প্রতিবাদ আর ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করেছিল অহিংস সাংস্কৃতিক আন্দোলন। কিন্তু সময়ের আবর্তনে সেসব আন্দোলন যেন অনেকটাই স্তিমিত। যদিও গণজাগরণের শুরুর দিকে তা আবারও জ্বলে উঠেছিল শেষ সময়ের নিভে যাওয়া সলতের মতো। কিন্তু কিসের যেন আক্ষেপ রয়ে গেছে।
শুরুতে যে কথাটা বলেছিলাম, শহীদ সন্তানদের আক্ষেপ হয়তো কিছুটা ঘুচেছে, কিন্তু যে স্বপ্ন নিয়ে স্বপ্ন সারথিরা দেশ স্বাধীন করেছিলেন, তার কতটা সফল রূপ আমরা দেখছি। এখনো সুসংহত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চলছে। মানুষের অধিকার আদায় বৈষম্য বিলোপের সংগ্রাম থেকে নেই। আদিবাসী, সংখ্যালঘুরা এখনো ফিরে পায়নি অধিকার। তাই আমাদের জেগে উঠতে হবে স্বপ্ন ভেঙে। নইলে শহীদদের প্রতি কবি আসাদ চৌধুরীর কবিতার পঙক্তির মতো বলতে হবে, ‘তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?’
শান্তনু চৌধুরী : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, সময় টেলিভিশন