বাংলার মুখ
ছিটমহলে সুবাতাস, তিস্তাপারে দীর্ঘশ্বাস
৬৮ বছর ধরে ছিটমহলের মানুষ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছে, তাদের পার্শ্ববর্তী দেশের জনগণ অসুস্থ হলে সরকারি চিকিৎসা নিয়েছে, বন্যা-খড়ায় সম্পদ নষ্ট হলে সরকার কিংবা বেসরকারি সংস্থা পাশে দাঁড়িয়েছে। ছিটমহলের বাইরের শিশুরা স্কুলে যেতে পারে, ছিটমহলের মানুষ নিজেদের সন্তানকে স্কুল দিতে হলে সন্তানের মিথ্যা ঠিকানা ব্যবহার করতে হয়। ছিটের ভিতরে বিদ্যুৎ নেই, সড়ক নেই। নিজ দেশের মুদ্রার প্রচলন নেই। ছিটমহল থেকে বাইরে বেরুলেই ছিটমহলবাসী দেখে পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বিপদে পড়লে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা। ছিটমহলের মানুষ দীর্ঘ ৬৮ বছর ধরে অসহায়ের মতো শুধু চেয়ে চেয়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের মানুষদের দেখেছে আর নিজেদের কষ্টের রংকে আরো গাঢ় করে তুলেছে। ছিটমহল বিনিময়ের সিদ্ধান্তে তাদের আনন্দের গভীরতাই বলে দেয়, তারা কত গভীর যন্ত্রণাবিদ্ধ জীবন অতিবাহিত করছিল। মিথ্যার বৃত্তে বন্দী জীবন ছিল ওদের।
দীর্ঘ ৬৮ বছরের মিথ্যাচার, নিজ দেশে পরবাসীজীবন, অভিভাবকহীনতা সবকিছুর অবসান ঘটছে ছিটমহলবাসীর। ৩১ জুলাই মধ্যরাত থেকে কার্যকর হয় ছিটমহল বিনিময়। সে কারণে ছিটমহলগুলোতে আনন্দের বন্যা। স্বস্তির সুবাতাসে ভরপুর। ছিটমহলবাসী যেন প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে। বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে ছিটমহলবাসীর জন্য। সরকারের এ উদ্যোগে ছিটমহলবাসী আরো উল্লসিত। ছিটমহলবাসীর জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সড়ক, বিদ্যুৎ, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার কাজ চলছে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিটমহল পরিদর্শন করেছেন। ছিটমহলে বিগত ৬৮ বছরে যে জমি বিক্রি হয়েছে সেই জমির বৈধ মালিকানা অনেকেরই হয়নি। সদ্য বিলুপ্ত ছিটমহলের সমন্বয় কমিটির দাসিয়ার ছড়ার সাধারণ সম্পাদক মোজাফফর হোসেন বলছিলেন, ‘আমরা তো জমি কেনা-বেচা করেছি সাদা কাগজে লিখে। কয়েকজন লোক শুধু সাক্ষী থাকত।’ সেই সাদা কাগজ তো আইনি কাগজ নয়। অনেকেই ছিটমহলের জমি বিক্রি করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে বাড়ি করেছে। তারা যদি এখন সেই জমিতে অধিকার দাবি করে সেই সমস্যা কীভাবে দূর হবে? জমির প্রকৃত মালিক যদি জমি থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে তাদের বাকি জীবন আদালতের দ্বারেই হয়তো কেটে যাবে।
ছিটমহলবাসী এ বছর প্রথমবারের মতো উদযাপন করল বাংলাদেশের বিজয় উৎসব। এর আগেও তারা বিজয় দিবস পালন করেছিল। কিন্তু সেটা ছিল বন্দী জীবন থেকে বিজয় উৎসব পালন করা। আর এ বছরই প্রথম তারা স্বাধীনতার স্বাদ নিয়ে প্রকৃত উৎসব যাপন করল।
ছিটমহলে যখন আনন্দ আর আনন্দ, ঠিক তখন তার উল্টো চিত্র তিস্তা তীরবর্তী মানুষের এবং তিস্তা সেচপ্রকল্পে এক সময়ের সুবিধাভোগীদের। অধিক শোকে তারা যেন পাথরের মতো হয়ে আছে। কিছুদিন আগে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার খলেয়া ইউনিয়েনের বাসিন্দা বাবলু বলছিলেন, ‘তিস্তায় পানি না থাকার কারণে ধান চাষে অনেক ক্ষতি হইছে। অনেকে বালিশ চাপা দিয়া কান্দেতেছে। যারা জমির ওপর নির্ভর করি বাঁচে, তাদের জমি বিক্রি করি খাওয়া ছাড়া উপায় নাই।’ পাশেই দাঁড়ানো একই ইউনিয়নের লালচাঁদপুর গ্রামের বাসিন্দা বলছিলেন, ‘টিভির পর্দাত দেখছি মোদি তিস্তা নিয়া কোনো কথা কবার চায় না। পানিটাই এক নম্বর সিরিয়াল। ওইটার আলাপ নাই।’ সলেয়াহ শাহ বাজারের মায়ের দোয়া নামে এক ভ্যারাইটিজ স্টোরের দোকানি আলমগীর তিস্তা প্রসঙ্গে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নীরবতার কথা বলতে গিয়ে বলছিলেন, ‘দেশের স্বার্থে কেউ আন্দোলন করে না। বিএনপি-আওয়ামী লীগ শুধু চেয়ারের জন্য আন্দোলন করে। সাধারণ মানুষের জন্য কেউ নাই।’ রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকারচলি ইউনিয়েনের বালাবাড়ি বাজারে ছোট্ট চায়ের দোকানে তিস্তা প্রসঙ্গ তুলতেই বিভিন্ন বয়সী ২০-২৫ জন লোকের সমাগম হয়েছিল। সবার কণ্ঠে ক্ষোভ আর হতাশা ঝরে পড়ছিল। মশিয়ার নামের একজন বলছিলেন, ‘মেম্বার-চেয়ারম্যানোক পানির কথা কছি। আন্দোলন করলে তো সরকার ধরি নিয়া যাইবে। সে জন্য আল্লাহক বিচার দিছি।’ আফজাল নামের একজন অশীতিপর বৃদ্ধ আত্মবিশ্বাসের সাথেই যেন বলছিলেন, ‘তিস্তা নদীর পানি দেবে; মোর বিশ্বাস হয় না।’ ভিড়ের মধ্য থেকে একজন বলছিলেন, ‘আমরা তো ভাবছিলাম মোদি-মমতা তিস্তার পানি নিয়া কথা কবার জন্য আসছিল। পানির কথাই না কইবে তা আসছিল কেন?’
২০১১ সালে মনমোহন সিং এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলাদেশ সফরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পানি বণ্টন চুক্তিতে বাধা দেন এবং বাংলাদেশ সফর বাতিল করেন।
২০১১ সালের তিস্তা বাস্তবতা আর ২০১৫ সালের তিস্তা বাস্তবতা এক রকম নয়। ২০১১ সালে ভারত তিস্তার সবটুকু পানি এক তরফা প্রত্যাহার করেনি। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে তিস্তার পানি এক তরফা প্রত্যাহার করেছে। সে কারণে বাংলাদেশের জন্য ২০১১ সালের চেয়েও জরুরি হয়ে পড়েছে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হওয়া। বাংলাদেশ-ভারত প্রসঙ্গে বাংলাদেশের এক নম্বর এজেন্ডা হওয়া উচিত ছিল তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি এবং মমতার বাংলাদেশ সফরে সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেওয়া হলো তিস্তা ইস্যুকেই। তিস্তাপারের কোটি মানুষের মলিন মুখ, অসহায় অবস্থা, চোখে মুখে অনিশ্চয়তার শঙ্কা— সব কিছুই বাংলাদেশ-ভারত সরকারের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে?
গত ৮ জুন প্রথম আলোয় প্রকাশিত অ্যাকশন এইডের গবেষণানির্ভর ‘তিস্তাপারের ৩৫ শতাংশ মানুষ পেশা হারিয়েছে’ শীর্ষক খবরে তিস্তায় পানি না থাকার কারণে সৃষ্ট ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে যৌথ নদী কমিশনের সদস্য মীর সাজ্জাদ হোসেনের মন্তব্যেই বোঝা যায়, তিস্তা সম্পর্কে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা কতটা অজ্ঞ। তিনি নদীনির্ভর মানুষের ক্ষয়ক্ষতির দিকটি আমলে নিতে চান না। এমনকি জেলে-মাঝিদের পেশা হারানোর ঘটনাটিকে স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেছেন। শুধু তাই নয় তিনি বলেছেন, ‘আগের চেয়ে ভাঙনের পরিমাণ বরং কমেছে।’ এই যদি হয় যৌথ নদী কমিশনের সদস্যের মতামত, তাহলে তারা ভারতের কাছে পানির দাবি করবে কীভাবে?
বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ চেষ্টায় ছিটমহল বিনিময় হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাওয়ার মতোই একটি কাজ। কিন্তু তিস্তাপারের মানুষ যে প্রতি মুহূর্তে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে তা কি বন্ধ হবে না ? তিস্তায় শুকনো মৌসুমে পানি থাকে না— এর সম্পূর্ণ দায় ভারতের। তিস্তা নিয়ে নদীকর্মীরা যত আন্দোলনই করুক না কেন, সিদ্ধান্ত নিতে হবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। সেই রাষ্ট্রই যদি তিস্তার বিষয়ে উদাসীনতার পরিচয় দেয়, তাহলে এ সমস্যা দূরীকরণে কে ভূমিকা পালন করবে? উভয় দেশের সরকার যতই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুক তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি, এতে কিন্তু প্রকৃতি থেমে থাকবে না। প্রকৃতি এতে বিমুখ হবে এবং উত্তরাঞ্চলকে মরুভূমিতে পরিণত করবে। সে কারণে উত্তরাঞ্চল বাঁচাতে তিস্তায় পানি প্রবাহ ঠিক রাখার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।