পৌর নির্বাচন ২০১৫
মহা আশঙ্কা অন্তরে
‘সকালবেলা চায়ের সঙ্গে সংবাদপত্র’ বলে এটা কথা প্রচলিত আছে। অনেকে চায়ে চুমুকের সঙ্গে সঙ্গে হাতে সেদিনের পত্রিকাটি চান। অবশ্য এখন ইন্টারনেটের বহুল প্রসারের যুগে নেটেই চলে খবর জানার কাজ। এর পরও পত্রিকার আমেজ যেন আলাদা। তো, পত্রিকা পাঠের জরিপ থেকে জানা গেছে, অনেকে শুরুতে পড়ে ফেলেন রাশিফলটা। মানে দিনটা কেমন যাবে। বিশ্বাস থাকুক আর নাই বা থাকুক। বিষয়টি বিবেচনা করে আমাদের দেশের কোনো কোনো পত্রিকা পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাশিফল লেখে, যাতে দিনের শুরুতে মনটা খারাপ না হয়। এত কথা বলার একটাই কারণ, এখন পৌর নির্বাচন নিয়ে যে হারে ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে নেতা-নেত্রীরা জ্যোতিষীকেও হার মানিয়েছেন!
পৌর নির্বাচন দলের অধীনে হলেও মূলত দুটি দলই এখন ফ্যাক্টর। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতাহীন বিএনপি। শুরু থেকে বিএনপি নির্বাচন কমিশনকে কটূক্তি করে আসছে। এর মধ্যে ‘অথর্ব’, ‘মেরুদণ্ডহীন’, ‘চামচা’—এগুলো কোনোমতে উচ্চারণ করা যায় আর কি। সঙ্গে তাদের নির্বাচন কমিশন নিয়ে সোজাকথা, এদের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। প্রতিদিনই বিএনপির কোনো না কোনো প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনে যাচ্ছে আর নানা নালিশ জানিয়ে আসছে। সেনা মোতায়েনের দাবিও জানিয়েছে। এর মধ্যে দলটি বলা শুরু করেছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে দেশের ৮০ ভাগ মানুষ তাদের ভোট দেবে। কী করে তারা কী বুঝল, কে জানে! এরই মধ্যে দলটি বিদেশিদের কাছে নির্বাচন নিয়ে নালিশও করে ফেলেছে।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। তারা বলছে, নির্বাচন কমিশন তাদের সঙ্গে নির্দয় আচরণ করছে। কিন্তু বাস্তবতা এই, তাদের দাপটে এলাকাগুলোয় হালে পানি পাচ্ছে না অন্য দলগুলো। নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে অনেক এমপিকে সতর্কও করেছে। ক্ষমতাসীন দলটি বলছে, তাদের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে মন্দ লোক মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে। আর এরশাদের জাতীয় পার্টির কথা নাই বা বললাম। এরা নানা সময় নানা কথা বলে। সে কারণে কোনটা সত্য, বোঝা মুশকিল। সর্বশেষ দলীয় প্রধান শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে। অবশ্য সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সংশয় অনেকের। প্রধান বিচারপতিও শঙ্কার কথা জানিয়েছেন (ডেইলি স্টার, ১২ ডিসেম্বর-২০১৫)।
সুশাসনের জন্য নাগরিক বলছে সংশয়ের কথা। তারা অবশ্য সংশয়ের নানা কারণও তুলে ধরেছেন। নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন এবং যাঁদের প্রার্থী করা হয়েছে, তাঁদের অনেকের নামে মামলা, শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ নানা সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশের শাসন-পরিস্থিতি নিয়ে এক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘কেউ সংবিধান লঙ্ঘন করলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশন বাধ্য। কিন্তু অকার্যকর নেতৃত্ব আর নির্বাহী বিভাগের চাপে এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নির্বাচন কমিশনের নেই। ফলে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন বাংলাদেশের জন্য দূরের লক্ষ্য হিসেবেই রয়ে গেছে।’ অর্থাৎ সরকারের জন্য একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে সংশয় থেকে রক্ষা করা। দশম জাতীয় সংসদ, উপজেলা ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের পর যে ঝামেলা হয়েছিল, তা যেন এবার না হয়, সেটাই দেখতে চান জনগণ। দীর্ঘ সময় ধরে বিএনপি ‘রকিবউদ্দীন’-এর বিরুদ্ধে যে ‘অপপ্রচার’ চালিয়ে আসছে, সেটার সমুচিত জবাব দেওয়া যেত। কিন্তু গেল কয়েক দিনের পরিস্থিতি তো তা বলে না!
আজ (২৮ ডিসেম্বর) মধ্যরাত থেকে বন্ধ প্রচার-প্রচারণা। এর আগে গেল কয়েক দিনের পত্রিকায় চোখ বুলালে দেখা যায়, ময়মনসিংহের ত্রিশালে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থীর সমর্থকদের হামলা, শরীয়তপুরে দুই মেয়র প্রার্থীর কার্যালয়ে হামলা, প্রশাসন ও সরকারি দলের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ এনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন সাতকানিয়ার বিএনপি মেয়র প্রার্থী, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার কুয়াকাটায় বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীকে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে, যশোরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে পাল্টাপাল্টি হামলা ও ভাঙচুর, বরগুনার বেতাগীতে বিএনপির মেয়র প্রার্থীর বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর; নড়াইলে আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বক্তব্য দিয়েছেন, ‘নৌকাকে জেতাতে যা যা করা দরকার, তা-ই করবেন’; পাবনার ঈশ্বরদীতে পৌর বিএনপি নেতার ওপর হামলা হয়েছে, কুড়িগ্রামের উলিপুরে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মীর নাছিরের ওপর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় নির্বাচনী প্রচার চালানোর সময় হামলা হয়েছে, হামলা হয়েছে জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে। লক্ষ্মীপুরে বিএনপি প্রার্থীর বাড়িতে, কুমিল্লার লাকসামে হামলার শিকার হন বিএনপি নেতা আনোয়ারুল আজিম, জামালপুরে বিএনপির দুই প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে, যশোর ও সিরাজগঞ্জে দুই মেয়র প্রার্থীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে, ঝিনাইদহে নৌকা প্রতীক পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এগুলো গত চার দিনের খবর। শুধু রোববার দেশের অন্তত ১৫টি জায়গায় হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ২৩৪টি পৌরসভার মধ্যে প্রায় অর্ধশত পৌরসভায় দেখা যাচ্ছে সংঘাতময় পরিস্থিতি। তাই শঙ্কা নিয়েই অনেকে ভাবতে বসেছেন, ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে তো?’ সবচেয়ে যে বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে তা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের ‘উটপাখি’ হয়ে থাকা। শুধু সতর্কতা নোটিশ আর কয়েকটি থানার ওসিকে বদলি করেই যেন দায়িত্ব শেষ করে ফেলতে চাইছেন। আর এবার তো মিডিয়ার ওপরও কড়াকড়ি বেড়েছে, যেন ভোট নিয়ে যারা কারচুপি করছে তাদের দোষ না, যারা দেখছে তাদের দোষ! এবার তাই মিডিয়ার অবাধ বিচরণ বন্ধ করা হয়েছে। মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের হাতে। বুথে যাতে কেউ অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অথচ অতীতে মিডিয়া অন্যায় চিত্র আর আইনশৃঙ্খলার প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরে গণতন্ত্রের হাত শক্ত করেছিল।
আর একদিন পরেই ভোট। ভোটার থেকে শুরু করে প্রার্থী—কারো যেন ঘুম নেই। উৎসবের আমেজ। কিন্তু সেই উৎসব নিমেষেই থেমে যাবে যদি সংঘাতের শঙ্কা মনের মধ্যে ঢোকে! যদি ভোট দেওয়ার অধিকার হারানোর অবস্থা তৈরি হয়! যদি ভোট বিক্রি হয়ে যায় পানির দামে! শেষ করার আগে ভোটের একটা গল্প মনে পড়ে গেল।
ভোট গণতান্ত্রিক অধিকার, তাই ভোট দেওয়া শেষে একজন নাচছে। লোকজন জানতে চাইল, ‘নাচছিস কেন?’ ‘নান্টুদা জিতে গেছে!’ ‘নান্টুদা জিতে গেছে, তাতে তোর কী?’ জানতে চাইল সবাই। ‘পল্টুদা হেরে গেছে!’ ‘তাতেই বা তোর কী?’ আবারো জিজ্ঞাসা। ‘পল্টুদা চোর ছিল, নান্টুদা আরো বড় চোর!’ ‘তা তুই নাচছিস কেন?’ ‘অভ্যেসে নাচছি!’ (আমি মুখ্যসুখ্যু মানুষ : নচিকেতা)।
আমরা অভ্যাসে নয়, ভোট দেওয়ার আনন্দে নাচতে চাই। সংঘাতের বিকৃত বাসনায় নয়, জয়ের আনন্দে নাচতে চাই। চাই, আঁধার যেন না ঘনায় মন্দ মন্থরে!
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, সময় টেলিভিশন।