শিক্ষা
বই উৎসব ২০১৬
প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের হাতে বই তুলে দেওয়া একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। সেজন্য নতুন বছরের জানুয়ারি মাসের পহেলা তারিখে সরকার বই উৎসবের ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা হলো সার্বজনীন অর্থাৎ বিনাখরচে সব শিশুর জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেজন্য আগে প্রতি বছরের শুরুতে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রত্যেক ক্লাসের ছাত্রদের বিনামূল্যে নতুন একসেট বই বিতরণ করা হতো, কিন্তু এখন তা আরো সম্প্রসারিত করে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত করা হয়ে থাকে।
আমরা জানি, প্রাথমিক পর্যায়ে স্কুলগুলোতে অবকাঠামোগত সমস্যা, শিক্ষক স্বল্পতা, শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব স্কুলের সাথে যোগাযোগব্যবস্থা, প্রকৃত মনিটরিং, শ্রেণিকক্ষে সব শিক্ষকের সমানভাবে মনোযোগ না থাকা, সর্বোপরি শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য ও প্রাইভেট পড়ানোর প্রবণতার কারণে অল্পকতক স্কুলছাড়া বাকিগুলোতে মানসম্পন্ন লেখাপড়া হচ্ছে না। সেই সুযোগে শহরাঞ্চলে তো বটেই এমনকি এখন গ্রামাঞ্চলেও বিকল্প হিসেবে বেসরকারি পর্যায়ে হাজারো কিন্ডার গার্টেন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানেই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বই পড়ানো বাধ্যতামূলক। আর সেজন্যই সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে একই দিনে পাঠ্যবই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়ে থাকে। এবার ২০১৬ সালের বই উৎসব সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে। বছরের শুরুর দিন থেকে দুই দিনব্যাপী এই উৎসব চলবে। সেই হিসেবে জানুয়ারি মাসের ১ ও ২ তারিখ শুক্র ও শনিবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দুইদিনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এজন্য যে, যদি কোনো শিক্ষার্থী ১ জানুয়ারি বই নিতে না পারে, তাহলে তাদের আবার ২ জানুয়ারিতে বই প্রদান করা হবে। সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নোটিশ জারি করা হয়েছে, যদি জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ কোনো বন্ধের দিন হয়, তারপরও সেদিনই বই উৎসব হবে। যে কারণে সেদিন সব প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা রাখার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন চৌদ্দদলীয় মহাজোটের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের পহেলা তারিখে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে একটি উৎসবের আমেজে সবার জন্য নতুন বই তুলে দেওয়া একটি রেওয়াজ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বছরের শুরুতে নতুন ক্লাসে উঠে নতুন বই হাতে পাওয়ার যে কি আনন্দ সেটা ছেলেমেয়েরাই ভালো বলতে পারবে।
১৯৮০-৮১ সালের কথা, তখন স্কুলের বোর্ডের বই পোস্ট অফিসের মাধ্যমে আসত এবং তা সরাসরি ছাত্রছাত্রীদের গ্রহণ করতে হতো। তখন চার-পাঁচ বছর পরপর বই নতুন করে সংশোধিত সংস্করণ ছাপানো হতো, তাও আবার কেবল বাংলা কিংবা ইংরেজি বই। সেজন্য এক বছরের পুরাতন বই বেশ কয়েকবছর চালানো যেত। স্কুলে তখন এভাবে বিনামূল্যে নতুন বই বিতরণের নিয়ম ছিল না। প্রতিবছরই নতুন ক্লাসের জন্য যাদের প্রয়োজন তাদের নতুন বই কিনতে হতো। কিন্তু এখন প্রতিবছরই সরকার থেকেই প্রত্যেকটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে নতুন বই বিতরণ করা হয়ে থাকে। প্রথমদিকে এই কার্যক্রম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দিয়ে শুরু হলেও এখন সব স্কুল ও মাদ্রাসায় তা বিতরণ করা হচ্ছে। এবারে (২০১৬) শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানা গেছে যে, প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, ইবতেদায়ি, মাধ্যমিক, দাখিল, এসএসসি, এসএসসি ভোকেশনাল, দাখিল ভোকেশনাল সব প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে মোট চার কোটি ৪৪ লাখ ১৬ হাজার ৭২৮ জন শিক্ষার্থীকে ৩৩ কোটি ৩৭ লাখ ৬২ হাজার ৭৬০টি বিনামূল্যের বই বিতরণ করা হবে।
১ জানুয়ারি সকাল ৯টায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারি ল্যাবরেটরি স্কুলে এবং একইদিন সকাল ১০টায় ঢাকার মিরপুরে ন্যাশনাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় বই উৎসবের উদ্বোধন করা হয়। এর আগে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে গণভবনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকাল ১০ ঘটিকায় সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতিতে বই উৎসবের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেছেন। বিভিন্ন সাংবাদিক সম্মেলনে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় বারবার দেশবাসীকে এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে, কোনো সংশয় ছাড়াই ১ জানুয়ারি ২০১৬ তারিখের আগেই সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব বই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এবারে দেশি প্রকাশক দিয়ে বই ছাপানোর জন্য সরকারের একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আর সেই কারণে দাতাসংস্থা বিশ্বব্যাংকের সাথে বইয়ের ছাপার মান নিয়ে একটু সংশয়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ছাপার কাজ শুরু করতে কিছুটা দেরি হয়েছে। আর সেজন্য গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা দেখেছি যে, এ বই সময়মতো ছাপানোর জন্য মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী নিজে তাঁর টিম নিয়ে প্রেসে প্রেসে গিয়ে বই ছাপানো তদারকি করেছেন।
সম্প্রতি বই ছাপার কাগজের মান নিয়ে গণমাধ্যমে সচিত্র প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন যে, ‘এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। আমরা কোনো পর্যায়েই মানের সাথে কোনো রকম আপস করব না।’ বই বুঝে নেওয়ার পর পরীক্ষ-নিরীক্ষা করে যদি দেখা যায় যে, সে বইয়ের ছাপা, কাগজ, সংখ্যা ইত্যাদি মানসম্পন্ন নয়, তবে সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বর্তমান সরকার প্রতিবছরই শিক্ষার্থীদের কাছে সুষ্ঠু, সুন্দর ও সময়মতো বই বিতরণ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। কারণ দেখা গেছে, ২০১৩ সালে বর্তমান সরকারের একটি মেয়াদ শেষ হচ্ছিল এবং তার পরপর সেই ঐতিহাসিক জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভিতর দিয়ে ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরও সেই বছর ১ জানুয়ারি সারাদেশে বই উৎসব পালন করা হয়েছিল। ঠিক একইভাবে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথমদিক থেকে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচির ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তারপর সেই বছরও বই সময়মতো বিতরণে কোনো রকম ব্যত্যয় হয়নি। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের বই উৎসব অবশ্যই আরেকটি মাইলফলক তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বই বিতরণের বিষয়টিকে আরো অর্থবহ ও সর্বজনীন করা সরকারের একটি ঐকান্তিক ইচ্ছা। তারই অংশ হিসেবে এবার শিক্ষান্ত্রী বই বিতরণের দিনে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রত্যেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেসব এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধ ও রাজনৈতিক ব্যক্তি, বিশিষ্ট শিক্ষবিদকে ওই উৎসবে উপস্থিত থেকে উৎসাহ প্রদানের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। শিশুদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেও খুবই সংবেদনশীল। তিনি জাতীয় শিশু দিবস পালনের এক অনুষ্ঠানে অহেতুক শিশুদের বইয়ের বোঝা না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে। তা ছাড়া সরকারি স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার আয়োজন না করে সংশ্লিষ্ট স্কুলের এলাকাভিত্তিক মেধাক্রম ও কোটা বিবেচনায় ভর্তির পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ দেখা গেছে প্রতিবছরের শুরুতে স্কুলে ভর্তির জন্য কে কোন স্কুলে ভর্তি হবে, ভর্তির জন্য আবেদন করবে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে একটি হুলস্থূল কাণ্ড হয়ে যায়। অপরদিকে আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়- এখন আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীল পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়েছে যাতে পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষই লেখাপড়া শেষ করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু দেখা গেছে, পাঠ্যবই বের হওয়ার আগেই সেই বইয়ের গাইড বই বেরিয়ে পড়ছে। সে গাইড বইগুলোর আবার অনেক মূল্য। অভিভাবক মাত্রই মনে করেন যে, যদি তার ছেলেমেয়ের জন্য গাইড বই কিনে দেওয়া না যায়, তাহলে হয়তো সে পড়ালেখায় পিছিয়ে থাকবে। সেজন্য স্কুল থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে পাঠ্যবই পেলেও তাদের লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার জন্য পাঠ্যবই থেকে অধিকমূল্যে গাইড বই কিনতে হচ্ছে। তা ছাড়া প্রাইভেট পড়ানো কিংবা কোচিং সেন্টার তো রয়েছেই।
এসব বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবার ভিতর থেকে ব্যবসা মনোবৃত্তি দূর করতে হবে। অপরদিকে স্কুল পর্যায়ে ড্রপআউট কমিয়ে আনার জন্য স্কুল ফিডিং এবং উপবৃত্তির জন্য পাইলট প্রকল্প আস্তে আস্তে সারাদেশে সম্প্রসারিত করতে হবে। আর বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকার এগুলো পদক্ষেপ নিয়ে ফি-বাৎসরিক বই উৎবের আনন্দকে প্রকৃত অর্থে চিরস্থায়ী করবে বলেই সবার প্রত্যাশা।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।