গ্রাম ও উন্নয়ন
উলিপুরে দিন দুয়েক
কৃষি ভুলে যাওয়া একটা জনগোষ্ঠীর কৃষিজীবী হওয়ার জীবন সংগ্রাম দেখলাম কুড়িগ্রামের উলিপুর নামের উপজেলা সদর থেকে মোটরসাইকেলে ঘণ্টা খানেক গিয়ে বুড়াবুড়ির বাজার পার হয়ে এক গহীন চর এলাকায়; শেষ কিলোমিটার যেতে হবে একদম হেঁটে।
জায়গাটা বহু আগে ছিল রীতিমতো ব্যস্তসমস্ত লোকালয়, ধরলার ভাঙনে পুরোটা ধীরে ধীরে তলিয়ে গেল পানির নিচে। অন্যত্র জমিজমা ছিল কিংবা কৃষি ছাড়াও যাদের ভিন্ন উপায় বা সঙ্গতি ছিল, তেমন মানুষগুলো নানান জায়গায় বসতি করলেও বেশির ভাগ কৃষিনির্ভর মানুষ রাতারাতি পরিণত হলো নদীশিকস্তি উদ্বাস্তুতে। তাদের ঠাঁই হলো সরকারি বাঁধের বসতিতে।
এই বাঁধে বাস করা লোকগুলো গ্রামীণ পরিবেশে থাকলেও তাদের বড় অংশ প্রায় পুরোপুরিই বিচ্ছিন্ন হলেন কৃষি থেকে। একজন যেমন রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, 'ধান কাটিছি মনে করেন বগুড়াত, ধান কাটিছি ধামরাই, সিলেট আরো কত জাগা।' কিন্তু বীজ তো তিনি চেনেন না, ফসলের পেছনে শ্রম দিলেও আবাদের পূর্ণ জ্ঞান তার মোটেই নেই। দুয়েকজন কেউ কেউ বর্গায় আবাদের সুযোগ পেয়েছে, বেশির ভাগেরই জীবিকার প্রধান সম্বল হয়েছে দিন মজুরি আর নানান ছোটখাটো ব্যবসা, একটা অংশ হলো শহুরে শ্রমিক কিংবা ছোটখাটো চাকরিজীবী। কিংবা রিকশা-অটো-ভ্যানের চালক। যখন যা পাওয়া যায়। নিজের জমি না থাকলে, নিজ গ্রাম থেকে অনেক দূরে বাস করলে, কৃষির সাথে কোনো সম্পর্ক না থাকলে কৃষির জ্ঞানের উত্তরাধিকার বঞ্চিত হতে থাকবেন, স্বাভাবিক। সারাক্ষণ ছুটে বেড়ানোর জীবিকার চাপ এত প্রবল যে হয়তো দেখে শেখারও সুযোগ থাকে না।
কিন্তু বহু দশক পর ধরলা আবার তাদের জমি ফেরত দিয়েছে। শৈশবে বাঁধের বাসিন্দা থেকে যে মেয়েটা মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকায় পোশাক শিল্পে দুই বছর শ্রম দিয়েছে, সেও সংবাদ পেল তার জমি জেগে উঠেছে। পুরো তিন একর পৈতৃক ভিটার মালিক সে! জমি বালু ভর্তি, পলির পরিমাণ খুব কম। প্রায় কিছু ফলে না। জমির দামও বলা যায় পানিরই দাম। তাতে কি? বাপ-দাদার জমি তো।
এরা সবাই নানায় জায়গা থেকে ফিরে এসে জমি বুঝে নিয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞ চাষাও এই জমি নিয়ে বিপদে পড়ত। না ফলে ধান, না ফলে ভুট্টা, না হয় গম। ধান-চাল তাই কিনে খেতে হয়। মিষ্টি কুমড়া, বাদাম, তরমুজ, তিল আর এই রকম আর কিছু ফসল সেখানে হয়। পরিমাণে খুব ভালো না। একজন দুঃখ করে বললেন, প্রায়ই বীজও নষ্ট হয়। চারা গজালেও এমনও হয় যে, একটা গাছে একটাই ফল ধরে। গরু-ছাগল আছে, তবে ঘাস কম বলে চরের বিশাল প্রান্তরের তুলনায় সংখ্যায় বেশ কম।
মিষ্টি কুমড়ার ক্ষেত দেখতে গেলাম। নারীরা কলসি কলসি জল ঢালছেন গাছের গোড়ায়। দিয়েছেন কেঁচোসার। বালুময় মাটি চো চো করে পানি টেনে নিয়ে তৃপ্ত হয়েছে, কিন্তু বাকি পানিটা নিয়ে নিচ্ছে সূর্যের তাপ আর শুষ্ক শীতের বাতাস।
একটু অবাক হয়েই বললাম, আপনারা কুমড়া গাছের গোড়ায় খড় দেন না কেন? খড়কে এই এলাকায় পল বলে। খড় বিছিয়ে দিলে রোদ আর বাতাস পানি টেনে নেবে না, এই কথা শুনে তারা প্রথমে অবাক হলেও দ্রুতই বুঝে ফেলল কৌশলটা। কথা প্রসঙ্গে জানালাম, এমনকি কচুরিপানাতেও কাজটা খুব ভালো হবে। আর কচুরিপানা-খড় পচে শেষমেষ খুব ভালো জৈবসারের কাজও করবে। সামান্য এই প্রযুক্তিটা জানতাম, কারণ বহুবার নানান এলাকার ক্ষেতখামারে এটা দেখেছি। এরা জানে না, সেটা বিস্ময়ের। কিন্তু এদের পরিপ্রেক্ষিতটা মনে রাখলে হয়তো তা বোধগম্য হবে কিছুটা।
যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির আত্মচরিতে একটা অধ্যায়ের নাম'পবনচক্র'। শিক্ষকতার সূত্রে উড়িষ্যাবাসী ছিলেন কিছুদিন, ১৯০৮ সালে এক বুড়ো উড়িয়া মালীকে কুজো হয়ে কলসি ভরে ভরে সবজি খেত আর ফুল বাগানে পানি দিতে দেখে সেই বৃদ্ধের শ্রম লাঘব করতে যোগেশচন্দ্র প্রথমে বানালেন একটা ঘটচক্র। সারি ধরে বাঁধা ঘট পানিপূর্ণ হয়ে একটার পর একটা কূয়া থেকে উঠতে থাকবে, যাতে মানুষের পুরো শ্রমশক্তি জল তোলার জন্য ব্যয় করা যায়। তারপর শ্রম আরো লাঘব করার জন্য কলকাতা থেকে বইপত্র আনিয়ে সাধারণ জিনিসপত্র ব্যবহার করেই বানিয়ে ফেললেন আস্ত এক বায়ুকল। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর সেই যন্ত্র ধীরে ধীরে আরো কার্যকর হয়ে উঠল। কলকাতায় তখন সাহেবদের বানানো একটা বায়ু কল বিক্রি হতো হাজার টাকায়, বিদ্যানিধি চেয়েছিলেন এমন কল যেখানে খরচ পড়বে ৫০ টাকা। বুড়ো মালী সেই বায়ুকলকে ডাকত ‘পবনচক্র’ বলে।
বিদ্যানিধির কথা আবারও মনে পড়ল এই কৃষকদের দেখে। কাছেই নদী, মাটিও খানিকটা খুড়লেই পানি ওঠে। কিন্তু কী কী জটিলতায় যেন এখন তা হয়ে উঠছে না। একদিন নিশ্চয়ই হবে, তেলে চলা পানি তোলার যন্ত্রও আসবে। তত দিন এই অমানুষিক শ্রম তাদের ঢেলেই যেতে হবে। তাদের নিজেদের প্রযুক্তিজ্ঞান নেই, যোগেশচন্দ্ররাও নেই তাঁদের ত্রাণে এগিয়ে আসবেন, কৃষি প্রযুক্তির কি যন্ত্রের শ্রমশক্তির একদম ভেতর থেকে উন্নতি ঘটে তাদের জীবনটাকে আরেকটু সহজ করবেন।
খড় কিংবা কচুরিপানা দিয়ে পানি ধরে রাখার কৌশলটা জানাতে পেরে তাদের কাছে যেটুকু গুরুত্ব বৃদ্ধি পেল, তাই দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলাম প্রতিটা কুমড়োর গাছের সাথে সিম বীজ বুনে দিলে দুয়েরই ফলন বাড়তে পারে। এটা শিখেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যার এক শিক্ষকের কাছে। বিলেতে পড়তে গিয়ে তিনি আরেকটি গবেষণার সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন, যেখানে তিনি দেখেছেন ভুট্টা আর সীম একই সাথে পাশাপাশি আবাদ করলে এই মজার ফলটা পাওয়া যায়। সীমের জমানো নাইট্রোজেন ভুট্টা চুরি করে, আর সেই ঘাটতি মেটাতে সীম নাকি বাতাস থেকে আরো বেশি নাইট্রোজেন টেনে আনে। বাড়তি নাইট্রোজেন ভুট্টার ফলন বাড়ায়, আর বাড়তি নাইট্রোজেনের চাহিদা মেটাতে সীম যে বাড়তি ব্যায়ামটা করে, তাতে তারও ফলন বাড়ে। এই কাজটাই কৃষকরা আরেকভাবে করে, ডালের পর অন্য শস্য আবাদ করে। কিন্তু একই সাথে চাষ করাটা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো কার্যকর।
একজন অবশ্য মনে হয় বুঝলেন, যদিও ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা খুব গুরুতর জিনিস। বাইরে থেকে প্রযুক্তি প্রচলন করতে দরকার কৃষিপ্রযুক্তি আর অঞ্চলের ভাষা-সংস্কৃতি উভয় নিয়েই যাদের জানাশোনা আছে, তেমন কৃষিকর্মী। ফলে উদ্ভিদ বিদ্যার বন্ধুটির কাছ থেকে পানি ধরে রাখার জাপানি এক কৌশল সম্পর্কে যা শুনেছিলাম, তা আর তোলারই সাহস পেলাম না। তারা নাকি আস্ত পলিথিনের চাদরের ওপর ধানক্ষেত বানিয়ে পানির অপচয় কমাবার কায়দা বানিয়েছে। বালুময় মাটিতে গর্তখুড়ে চরবাসী যেভাবে কুমড়া আবাদ করে, সেখানে পলিথিন ব্যবহার করে হয়তো পানির অপচয় অনেকটাই কমানো সম্ভব। পানি একদম জমে যাওয়া ঠেকাতে নিয়ন্ত্রিত ছিদ্র থাকতে পারে সেই গোলাকারে বেছানো পলিথিনে। ভুট্টা-সীমের যৌথচাষের প্রযুক্তিটা কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী চাষিদের কাছে খুব জানা, তারাই নাকি কয়েক হাজার বছর আগে এর উদ্ভাবন করেছিল। হয়তো গবেষণার মূল ভাবনাটা সেখান থেকেই নেওয়া। ওই আদিবাসী কৃষকরা ভুট্টা, সিম আর শসা একসাথে চাষ করত, এই ফসলত্রয়ীকে তাই তিন বোন বলে ডাকে তারা। ভুট্টা দিত দাঁড়াবার খুঁটি, সিম নাইট্রোজেন আর শসার বড় বড় পাতা আগাছা দূর করত।
কেঁচো সারের কথা বছর কয়েক ধরে শুনছিলাম অনেক। এবার উলিপুরের গ্রামে গ্রামে দেখলাম সেটা বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। এই প্রযুক্তি কৃষকদের রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীলতাকে বেশ খানিকটা কমিয়ে এনেছে। তবে গ্রামাঞ্চলে রীতিমতো আলোড়ন এনেছে নসিমন-করিমন-মাহিন্দ্রা-অটোসহ যন্ত্রচালিত আরো সব বাহন। পরিবহনের এই বিস্তার একদিকে মানুষকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে, কর্মসংস্থানের সুযোগটাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে, আরেক দিকে রুদ্ধ চাহিদাকে মুক্ত করছে, নতুন চাহিদা সৃষ্টি করছে, মুক্ত করছে সংস্কারবদ্ধ সনাতনী মগজকেও। এই অঞ্চলে পাঁচ কেজি চাল যেন ন্যূনতম মজুরি করার জন্য আন্দোলন ছিল আশির দশকে তো বটেই, সম্ভবত নব্বই দশকেও। এক কেজি বা দুই কেজি চালেও অনায়াসে দিনমজুর পাওয়া যেত। এখন দিনমজুরির টাকায় ১০ থেকে ১২ কেজি চাল অনায়াসে পাওয়া যায়।
শিক্ষার চাহিদাও তীব্র হয়েছে। উলিপুরের মতো মফস্বলে রিকশাচালকও সন্তানকে শুধু বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন না, দুইশ-আড়াইশ টাকা বিষয়প্রতি বরাদ্দ করছে বিদ্যালয়ের বাইরের পাঠসহায়তার জন্য। মানেটা পরিষ্কার, দরিদ্রতম মানুষটাও সন্তানকে পড়াতে ঠিকই কয়েকশ টাকা মাসপ্রতি ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছেন, শিক্ষাটা যদিও মাগনা। মাননিয়ন্ত্রণের অভাবে চিকিৎসার বেলায় মানের যে সংকট হয়, শিক্ষার বেলাতে সেটা তাই আরো তীব্র। আপনি অজস্র টাকা খরচ করলেই যে ভালো চিকিৎসা পাবেন, তার কোনো নিশ্চয়তা নাই। কারণ সেবার মানের তদারকি কেউ করছে না। চিকিৎসায় অসুখ ভালো না হলে রাতারাতিই তা বোঝা যায়, শিক্ষার মানহীনতা অভিভাবকের কাছে তো অত জলদি ধরা পড়ে না।
বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা পড়ান না, কারণ সরকারের দেওয়া ওই বেতনে তাঁদের চলে না, তাঁদের বাড়তি আয় করতে হয়। শিক্ষক সমাজের আর্থিক ঘাটতি মেটাতে শিক্ষার্থীদের একটা অংশ তাই যায় নিজ বিদ্যালয়েরই শিক্ষকদের কাছে, একটা অংশ যায় সদ্য বেকার, অর্ধবেকার কিংবা বয়োঃজেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের কাছে। প্রায় সর্বত্র চলে মুখস্ত বিদ্যার মহড়া, কারণটা শিক্ষাদাতার সময়ের অভাব না শুধু, প্রশিক্ষণেরও ঘাটতি। শিক্ষাবাজারে তাই অজস্র টাকা উড়ছে, বড় অংশটাই এভাবে অপচয়ও হচ্ছে, অর্থ আর সময় উভয় দিক দিয়েই। কিন্তু যদি বলেন এতে বহু লাখ অভুক্ত শিক্ষাদাতারও জীবনের প্রয়োজন মিটছে, তা অস্বীকার করার জো নেই। রাষ্ট্র খরচ করছে না, অথচ শিক্ষার পেছনে টাকা ঠিকই খরচ হচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে রাজনীতির কর্মসূচি কী হতে পারে, সেটা নিয়েও আরেকবার ভাবতে বসা দরকার। অভিভাবকরা যদি খরচ করতে বাধ্য হনই, যোগ্যতর শিক্ষককে নিয়োগ এবং সামাজিক উদ্যোগে খরচটা সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াটাকে কার্যকর করার চেষ্টা করা, না কি রাষ্ট্রকে রাজনৈতিক উদ্যোগ নিয়ে বাধ্য করার চেষ্টা, কোন পথটা বেশি কার্যকর হবে আপাতত, কিংবা উভয়ের মাঝে কি সত্যিকার কোনো বিরোধ আছে, সেই ভাবনা আবারও পেয়ে বসে।
উলিপুর শুধু না, কুড়িগ্রামেরও শুধু না, বাংলাদেশের প্রায় সব গ্রামবাসীই নাকি কোনো না কোনো এনজিওর আওতাধীন। তাদের আছে নিজস্ব কার্যালয়, পরিবহন, থাকার বন্দোবস্ত, গবেষণা আর নানান কর্মসূচি, সর্বোপরি বিশাল কর্মীবাহিনী। বাংলাদেশের গ্রামঞ্চলে গত ৩০ বছরে যে পরিবর্তন হয়েছেন, তার একটা কৃতিত্ব তারা দাবি করে। আবার অনেকেরই মত, যে বিপুল পুঁজিবাদী রূপান্তর গ্রামীণ সমাজে ঘটেছে এই কয় দশকজুড়ে, তারই প্রত্যক্ষ ফল এই পরিবর্তন। বেশির ভাগ স্থলেই সরকারের যা দায়িত্ব ছিল, তাই এনজিওদের দিয়ে করানো হয়েছে। ঋণ আকারে পুঁজি বিতরণ বা যেকোনো বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজটা বহু ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে দিয়েই পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু গ্রামবাসী কতটুকু সচেতন হওয়ার অধিকার বা এখতিয়ার রাখে, বা কার্যক্ষেত্রে ভোগ করে, কতখানি করে না, সচেতন থেকে কতখানি অর্জন করতে পারে, অসচেতন থেকে কী কী হারায়, সেটা একটা দারুণ গবেষণার বিষয়।
প্রায় ৪০ শতাংশ কিংবা তারও বেশি সুদ দিয়ে বাংলাদেশের গ্রামের মানুষ হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগল পুষছে। যারা নিয়মিত কোটি কোটি টাকা মুনাফা করে, ইচ্ছেমতো দামের ফাটকা খেলে, তাদের জন্য সুদের হার বিশ ভাগের কম, বহু ক্ষেত্রে আস্ত ঋণটাই মেরে দেয়। কিন্তু নিজেদের উৎপাদিত সব পণ্যের দাম নির্ধারণের বেলায় যে মানুষগুলো বাজারের হাতে বন্দী, যাদের মুনাফার হার সবচে কম, ওই বিপুল সুদের বোঝা তারা কীভাবে সামলায়, সেই রহস্যটা বোঝা যাবে ক্ষুদ্রঋণের এলাকার মানুষগুলোর প্রধানতম আয়ের উৎসগুলোর দিকে তাকালে—মজুরি। সদ্য মুদ্রাঅর্থনীতি গেছে গ্রামীণ বাজারে, কিন্তু নগদ টাকা তেমন কারো হাতে নেই, এমন একটা সময়ে ঋণের যে চাহিদা থাকে, তাই ক্ষুদ্রঋণের ব্যবসার রমরমা অবস্থা। মানুষ রীতিমতো তার শরীর ক্ষয় করে এই ঋণের টাকা শোধ করছে। কিন্তু এই ঋণের চাহিদা তার প্রবলভাবেই ছিল, এটা অস্বীকার করা যাবে না কোনো ভাবেই। নিশ্চয়ই কার্যকর কৃষিব্যাংক আর ঋণের কার্যক্রম দিয়ে অনেক মানবিক একটা প্রক্রিয়ায় এই রূপান্তরটা সম্ভব হতো।
এ কারণেই সুদের হার যতই চড়া হোক, গ্রামের মানুষের সাথে ঋণদানকারী এনজিওগুলোর তেমন কোনো শত্রুতার বোধ সম্ভবত নেই। সুদের হার অনেক বেশি, কিন্তু ঋণ পাবার যে অধিকার গ্রামবাসীর ছিল, রাষ্ট্র চাইলেই সুদের হারটাকে যে নিয়ন্ত্রিত করতে পারত, সেই ‘সচেতনতা’ই যে এখানে অনুপস্থিত! বরং যারা আগে এনজিওর সাথে যুক্ত হতে পেরেছে, তারাই পুরোনো গ্রামীণ বন্ধনের শেকলটা থেকে আগেভাগে মুক্ত হতে পেরেছে।
এনজিওর বিরুদ্ধে আর যে একটা প্রতিরোধ ছিল, সেটা প্রবল পুরুষতান্ত্রিক। ‘রাস্তা নষ্ট টেরাকে, মাইয়ে নষ্ট বেরাকে’; অথবা’ ‘রাস্তা নষ্ট টেরাকে, গ্রাম নষ্ট বেরাকে’—উভয় সংস্করণের মাঝেই পুঁজিবাদ গ্রামীণ জীবনে যে রূপান্তর নিয়ে এসেছে, নারীকে মাঠে-ময়দানে, এমনকি হুকুম দেওয়ার জায়গাতেও তুলে ধরেছে, তার বিরুদ্ধে পুরুষতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়াই প্রবল। মেয়ে কিংবা গ্রাম নষ্ট হওয়াটা এখানে সনাতন ক্ষমতাসম্পর্ক ভেঙে পড়ার প্রতীক, বেরাক শুধু এনজিওকূলের না, যে নতুন আর্থ-সামাজিক শক্তিগুলো গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোকে পুনসজ্জিত করেছে, তার প্রতীক। বলা যায় সামন্ত অবশেষের সাথে পুঁজিবাদের বাংলার গ্রামীণ সংস্করণের দ্বন্দ্ব, দুই ভিন্ন সংস্কৃতির বিবাদ। নব্বই দশকের শেষের দিকে কওমি মাদ্রাসা বনাম এনজিওর লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এই বিরোধ চূড়ান্ত পর্বে উঠেছিল। খুব সম্ভবত এই ক্ষোভ এখন ম্রীয়মান। পুনঃসজ্জার ধরনটি গ্রামাঞ্চলে ক্ষমতাকাঠামোকে অনেক খানি বদলে দিলেও পুরনো ক্ষমতার প্রতিনিধিরাও মোটেই উচ্ছেদ হননি, নতুন বন্দোবস্তে তাঁরা ভালোই ঠাঁই করে নিয়েছেন। অন্যদিকে সাধারণ চাষাভুষা যে মানুষ তার কন্যাটি পোশাক শিল্পে কাজ পেলে খুশি, কিছু পাস দিয়ে এনজিওর কর্মীর চাকরি তো সেখানে রীতিমতো আরাধ্য। কিন্তু পুরোনো কূপমণ্ডূকতা, অন্ধত্ব আর মোড়লপনাও রাজনৈতিক দলের ছায়ায় ভালোই টিকে আছে।
তহবিল নির্ভর উন্নয়নের আরো বহু রকম ফ্যাকড়া থাকে। এক চরে যেমন শুনলাম একটা বিদ্যালয়ের কথা, তহবিল শেষ তো সেটা বন্ধ। নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর কী হবে, সে খবর কে নেবে? সরকার কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন একটা জনগোষ্ঠী বাধ্য করতে পারে। অসচেতন জনগোষ্ঠী সরকারি সংস্থার কাছ থেকে কিছুই প্রায় আদায় করতে পারে না। বেসরকারি সংস্থা তো বেসরকারিই। কিন্তু আপাতদৃশ্যে বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা তুলনামূলকভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিজেদের কাজের লক্ষ্য পূরণে অধিকতর সক্রিয়, বহু স্থানেই জনগোষ্ঠীকে নির্দিষ্ট কিছু কিছু বিষয়ে তাঁরা সচেতন করেছেন।
কৃষকরা সচেতন হয়ে ফলন বাড়ালে দামও যে সাথে সাথে পড়তে থাকে! বাজার এত নিষ্ঠুর থাকে বলেই ওষুধ আর কীটনাশক ব্যবহারের প্রবণতাও বাড়ছে। এর বিপদ দুটি, প্রথমত যে প্রযুক্তিই আসুক না কেন, অচিরেই সবাই তা ব্যবহার করে দামটাকে আরো কমিয়ে দেবে। দ্বিতীয়ত, বাকি সবাই ক্ষতিকর প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাড়তি ফসল ফলালে কিংবা দ্রুত ফল পাকানো বা ঝটপট গরুটাকে মোটাতাজা করলে, বাজারের নিয়মের বাইরে গেলে আপনি বিপদে পড়বেন। এভাবেই ক্রমহ্রাসমান খাদ্যমান সুনিশ্চিত হচ্ছে। সব টমেটো কৃত্রিমভাবে পাকানো। সব গরু ইউরিয়া মেশানো খড় খাইয়ে বিক্রির উপযুক্ত করা। সব সীমে পোকা না ধরানোর জন্য বিষ ঢালা, বিজন চরের গাছটাও এর ব্যতিক্রম নয়। কৃষক আর কৃষি ডিপ্লোমাধারী এনজিও কর্মীর একটা কথোপকথনে বুঝতে পারলাম, পরে জানলাম- আরো বিষাক্ত সব ওষুধ ব্যবহার করা হয় দুধ উৎপাদন নিয়মিত রাখতে, গাভীকে গর্ভধারণে ইচ্ছুক করতে, এমনকি কোনো কারণে হাড়ে মজ্জায় দুর্বল গরুকে রাতারাতি চাঙা করে বাজারে বিক্রি করতে। যে উদাসীনতা আর অবিচারে আমরা আমাদের গ্রামগুলোকে শাসন করছি, তার সব বিষ আমাদের দেহেও জমা হচ্ছে ভেবে কি প্রতিশোধের আনন্দ পাবেন? বাজারের নিয়মের বাইরে যাওয়ার সামর্থ্য যার আছে, তেমনি সব সত্যিকারের ‘সচেতন’ ধনীরা নিজেদের খামার আজকাল নিজেরাই বানিয়ে নিচ্ছে।
পেয়ে গেলাম একটা সমিতিকেও। বিরল বিষয় হলো খুবই গণতান্ত্রিক কায়দায় চলে এটা, নির্বাচিত সদস্যরাই এটা পরিচালনা করে। সূচনাতে ভূমিকা রেখেছিল একটা বৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। গ্রাম আর শহরে ফসলের দামের পার্থক্য নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে বললেন, কারওয়ান বাজারে আলু বিক্রি করতে এসে এত চাঁদাবাজির শিকার হয়েছিলেন সমিতির কয়েকজন যে আর সাহস করেন না। গত কোরবানির ঈদেও গরু-ছাগলের ব্যাপারী হয়ে ঢাকায় গিয়েছিলেন ক’জন, বিক্রি শেষে তারাও ছিনতাইকারীদের শিকার হয়ে সর্বস্ব খুঁইয়েছেন। বাকিদের জন্যও এটা যথেষ্টই শিক্ষা হিসেবে কাজ করেছে।
এলাকায় সমিতির প্রতাপ আছে, এবারের নির্বাচনে সবাই ধরনা দিচ্ছে। আপনারা নিজেরাই কেন নির্বাচন করছেন না? প্রশ্ন করাতে সভাপতি বললেন, তেমন ভাবনা তাঁর ছিল বটে, কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে... সামাজিক উদ্যোগের সীমাটা এভাবে নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে দেশের প্রাধান্যশীল রাজনীতি আর অর্থনীতির দখলদারত্বের প্রেক্ষাপটের মাঝে। এই ধরনের অজস্র সমবায় সমিতি না বানিয়ে এবং খুদে উৎপাদকদের ক্রেতা পর্যন্ত পৌঁছাবার বন্দোবস্তের সংগ্রাম না করে বাংলাদেশে কি আর কোনো কৃষক আন্দোলন দানা বাঁধতে পারবে?
বাংলার এই গ্রামসমাজে বহুকালের যা কিছু সঞ্চয়, পুঁজির তীব্র উলট-পালট প্রক্রিয়ায় তার বড় অংশ হারাতে বসেছে। অথচ বলতে গেলে যন্ত্রের সুবিধাটা খুব স্থুল পর্যায়ে পাচ্ছে তারা, বলা যায় নগণ্য পর্যায়ে। ভেতর থেকে প্রযুক্তিগত বিকাশ খুব সামান্য, পরিবহনের বেলায় সেটা রীতিমতো রাষ্ট্রীয় খড়্গের নিচে থাকা। মোটামুটি ১৮ লাখ ক্ষুদ্র বাহন চলে নাকি গোটা দেশে, সবই প্রায় ভারত আর চিন থেকে আমদানি করা। ৫০ মিনিটে উলিপুর থেকে এখন যেতে পারবে কুড়িগ্রাম জেলা সদরে। রংপুরে যেতেও খুব সময় লাগে না, ওই তিন চাকাতেই। ছাত্র পড়াতে যাওয়া, চাকরি করা কি ফসল হাটে নেওয়া, এগুলোই প্রধান বাহন। সহজ প্রযুক্তির এই বাহনগুলো দেশে উৎপাদিত হলে বিপুল কর্মসংস্থান হতো। বাংলাদেশের রাস্তা-নদী-কাদা-ধুলো-চাহিদার বিবেচনায় এগুলোর গঠনগত উন্নয়নে প্রযুক্তিগত গবেষণাও খুব দরকার। কৃষি ও নানান প্রকৌশলে ডিপ্লোমা পড়ার আগ্রহ বেড়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন অসংখ্য প্রতিষ্ঠানও। কিন্তু গ্রামীন অর্থনীতিতে খোদ কৃষকের মুনাফার হার কম বলে সম্ভাবনার তুলনায় প্রযুক্তির চাহিদা একটা পর্যায়ে গিয়েই থেমে যায়।
পোশাকশিল্প ছাড়া আর কোনো শিল্প খাতে কর্মসংস্থান সরকার সম্ভবত চায়ই না। তাহলে সস্তা শ্রমিকের ব্যয় বেড়ে যাবে যে! আরো ভয়ঙ্কর হলো, পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের লোকজনকে এখন আর গ্রাম-মফস্বলে দেখা যায় না, উলিপুরবাসীও তাদের দেখা পায় না। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত নতুন দিগন্তের একটা সংখ্যায় এই বিভাগের সাবেক এক কর্মকর্তার লেখা থেকে গত বছরই জানলাম, মুখে না বললেও সরকার কার্যত এই দপ্তরকে বসিয়ে দিয়েছে। অথচ এটা বাংলাদেশের সবচে কার্যকর একটা বিভাগ ছিল আশির দশকের শেষ পর্যন্ত। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র আর অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করছে না।
কারণ সম্ভবত একই। নীতি নির্ধারকরা ভয় পান, গরিব লোকে বাচ্চাকাচ্চা কম নিলে শ্রমিকের দর সস্তা থাকবে তো! আপনি-আমি ১০ বছর পরের কথা যতটা অস্পষ্ট কল্পনায় রাখি, তারা ঠিকই পরিকল্পনায় তার চেয়ে অনেক বেশি ধুরন্ধর। বাল্যবিবাহের বয়স নিয়ে যে ঘাপলা চলছেই, ষোলো না আঠারো, তার রহস্যও সম্ভবত এখানেই। কিন্তু এই একটা ক্ষেত্রে অন্তত এত সব শেয়ালি বুদ্ধিও মার খাচ্ছে, অন্য কারণে। সরকারের নীতি বাস্তবায়নের ঠেকা তো গরিব লোকের পড়েনি। কাণ্ডজ্ঞান তো তারও আছে। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনাও তাঁরা ভাবেন। তারা বাস্তব জীবনের আঘাত থেকে শিখে গেছেন, সন্তান একটা বা দুইটার বেশি হলে তাদের মানুষ করা যায় না। গ্রাম তাদের রক্ষা করবে না, কৃষি তাদের রক্ষা করবে না। ফলে মাঠে-প্রান্তরে সন্তানরা আর বড় হয়ে উঠবে না, তাদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে হবে, প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাহলেই শ্রেণিগত উত্তরণ ঘটবে। তাদের বিবেচনায় সন্তান বিদ্যালয়ে পড়লে একবারে বহু ধাপ এগুনো গেল, মাদ্রাসায় পড়লেও অন্তত এক ধাপ অগ্রসর হবে। দুটো সন্তান আছে, মধ্যবয়সীদের মাঝে এমন মানুষের সংখ্যাই দেখা গেল বেশি। তিনটা পাওয়া গেল হাতেগোনা। একটাই সন্তান এমন দম্পত্তিও মিলল বেশ কিছু। পরিবার পরিকল্পনার মাঠকর্মীদের সাক্ষাৎ ছাড়াই তারা এই অর্জনটা সম্ভব করেছে। বিশাল কোনো সচেতনতার প্রচারণা ছাড়াই দরিদ্র মানুষ নিজেদের কর্মসূচি নিজেরাই ঠিক করে নিয়েছে, এটা একটা মস্ত শিক্ষার বিষয়।
চিলমারী কমিউনিটি রেডিওর একজন পরিচালকের মুখে নতুন সময়ের জটিলতার কিছুটা আঁচ পেলাম। দলবল নিয়ে তারা একটা বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছিলেন, কিছুদিন পর দেখতে গিয়েছিলেন কেমন আছে পরিবারটি। মেয়েটির বাবা তাদের তাড়া করেছেন লাঠি হাতে, গরু বেচে বিয়ের বন্দোবস্ত করেছিলেন। বিয়ে ভেঙে যাওয়াতে খরচটা পুরো অপচয় হলো, ওদিকে মেয়েকে আর পড়াবার সামর্থ্য নেই, পারছেন না নতুন বিয়ের বন্দোবস্ত করতে। বিয়ে হলে শহরে পোশাক কারখানায় কাজ করতে পারত মেয়ে, দায়িত্ব তখন বর্তাত স্বামীর ওপরই। এখন তাঁর মেয়ে বিকেলে-সন্ধ্যায় বাইরে ঘোরে, কে ঠেকাবে, কে নিরাপত্তা দেবে, এটাই বুড়ো বাবার ভাবনা। আরেকজন নারীকে নিজেই দেখলাম, মেয়ের বয়স মাত্র ১২, কিন্তু মায়ের এখনই উচ্চ রক্তচাপ। মেয়ে বড় হয়ে উঠছে, তার বিয়ের বন্দোবস্ত করতে হবে। পড়াশোনায় ভালো না হলে (কখনো কখনো ভালো হলেও) মেয়েকে তো কর্ম করে খেতে হবে, বিয়েও দিতে হবে। বস্ত্রশিল্পে কাজ করেই বিয়ের খরচ জোগাড় করছে, এমন কিশোরীর সংখ্যাও কিন্তু অনেক। ছেলেদের বড় অংশও মোটামুটি গোঁফ গজালেই ঢাকা শহরে পোশাক কারখানায় চলে আসে। পড়াশোনায় তুলনামূলক ভালো করছে যারা, তারাও অনেকেই খরচ চালাতে বছরে চার মাস ইট বানাবার কাজ করে। চিলমারী-উলিপুর ছেড়ে কাজ নেয় সাভার-ঢাকা-গাজীপুরের ইটখোলায়।
বাংলাদেশের বহু গ্রামে এখন তরুণ-যুবকদের আর দেখা যাবে কদাচিৎ। গ্রামে প্রধানত বৃদ্ধবৃদ্ধা আর শিশুকিশোরদের বাস। কোনো চাষাই এখন আর শুদ্ধ কৃষক নেই, সাথে একটা কিছু না করলে দিন চালাবার সাধ্যি নেই। তরুণরা ভিড় করেছে ঢাকা থেকে শুরু করে মফস্বল পর্যন্ত নগরের বিস্তার নতুন নতুন যে কাজের সুযোগগুলো সৃষ্টি হয়েছে তার স্পর্শ পেতে। আর যারা নানা রকম সনদ জোগাড় করতে পেরে চাকরির চেষ্টা করছে, তাদের মুখে শুনতে পাবেন তিন লাখ, পাঁচ লাখ, সাত লাখ, ১০ লাখ এমনকি ২০ লাখ টাকার ঘুষের গল্প। প্রাথমিক শিক্ষক, পুলিশের সেপাই বা চালু স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অধ্যাপনার পদের জন্য। একদিকে অনিশ্চিত বিদেশযাত্রা আর অন্যদিকে অর্থনীতির স্থবিরতা নতুন খুদে বিনিয়োগের সুযোগ কমিয়ে দেওয়ায় চাকরির চাহিদা বেড়েছে, তার সাথে বেড়েছে ঘুষের দর। কেউ জানে না, কত বছরে এই ঘুষের টাকা উঠে আসবে। এই টাকার একটা বড় অংশ আসে যৌতুক থেকে, হয়তো চাকরির বাজারে ঘুষের দাপট যৌতুকের সংস্কৃতিকে আবারও চাঙা করছে।
ধর্ম সম্পর্কে সচেতনতা বেড়েছে, স্পর্শকাতরতাও। উলিপুরে অজস্র ওয়াজের নিমন্ত্রণ সারাদিন ধরে মাইকে শুনলাম। গোবরের ঘুঁটেতে রান্না নাপাক, বলল একদম শুরুর চরবাসী মেয়েটি। বাঁধে থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে যে, সে দুই সন্তানের জননী। খুবই স্বতঃস্ফূর্ত এবং ভাবপ্রকাশে সক্ষম, জড়তা মুক্ত, শহরে কাজের অভিজ্ঞতার ফল। চাকরি ছাড়ায় বেতনের নগদ টাকাটা আর পায় না, কিন্তু একদিন না একদিন তো এই জমি উর্বরা হবে, যোগাযোগ ভালো হবে, সেই আশায় ফেরত আসা। গ্রামে স্থায়ীভাবে ফিরে যাওয়ার বিরল এই ঘটনাগুলো ঘটতে পেরেছে ধরলা নদী তাদের জমিটা ফেরত দেওয়াতেই। বাকি যে কোটি কোটি মানুষ শহরে আসছে, তাদের ভিটেমাটি প্রাকৃতিক কোনো বিপর্যয়ে হারায়নি, বরং অর্থনীতির অমোঘ একটা চক্রের তারা শিকার। গল্পচ্ছলে একজন যখন বললেন, খিদের যন্ত্রণায় পঞ্চম শ্রেণির পর আর পড়া সহ্য হয়নি, তার সন্তানরা উচ্চমাধ্যমিক আর অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে—আল্লা তাকে এত দূর এগিয়ে নিয়ে এসেছে, সেই শোকরে তিনি আত্মহারা। সুখ তো সর্বদাই একটা আপেক্ষিক ভাবনা, তার সন্তানরা কি ততটা সুখী কিংবা সফল ভাববে নিজেদের জীবনকে?
পৈতৃক জমির মায়ায় গ্রামে ফেরত আসা মেয়েটা বললে, ‘মা-বাপ ছিল অশিক্ষিত মুরুক্খ। ধইরে বাইধে কম বয়েসে বিয়া দিছে। আমরাও কি তাই ভুল করব নাকি? ছেলেমেয়েরে কষ্ট করে হলেও লেখাপড়া শিখাতি হবি, নিজেদের দশা যেন তাদের না হয়, সেটা দেখতি হবি। ওই চরে একমাত্র তারই আছে ফেসবুক।’ কোথায় কী উদ্বোধন হলো, কোথায় হানাহানি, মুসলমানদের ওপর কী অত্যাচার হলো, কী কী দুর্নীতি হয়েছে, কে কী বলল, এসবই সে জানে ফেসবুক থেকে। ফেসবুক কীভাবে ব্যবহার করেন? উত্তরে মেয়েটি বলল, ‘ডাক্তারের মোবাইল দিয়ে।’ অবাক হলাম, এই বিজন চরে চিকিৎসক!
না, উচ্চমাধ্যমিকে অকৃতকার্য এক ছেলে, একটা চোখ নাকি আবার কানা। আর কোথাও চাকরি পাবে না বলে এলাকাতেই খুলে বসেছে একটা ওষুধের দোকান। গ্রামবাসীর সে-ই আদরের ডাক্তার।
হয়তো আমাদের গ্রামসমাজ বিশাল এক রূপান্তরের সময় পাড় করছে, দুই পর্বেরই বহু বহু বৈশিষ্ট্য তাদের ওপর আছর করে আছে। হয়তো এমন কিছু অনুভূতি, এমন কিছু অভিজ্ঞতা তাদের আছে, যা এই মধ্যবর্তী পর্যায়ের মানুষদেরই মৌলিক, আগে কিংবা পরে কেউ তাদের আর শিকার হবে না। বাইরে থেকে এত কম সময়ে কতটুকুই বা আমরা চিনব অচেনা একটা জনপদকে, বুঝব তার সংকট আর সম্ভাবনাকে? যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধির উত্তরসূরীরা হয়তো এদেরই মাঝ থেকে বেরিয়ে আসবে উপযুক্ত সময়ে, ততক্ষণ আমাদের যোগ্যতম ছেলেমেয়েরা সুদূর পশ্চিমে কী কী অর্জন করে পত্রিকার শিরোনাম হলো, তাই আমাদের একমাত্র সান্ত্বনা হয়ে থাকবে।
শুধু তাই বা কি করে বলি! চিলমারী কমিউনিটি রেডিওর সৌজন্যে তাদের তালিকাভুক্ত স্থানীয় প্রায় পঞ্চাশজন শিল্পীর গানের সংগ্রহ পেলাম, এলোপাতাড়িভাবে শুনেও আপনি বুঝবেন, এত ঝঞ্ঝ, এত লড়াই আর অনিশ্চয়তার মাঝেও সুর ঠিকই সজীব আছে। ভিক্ষাবৃত্তি যার নেশা, সেই মোহান্তের ভাওয়াইয়া গান জানিয়ে দেবে, স্বপ্ন আর প্রেম নিয়ে বাঁচতে সেও জানে।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন। কেন্দ্রীয় সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন।