খোলা চোখে
ইন্ডিয়ান ভিসা অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
গত ২৯ ডিসেম্বর-২০১৫ সর্বশেষ ঢাকার উত্তরায় রাজধানী ঢাকা শহরের চতুর্থ এবং দেশের ১১তম ভারতীয় ভিসা অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার (আইভিএসি) উদ্বোধন করা হলো। ওই দিন ভারতীয় হাইকমিশনের স্বীকৃত এজেন্ট হিসেবে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার ড. আদর্শ সোয়াইকা এ আইভিএসি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছেন। এর আগে গত বছরেরই সেপ্টেম্বরে সর্বশেষ বরিশাল, রংপুর ও ময়মনসিংহে একই দিনে তিনটি ভিসা সেন্টার একসঙ্গে চালু করা হয়েছিল। ওই তিনটি আইভিএসি চালু করেছিলেন সদ্যবিদায়ী ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ। এখন ঢাকা মহানগরে চারটি আইভিএসির মধ্যে গুলশান, মতিঝিল ও ধানমণ্ডির পর এবারে উত্তরায় ১১ নম্বরটি স্থাপন করা হলো। দেশের অন্যান্য স্থানে স্থাপনকৃত সেন্টারগুলো হলো—চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী ও খুলনা। এ নিয়ে নবগঠিত অষ্টম বিভাগ ময়মনসিংহসহ দেশের সব বিভাগেই আইভিএসি স্থাপিত হলো।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অন্য কোনো দেশের মধ্যে একমাত্র ভারতেই এত অধিক সংখ্যক ভিসা সেন্টার রয়েছে। তা ছাড়া ইংল্যান্ডের অবশ্য ঢাকা ও সিলেটে এ দুটি ভিসা সেন্টার থাকার কথা আমরা জানি। কারণ, বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল থেকে প্রচুর পরিমাণে অভিবাসী ইংল্যান্ডে বসবাস করেন। তা ছাড়া আমরা একটু স্মরণ করলেই মনে করতে পারব, কিছুদিন আগে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী আনোয়ার চৌধুরী নামের এক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাগরিক বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার ছিলেন। তিনি সিলেটিদের ভিসাপ্রাপ্তির প্রক্রিয়াগুলো অনেক সহজ করেছিলেন। কিন্তু আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত হলেও এবং ইদানীং সারা দেশে ১১টি ভিসা সেন্টার থাকার পরও মনে হচ্ছে, বাংলাদেশিদের জন্য ভারতের ভিসাপ্রাপ্তি দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত পাকিস্তান-ভারত উপমহাদেশ এবং ভারতবর্ষ একসঙ্গেই ছিল। এখন দেশ বিভাগের মাত্র এক প্রজন্ম পার হতে চলেছে। আর শুধু বঙ্গোপসাগরের কিয়দংশ এবং মিয়ানমারের ২৮৩ কিলোমিটার সীমান্ত ছাড়া বাকি তিন দিকের সবটুকু, অর্থাৎ চার সহস্রাধিক কিলোমিটারের সীমান্তই ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয়। এই দীর্ঘ সীমান্তজুড়ে দুদেশের মানুষের সঙ্গে অনেক আত্মীয়-পরিজন রয়েছেন, যাঁরা দেশভাগের সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত এপার-ওপারে বিভক্ত হয়ে বসবাস করছেন। কাজেই সীমান্তের এপারে-ওপারে দুদেশের আত্মীয়স্বজনদের প্রায়ই দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ার প্রয়োজন হয়। ভারত আমাদের দেশ থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে একটু এগিয়ে থাকার কারণে আমাদের দেশের ডাক্তারের পরামর্শে অনেক জটিল রোগীর চিকিৎসা করানোর জন্য ভারতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
অন্যদিকে ভারত প্রাকৃতিক নৈসর্গের দিক থেকে সর্বভারতীয় বৈচিত্রতা, মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান, ধর্মীয় তীর্থস্থান ইত্যাদি থাকার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের ভ্রমণপিপাসু মানুষ ভারতের তীর্থস্থান পরিভ্রমণ করতে যান। তা ছাড়া বাংলাদেশের প্রচুর ছাত্রছাত্রী, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাঁদের স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্যও ভারতের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে যান। সারা বছরেই এ প্রক্রিয়া চলতে থাকে। আর সে বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেই ভারতীয় ভিসা কর্তৃপক্ষ দেশের ভিসা সেন্টার বাড়াতে বাড়াতে ১১টিতে উন্নীত করেছে। কয়েক বছর আগে সরাসরি ভিসার জন্য নির্ধারিত ফরম পূরণ করে নির্দিষ্ট ফি ব্যাংকে জমা দিয়ে হাইকমিশন ফেস করলেই মিলত ভিসা। তখন ভিসা প্রসেসিংয়ের এ কাজে দালালদের অনেক দৌরাত্ম্য ছিল। দালাল ছাড়া কোনো ভিসা কল্পনাই করা যেত না। কিন্তু সে ব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য ডিজিটাল যুগে ভিসা পদ্ধতিকে আধুনিকায়ন করতে গিয়ে মাঝখানে ই-টোকেন নামের আরেকটি ধাপ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। যার ফলে ক্রমে এ পদ্ধতির ত্রুটি ধরা পড়তে থাকে।
প্রথম কিছুদিন এর ফাঁকফোকর ধরা না পড়া পর্যন্ত তা ভালোভাবে চললেও এখন পুরো প্রক্রিয়াটিই আবার দালালদের খপ্পরে নিমজ্জিত। তা ছাড়া ভিসা দেওয়ার বিষয়টি এখন যেন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের মনমর্জির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই পরিবারে চারজন একসঙ্গে আবেদন করলেও দেখা গেল যে, দুজনের ভিসা দেওয়া হলো তো আর দুজনের হলো না কিংবা হলেও আরো এক মাস পরে হলো ইত্যাদি। এ ব্যাপারে আরো দু-একটি উদাহরণ দিলেই একটু পরিষ্কার হতে পারে। আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করার কারণে প্রায়ই দেখা যায়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রদের বিভিন্ন শিক্ষামূলক কাজে ভারতে যেতে হয়। সেখানে তাঁরা ভিসা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ছুটির অনুমোদন নিলেও হাইকমিশন কর্তৃক ভিসা আবেদন রিজেক্ট হওয়ার কারণে একাধিকবার ছুটি বাতিল করতে হচ্ছে।
এক শিক্ষক দিল্লির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক পিএইচডি ছাত্রের মৌখিক পরীক্ষার সেমিনারে যাওয়ার বৈধ কাগজপত্র দেখানোর পরও তাঁকে কমপক্ষে দুবার ভিসা না দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। নভেম্বর-২০১৫-তে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একটি অফিশিয়াল ট্যুরে কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে ভারতের তীর্থস্থান দেখার জন্য আরো কয়েকজন শিক্ষক-কর্মকর্তা-শিক্ষার্থী অনেক আগে ভিসার জন্য আবেদন করেও তা পাননি বলে তাঁরা একসঙ্গে যেতে পারেননি। অনেকের সেমিনার শেষ হয়ে গেছে, তার পরও ভিসা মেলেনি। অনেক রোগী মারা গেছেন, কিন্তু তার পরও ভিসা পাওয়া যায়নি। তাহলে বেশি সংখ্যক ভিসা অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার স্থাপনের সুযোগ-সুবিধা আসলে কেউ পাচ্ছে বলে তো মনে হচ্ছে না।
একেকটি ই-টোকেন নিতে অনেক অপেক্ষা করতে হয় এবং প্রতিটি ই-টোকেনের জন্য দালালকে কমপক্ষে চার-পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত গুনতে হয়। এটি প্রমাণের জন্য আর কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই, আমি নিজেই এর বড় প্রমাণ। অথচ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, কোনো বাংলাদেশি বাঙালি বৈধ ভিসা নিয়ে গিয়ে ভারতে কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে—এমন অভিযোগ দেখানোর সুযোগ খুব কম। বরং ভারতে গিয়ে বাংলাদেশি পর্যটকরা সেখানকার পর্যটন অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরাট অবদান রাখছেন। যে সময়ে ভারতে নরেন্দ্র মোদির মতো সুকৌশলী কূটনীতিক প্রধানমন্ত্রী রয়েছেন এবং এখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অতীতের অনেক সময়ের চেয়ে ভালো, যার মাধ্যমে ৬৮ বছরের ছিটমহল সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে। উত্তর ও পূর্বাঞ্চলীয় ভারতের রাজ্যগুলোর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং যোগাযোগের জন্য সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে, সেখানে ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ভালো রাখার স্বার্থেই ভিসা প্রদান পদ্ধতি আরো সহজীকরণ করা প্রয়োজন। সেখানে সব জটিলতা নিরসন করে দালালদের দৌরাত্ম্য মুছে দিয়ে আরো বেশি পর্যটক আকর্ষণের সুযোগদানে বাধিত করার জন্য অনুরোধ রইল ভারতীয় ভিসা কর্তৃপক্ষের কাছে। অন্যথায় এগারো কেন, এগারোশ আইভিএসি খুলেও এ সমস্যার কোনো সমাধান করা সম্ভব নয়। এমনিতেই ২০১৫ সালে ভারতীয় গণমাধ্যমে গরু এবং গো-মাংস নিয়ে রাজনীতি সরগরম ছিল। সে জন্য সবাইকে ছাড়িয়ে ২০১৫ সালে ভারতে গরুই সেরা ব্যক্তিত্বের অভিধা পেয়েছে। সেখানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে উসকে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে সম্প্রতি ভারতের আরেক প্রতিবেশী নেপালে জাতীয় নির্বাচনের পর তারা তাদের সংবিধান সংশোধন করে সাংবিধানিকভাবে হিন্দু রাষ্ট্রত্ব পরিবর্তন করেছে। সে জন্য ভারত নেপালের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে সম্পর্ক শিথিল করেছে। কাজেই বাংলাদেশের নাগরিকদের শুধু সাম্প্রদায়িক কারণে নিয়মানুযায়ী সহজ শর্তে ভিসা প্রদান থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না, তাই যেন সবার কাছে মনে হয়। কাজেই এটিকে বর্তমানে একটি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে এ ব্যাপারে শুধু দূতাবাসের হাইকমিশনার পর্যায় থেকে উদ্যোগই যথেষ্ট নয়। সৎ উদ্যোগ প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তাহলেই নতুন বছর ২০১৬ সালে তার একটি আশু সমাধান সম্ভব হতে পারে। আর আমরা সব ভিসাপ্রার্থী সে প্রত্যাশাতেই রইলাম।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়