প্রকৃতি
ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে পারে পশুপাখি?
২০০৯ সালে ইতালিতে দেখা গিয়েছিল অদ্ভুত এক ঘটনা। মধ্য ইতালির শহর অ্যাকুইলার একটি পুকুর থেকে শত শত ব্যাঙ উঠে এসেছিল রাস্তায়। এই ঘটনার একদিন পরই সেখানে আঘাত হেনেছিল ৫.৯ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প। ঘটনাটি ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল বিজ্ঞানীদের মধ্যে। ব্যাঙ বা অন্যান্য পশুপাখি ভূমিকম্পের খবর আগে থেকেই অনুভব করতে পারে কি না, তা নিয়ে শুরু হয় গবেষণা।
সুনামি, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর পূর্বাভাস পাওয়া যায় আগে থেকেই। সেই অনুযায়ী কিছু প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগও থাকে আক্রান্ত হতে যাওয়া অঞ্চলগুলোর মানুষদের সামনে। কিন্তু ভূমিকম্প বিষয়ে আগাম সতর্কতা জারির কোনো পদ্ধতি এখনো বের করতে পারেনি আধুনিক বিজ্ঞান। হঠাৎ করেই আঘাত হানা ভূকম্পনে তাই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও থাকে অনেক বেশি। পশুপাখিদের আচরণ পর্যালোচনা করে ভূমিকম্পের খবর আগে থেকে জানা যায় কি না, এ নিয়ে বিজ্ঞানীরাও তাই যথেষ্ট উৎসুক। আর কিছু গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে, কিছু পশুপাখি সত্যিই টের পায় ভূমিকম্পের আগাম খবর।
ইতালির অ্যাকুইলা শহরের ব্যাঙগুলোর অদ্ভুত আচরণের আগেও ঘটতে দেখা গেছে এমন ঘটনা। ১৯৭৫ সালে চীনের হাইচেং শহরে অনেক সাপকে দেখা গিয়েছিল তাদের গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। ঠান্ডার সময় যেখানে তাদের কোনোভাবেই বাইরে আসার কথা না। এই ঘটনার এক মাসের মাথায় চীনের এই অঞ্চলে আঘাত হানে ৭.৩ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প। এই ঘটনাগুলোর ফলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যে, অনেক পশুপাখিই ভূমিকম্পের আগাম খবর পেতে পারে। কিন্তু ব্যাপারগুলো এত আকস্মিকভাবে ঘটে যে সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করার সুযোগও মেলে না বিজ্ঞানীদের।
ভূমিকম্পের আগে বন্য প্রাণীদের আচরণে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায় কি না, তা জানার জন্য পেরুর ইয়ানাচাগা ন্যাশনাল পার্কের এমন কিছু জায়গায় ক্যামেরা বসানো হয়েছিল, যেখানে সাধারণত অনেক বন্য প্রাণীর উপস্থিতি দেখা যায়। কিন্তু ২০১১ সালে ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের আগে পরিবর্তন লক্ষ করা যায় বন্য প্রাণীদের মধ্যে। ভূমিকম্পের ২৩ দিন আগে হঠাৎ করেই কমে যায় সেই অঞ্চলের প্রাণীর সংখ্যা। সাতদিন আগে ক্যামেরায় কোনো বন্য প্রাণীর উপস্থিতি ধরা পড়েনি। আগে থেকে ভূমিকম্প আঁচ করতে পেরে বন্য প্রাণীরা অন্য কোনো অঞ্চলে চলে গিয়েছিল বলে ধারণা করেছিলেন বিজ্ঞানীরা।
মাটির মধ্যে গর্ত করে থাকা ইঁদুরও ভূমিকম্পের খবর আগে থেকে টের পায় বলে ধারণা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাঙ্গিলা রাসকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও জীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক র্যাচেল গ্রান্ট বলেছেন, ‘অবাক করার মতো ব্যাপার হলো, ভূমিকম্পের আগে ইঁদুর সবার আগে পালিয়ে যায়। ভূমিকম্পের আটদিন আগে থেকে কোনো ইঁদুর দেখতে পাওয়া যায় না। অথচ বনজঙ্গলে তাদের প্রায় সব জায়গাতেই দেখতে পাওয়া যায়। ভূমিকম্পের আগে ইঁদুররা শহর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে, এমন গল্প অনেক আগে থেকেই শোনা যায়।’
ভূমিকম্পের সময় ভূগর্ভস্থ পাথরগুলোর সংঘর্ষের কারণে মাটি বা জলাশয়ে কিছু রসায়নিক পরিবর্তন হয় বলে নিশ্চিত হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বন্য পশুপ্রাণী এই রসায়নিক পরিবর্তনগুলো টের পায় বলে ধারণা করছেন তাঁরা। ভূমিকম্পের ফলে মাটির নিচে কিছু ধনাত্মক আয়নেরও সৃষ্টি হয়। আর এই আয়নগুলো উঠে আসে ভূপৃষ্ঠে। এই ধনাত্মক আয়নের সংস্পর্শে মানুষেরও মাথাব্যথা ও বমি বমি ভাব হয়। বন্য পশুপাখি এই আয়নের উপস্থিতি টের পায় এবং এর সংস্পর্শ এড়াতে চায় বলে জানিয়েছেন নাসার ভূপদার্থবিদ ফ্রেডম্যান ফ্রেউন্ড। যার ফলে তারা চলে যায় অন্য কোনো স্থানে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই আয়নগুলো ভূপৃষ্ঠের বাতাস ও পানির সঙ্গে বিক্রিয়া করে সেখানকার স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ভারসাম্যও নষ্ট করে, যা পশুপাখি টের পায়। অনেক গভীর পানির মাছকেও ভূমিকম্পের আগ দিয়ে উঠে আসতে দেখা যায় উপরিভাগে।
তাহলে কী সত্যিই পশুপাখিদের আচরণ পর্যালোচনা করে ভূমিকম্পের আগাম সতর্কতা জারি করা সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তরও সহজভাবে দিতে পারছেন না বিজ্ঞানীরা। কারণ হিসেবে অধ্যাপক রাচেল গ্রান্ট বলেছেন, ‘পশুপাখিদের আচরণও সব সময় অনুমানযোগ্য না। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের আরো বেশি নজর দিতে হবে ভূতাত্ত্বিক উপাদানগুলো পরিমাপের দিকে। তবে একই সঙ্গে আমরা প্রাণীদের আচরণ পর্যালোচনার বিষয়টিও মেলাতে পারি।’
ভূমিকম্পের সময় পশুপাখিরা কেমন আচরণ করে, তা নিয়ে আরো গবেষণা হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। বিষয়টি আরো ভালোভাবে বোঝার জন্য আগামীতে জীববিজ্ঞানী ও ভূতাত্ত্বিকরা একসঙ্গে কাজ করার উদ্যোগ নেবেন বলেও আশা প্রকাশ করেছেন রাচেল গ্রান্ট ও ফ্রেডম্যান ফ্রেউন্ড।
লেখক : সাংবাদিক