বেতন কাঠামো
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কথিত ‘জ্ঞানের অভাব’ ও একটি প্রেসনোট
অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোতে যে বেতন বৈষম্য বিদ্যমান, তা সুস্পষ্ট। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত পেশাজীবীদের বিভিন্ন সংগঠনের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এ বৈষম্য নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও কোনো এক অজানা কারণে তা আজ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়ে ওঠেনি। উপরন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কর্মসূচি এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের সাম্প্রতিক মন্তব্য শিক্ষকদের আরো হতাশ, ক্ষুব্ধ, এবং ব্যথিত করেছে। মাননীয় অর্থমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, ‘শিক্ষকগণ কী পেয়েছেন, তা সঠিকভাবে না জেনেই তারা আন্দোলন করছেন।’ বোধকরি শিক্ষকদের এ কথিত অজ্ঞানতার আঁধার দূরীকরণের লক্ষ্যেই সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও সচিবদের কর্মপরিধির তুলনামূলক চিত্র উল্লেখপূর্বক বেতন কাঠামোর একটি ব্যাখ্যা প্রেসনোট আকারে দেওয়া হয়েছে, যা গণমাধ্যমের বদৌলতে জানতে পেরেছি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের বেতন কাঠামোর ব্যাখ্যাসংবলিত প্রেসনোটটি পক্ষপাতদুষ্ট ও একপেশে। অধিকন্তু প্রেসনোটে যে যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে, তা যৌক্তিকভাবে অশুদ্ধ। যেহেতু শিক্ষকদের আলোকিত করা এবং জনগণকে সঠিক তথ্য সম্পর্কে অবহিত করাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশ্য, সেহেতু মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যার যৌক্তিক অশুদ্ধ অংশটুকু তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করছি।
প্রেসনোটের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজের কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পান, যা কোনো সরকারি কর্মচারীর পক্ষে সম্ভব নয়, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এ বাড়তি সুবিধার জন্য বেতন বৈষম্যটি যুক্তিসংগত। উপরোক্ত যুক্তিটিতে একটি যৌক্তিক অনুপপত্তি ঘটেছে, যা একটু ভালো করে খেয়াল করলেই দৃষ্টিগোচর হয়। যুক্তিবিদ্যায় অনুপপত্তিটি Fallacy of Composition নামে সুপরিচিত। অংশের কোন গুণকে (attribute) সমগ্রে আরোপ করে যুক্তি গঠন করলে এ ধরনের অনুপপত্তি ঘটে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি বিশেষ একটি জেলার কয়েকজন মানুষের সঙ্গে মিশে পুরো জেলার সমগ্র মানুষ সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন না। আপনি বলতে পারেন না, অমুক জেলার যত মানুষের সঙ্গে মিশেছি, তারা সবাই স্বার্থপর ছিল, সুতরাং অমুক জেলার সব মানুষ স্বার্থপর। এটা বড়জোর আপনার বিশ্বাস হতে পারে। কিন্তু এই বিশাসের ওপর ভিত্তি করে আপনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে খুব কমসংখ্যক শিক্ষকই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন কাজ করে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ বিভাগের শিক্ষকদেরই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ নেই। তাই কিছু অংশের এই গুণ সমগ্র শিক্ষকের ওপর আরোপ করে সবাইকে বঞ্চিত করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
ঠিক এ রকম একটি যুক্তির ওপর দাঁড়িয়েই মুসলমানদের আমেরিকায় প্রবেশাধিকার ও অবস্থান বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর একটি মন্তব্যের জন্য বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হয়েছেন। তাঁর যুক্তি অনুসারে, যেহেতু আইএস কিংবা আল-কায়েদা জঙ্গিরা মুসলমান, সুতরাং মুসলমানদের আমেরিকায় নিষিদ্ধ করা উচিত। অর্থাৎ মুসলমানদের অংশের একটি গুণ সমগ্রে আরোপ করে তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি। ঠিক একইভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগের কথা বলে সমগ্র শিক্ষকসমাজকে বঞ্চিত করা উপরোক্ত উদাহরণগুলোরই ভিন্নরূপমাত্র। সর্বোপরি, এত অধিকসংখ্যক জনসংখ্যার দেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে ভূমিকা রাখছেন, তাকে শুধু আর্থিক দিক দিয়ে বিবেচনা করাটা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়।
রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভূমিকা রাখা বরং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়িত্বও বটে। সরকারি চাকরিজীবী ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে দ্বিতীয় তুলনাটি অর্থ মন্ত্রণালয় করেছে অবসরের বয়স-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫, যেখানে সরকারি কর্মচারীদের অবসরের বয়সসীমা ৫৯ বছর। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ে যেহেতু ছয় বছর বেশি বেতন পাচ্ছেন, সেহেতু বেতন বৈষম্যটিও সংগত। এই বিষয় নিয়ে আমার কৌতূহল বেশ আগে থেকেই। আমার প্রশ্ন, বাংলাদেশে যেখানে মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৭০ বছর, সেখানে কেন একজন মানুষ ৬৫ বছর পর্যন্ত রাষ্ট্রকে সার্ভিস দিতে চাইবে? একটি উত্তরই আমি পেয়েছি আর তা হলো চাকরিকালীন ও অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধার মধ্যে তফাৎটা বিস্তর। স্বাভাবিকভাবেই একজন মানুষ জীবনের শেষ পর্যায়ে এসেও একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য চাকরিতে থাকাটাকেই বেছে নেবে।
উন্নত দেশগুলোতে অবসরের বয়সসীমা কমানোর জন্য আন্দোলন হয়, আর আমাদের দেশে ঠিক উল্টো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যদি তাঁর কর্মজীবনে বেতন-বহির্ভূত একটি ভালো অঙ্কের টাকা রোজগার করতে পারতেন, তাহলে হয়তো তাঁরাও অবসরের বয়সসীমা ৫৯ বছরেই সন্তুষ্ট থাকতেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একটু শান্তিময় নির্ভাবনার জীবন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরাও চাইতে পারেন। আমার ধারণা, চমৎকার একটি পেনশন প্ল্যান থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরাও অবসরের বয়সসীমা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। তাই ৬৫ বছর পর্যন্ত একজন মানুষ কাজ করলে সেটাকে সুবিধা হিসেবে না দেখে বরং অবদান হিসেবে গণ্য করা উচিত।
তৃতীয় তুলনাটি এসেছে অফিস টাইম বিষয়ে। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, একজন সরকারি কর্মকর্তাকে ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত অফিস করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এ রকম কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্পর্কে এটি একটি বহুল প্রচলিত ভুল ধারণা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজের ধরন সরকারি কর্মকর্তাদের কাজের ধরনের মতো নয়। তাই এ তুলনা নিতান্তই অসমীচীন। তবুও যদি তুলনা করতেই চান, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সত্যিকারের কর্মঘণ্টা হিসাব করে দেখুন। একজন শিক্ষককে ক্লাসে পড়ানোর জন্য অফিস টাইমের বাইরে কত ঘণ্টা ব্যয় করতে হয়, তা জানুন। তদুপরি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একটি বড় সময় কাটে গবেষণার কাজে। কম করে হলেও প্রতিদিন গড়ে তিন/চার ঘণ্টা সময় একজন শিক্ষককে বের করতে হয় গবেষণার জন্য। এ ছাড়া যেসব শিক্ষক গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কিংবা প্রশাসনিক কোনো পদে কাজ করছেন, তাঁদের কর্মঘণ্টা আরো বেশি। গবেষণার এই সময়কে কর্মঘণ্টার বাইরে হিসাব করার কোনো যুক্তি আছে কি? সত্যিকার অর্থে বিভাগ থেকে বাসায় ফিরলেও একজন শিক্ষক শিক্ষকই থেকে যান। তাঁর চিন্তা ও কর্ম থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে আলাদা করা খুব কঠিন। একজন সরকারি কর্মকর্তার ক্ষেত্রে কর্মজীবন ও ব্যক্তিজীবনের এ রকম মিথস্ক্রিয়া আদৌ সম্ভব নয়। সুতরাং কর্মঘণ্টার অজুহাতে যদি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বঞ্চিত করা হয়, তা হবে অন্যায়।
কথা ছিল, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে অর্থ মন্ত্রণালয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যেসব ক্ষেত্রকে বিবেচনা করবে, তার মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। খুব সম্ভব অগ্রাধিকারের বিষয়টি কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে।
শিক্ষকদের বেতনের ক্ষেত্রে দরকষাকষি আর বেতন স্কেলে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার দেওয়াটাই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। সবচেয়ে বড় কথা, অর্থ মন্ত্রণালয় কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও সরকারি কর্মকর্তাদের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারে না। অর্থ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া প্রেসনোটটি প্রমাণ করে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সরকারি কর্মকর্তারা দুটি পক্ষ আর অর্থ মন্ত্রণালয় সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসম তুলনা করে তাদের পক্ষাবলম্বন করেছেন।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।