জাগো বাহে
মরণাপন্ন তিস্তার পাশে কেউ নেই
রাষ্ট্রীয় সীমারেখার কাঁটাতার অতিক্রম করে বাংলাদেশ-ভারত অভিন্ন নদীতে অভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠায় কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারছে না। যৌথ নদী কমিশনও ঠুঁটো জগন্নাথ। অভিন্ন নদীতে অভিন্ন অধিকার এখন ফাঁকা বুলিতে পরিণত হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশ ভাটির দেশ, তাই উজান দেশ ভারতের কোনো মাথাব্যথা নেই। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক থাকলেও ভারত পানিশোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে নদীর টুঁটি টিপে দিতেও তাদের নিষ্ঠুরতা এখন নিত্যদিনের বিষয়। ভারত উজান থেকে বাংলাদেশের প্রায় সব নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারতের এ সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে তিস্তাকে দিয়ে। বর্তমানে তিস্তা নদীর যে ভয়াবহতা, সেই বাস্তবতা সরকার যদি এখনই আমলে না নেয়, তাহলে নিকট ভবিষ্যতে উত্তরাঞ্চল তথা রংপুরে পানির হাহাকারে পড়বে।
তিস্তা নদীর শতভাগ জলশূন্য হয়ে পড়ার দৃশ্য আগে কেউ কখনোই দেখেনি। ৩১৫ কিলোমিটার নদীর মধ্যে ভারতের অংশে ২০০ কিলোমিটারের বুকে থৈথৈ জল। আর বাংলাদেশ অংশে ধুধু বালুচর। নভেম্বর থেকেই শুরু হয় এই জলশূন্যতা।
তিস্তা নদীতে ১৯৯০ সালের ৫ আগস্ট সেচ প্রকল্প চালু হয় করা হয়। যখন তিস্তা সেচ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়, তখন শুষ্ক মৌসুমে প্রায় সাত হাজার কিউসেক পানি ছিল। তিস্তা সেচ প্রকল্পের কাজ দুটি পর্যায়ে ভাগ করা ছিল। চাষাবাদের জন্য প্রথম পর্যায়ে লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ১১ হাজার হেক্টর জমি। পানির অপর্যাপ্ততার জন্য প্রায় ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ শুরু হয়। বাংলাদেশ অংশে পানির প্রবাহ কিছুটা কমে যাওয়ার কারণে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে তিস্তা সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে চাষাবাদ চলছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে ভারত সরকার তিস্তার পানি প্রত্যাহার করার কারণে হঠাৎ করেই জলশূন্যতা দেখা দেয়। তখন চাষিরা ভীষণ বিপাকে পড়েন। অনেকের চাষাবাদ জলশূন্যতার কারণে নষ্ট হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণও দেয়নি সরকার। বামপন্থী কয়েকটি দল পানির দাবিতে রোডমার্চও করেছে। আমরা রিভারাইন পিপল থেকেও তিস্তার পানির জন্য আন্দোলন করেছি এবং এখনো করছি। ২০১৫ সালের বাস্তবতা আরো ভয়াবহ। সাত হাজার কিউসেক পানি না এলেও সাড়ে তিন হাজার কিউসেক পানি পাওয়া যাচ্ছিল। এপ্রিলের দিকে হয়তো পরিমাণ আরো কমে আসত। তাতেও প্রায় ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে এসে কখনো কখনো পানির প্রবাহ এতটাই কমে এসেছিল যে কিউসেকে আর পরিমাপ করা যাচ্ছিল না। দুই বছর ধরে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদী স্রেফ বালুর চরে পরিণত হয়ে থাকে।
তিস্তায় পনি না থাকার কারণে কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে, তা শুধু অর্থমূল্যে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কারণ, তিস্তাকে বলা হয় উত্তরের জীবনরেখা। সেই তিস্তাকে যদি বাঁচানো না যায়, তাহলে উত্তরাঞ্চলকে বাঁচানোই কঠিন হবে। রংপুর বিভাগে প্রায় চার কোটি মানুষের খাদ্যশস্য উৎপাদন করা হয়। এই উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে তিস্তা নদীর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। যদি তিস্তায় পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক থাকত, তাহলে তিস্তা সেচ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ করা যেত। তখন প্রায় দুই লাখ হেক্টর জমিতে তিস্তার পানিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হতো। তিস্তায় পানি না থাকার কারণে গত দুই বছর ভীষণ বিপাকে পড়তে হয়েছে তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতাধীন কৃষকদের।
তিস্তায় পানি না থাকলে সংগত কারণেই তিস্তা তীরবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পানির স্তর নিচে নেমে যায়। তখন গভীর নলকূপের মাধ্যমে আরো গভীর থেকে পানি উত্তোলন করে সেচকাজ সম্পাদন করা হয়। এতে করে পানির স্তর আরো নিচে নেমে যায়। পানির স্তর বেশি পরিমাণ নিচে নেমে গেলে ভূমির ওপরের অংশের সজীবতা কমে যায়। প্রকৃতির জন্য এই বাস্তবতা কতটা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে, তা নিয়েও গবেষণা হওয়া খুবই জরুরি।
অভিন্ন নদীতে অভিন্ন অধিকার এখন আইনগতভাবেও স্বীকৃত। উজানের যেকোনো দেশ যদি নদীর ওপর যেকোনো কাজ করতে চায়, তাহলে ভাটির দেশের সঙ্গে আলাপ করেই করতে হবে। ১৯৯৭ সালের আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশটি ২০১৪ সালে আইনে পরিণত হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত সেটাতে অনুসমর্থন করেনি। ভারত-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে তিস্তার পনিবণ্টন চুক্তি হবে, এটাই বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যাশা করে। ২০১১ সালে যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশে এলেন, তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও আসার কথা ছিল। সে সময়ে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত। তখন আমরা আন্দোলন করছিলাম ন্যায্য হিস্যার দাবিতে। কিন্তু হঠাৎ করেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশ সফর বাতিল করেন এবং তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। তার পর কেটে গেছে পাঁচটি বছর। এই পাঁচ বছরে তিস্তার অবস্থা আরো রুগণ হয়েছে। এই রুগণ করার দায় ভারতের। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক আইনও প্রণীত হয়েছে। যদি ভারতের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে ন্যায্য হিস্যার ভিত্তিতে পানি পেতে আমরা ব্যর্থ হই, তাহলে আইনি লড়াইয়ে তিস্তার পানিপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তিস্তার পানিতে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দ্বিমত করেননি। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন নেই। শুধু বক্তব্য-নির্ভরতায় তিস্তার পানি বাংলাদেশ পাবে না। সে জন্য চুক্তি করে অধিকারভিত্তিক পানি বাংলাদেশকে দেওয়া প্রয়োজন।
যখন রংপুর অঞ্চল মঙ্গার অঞ্চল বলে পরিচিত ছিল, ঠিক সে সময়ে তিস্তা সেচ প্রকল্প মঙ্গাপীড়িত অঞ্চলের মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। গত দুই বছরে তিস্তায় যে হাহাকার তৈরি হয়েছে, তাতে করে সেই সুবিধা এখন শুধুই অতীত। তিস্তার পানি ফেরাতে ব্যর্থ হলে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী আবারো অভাবী জনপদে পরিণত হতে পারে।
তিস্তাকে বাঁচাতে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করা জরুরি। সে সঙ্গে তিস্তা খনন করাও প্রয়োজন। তিস্তা খনন করা হলে বন্যা মৌসুমে সামান্য বৃষ্টিতেই যে ভাঙন আর বন্যা দেখা দেয়, তা হবে না। নিয়মিত খনন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখাও প্রয়োজন। যে তিস্তা জলদুগ্ধ দিয়ে উত্তর জনপদে প্রাণের সঞ্চার করে, সেই তিস্তার আজ মরণাপন্ন অবস্থা। তিস্তাকে বাঁচাতে রাষ্ট্রকেই প্রধান দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু সেই রাষ্ট্রচালকদের মধ্যে তিস্তার প্রতি যতখানি একাগ্রতা থাকা প্রয়োজন, ততখানি লক্ষ করা যায় না।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর