বেতন কাঠামো
শিক্ষকেরা কি আমলার সমান হতে চেয়েছেন?
অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোতে ১২৩ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির একটি ধুয়া তোলা হয়েছে। বেতন বৃদ্ধি আর বাজারের উচ্চমূল্যের সঙ্গে বেতনের সমন্বয় এ দুটো এক নয়। সেই বিবেচনায় বেতন বৃদ্ধির কথাটি ভাবগত অর্থে সত্য নয়। আমাদের দেশে সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তার সঙ্গে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তার চরম বৈষম্য রয়েছে। অন্যায় রকমের সে বৈষম্য। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের একটি সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র রয়েছে। সেই সাম্রাজ্যের বিস্তার এবার বেশি পরিমাণেই সাধিত হয়েছে। সেই সাম্রাজ্যবাদিতা এবার ঢুকে পড়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের এবার আরো ওপরে তোলা হয়েছে আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবনমন হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সরকারের এই অবনমন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। সরকার এ আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম নেতিবাচক মন্তব্য করেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনের সময়ে ইশতেহারে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে তার বাস্তবায়ন তো দূরের কথা ইশতেহারের উল্টো পথে হাঁটবেন, এটা কিছুতেই আশা করা যায় না। শিক্ষকদের ন্যায্য আন্দোলনের বিরুদ্ধে তিনি শিক্ষকদের চরম হেয়প্রতিপন্ন করে বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে শিক্ষকসমাজ এই বক্তব্য আশা করেনি। প্রধানমন্ত্রীর কথায় বোঝা যায়, বর্তমান সরকারের দর্শন আমলাতন্ত্রের পক্ষপাতমূলক।
আমাদের দেশের সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করারও চক্রান্ত চলছে। দেশে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক। সেনা তত্ত্বাবধানেও চলছে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার ব্যয় অনেক বেশি। ধনপতি আর আমলাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশও রয়েছে। মূলত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন সাধারণ ঘরের মেধাবীরা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে করে মেধাবীরা শিক্ষকতা করতে না আসেন, যাতে করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার ঐতিহ্য নষ্ট হয় সেই চক্রান্তে লিপ্ত একটি মহল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে পরিমাণ কটূক্তি করা হচ্ছে তাতে করে কোনো সুস্থ চিন্তার মেধাবীরা এখানে শিক্ষকতা করতে আসবেন না। এমনকি বিত্তবান মেধাবী শিক্ষার্থীরাও পড়তে আসবেন না। এতে করে ধীরে ধীরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকার নিজস্ব অর্থায়নেও চালাতে চায়। সাধারণ মেধাবী শিক্ষার্থীরা অর্থের অভাবে ভর্তি হতে পারবেন না, মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেবেন না। কম মেধাবীরা আসবেন শিক্ষকতায়। তখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ঐতিহ্যবাহী চরিত্রই বদলে যাবে। এতে আমলারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, উচ্চপদস্থ রাজনীতিবিদও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। ক্ষতি হবে দেশের।
প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সচিব হওয়ার জন্য। বিসিএসে অন্যান্য ক্যাডারদের মধ্যে কি বৈষম্য দূর হয়েছে? প্রধানমন্ত্রীর এই পরামর্শ অনেকেই গ্রহণ করবেন। অনেক মেধাবী শিক্ষক যাঁরা শিক্ষকতাই করতে চেয়েছিলেন কিন্তু এখনো সরকারি চাকরিতে আবেদন করার বয়স আছে, তাঁরা হয়তো চলে যাওয়ারই চেষ্ট করবেন। এত বড় অপমান আর অপবাদ নিয়ে তাঁরা শিক্ষকতা পেশায় থাকতে চাইবেন না-এটাই স্বাভাবিক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোতে অর্থমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণের দাবিসহ অন্যান্য যেসব অসঙ্গতি রয়েছে, তা দূর করার দাবিতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন লাগাতার কর্মসূচির ডাক দিয়েছে। কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানিয়ে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রেখেছে। শুধু শুধু তির্যক বাক্যবাণে সমস্যা ঘনীভূত না করে জাতির স্বার্থে আলোচনার মাধ্যমে, উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। সরকারের কোন অংশের চক্রান্তে নিয়ম না মেনে অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামো চূড়ান্ত করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
ধারাবাহিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্পর্কে যে মন্তব্যগুলো করছেন, তাতে করে কোনো শিক্ষকের মন ভালো থাকার কথা নয়। সহকর্মীদের সঙ্গে এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলেই বিষণ্ণতার সঙ্গেই নানা রকম হৃদয়ভাঙা মন্তব্য করছেন। শিক্ষকরা জীবনে কখনোই উচ্চবিত্ত হতে পারেন না। সম্মানটুকুই তাঁদের পুঁজি। সেই সম্মানের ওপর যে পেরেক ঠুকে দেওয়া হলো তাতে করে যাঁরা এখন শিক্ষকতায় আছেন, মানসিক যন্ত্রণা নিয়েই তাঁদের বাকি জীবন চাকরি করতে হবে।
শিক্ষকরা সচিবদের সমান কোনো দিন হতে চাননি। তাঁরা সম্মানের প্রশ্নে নির্দিষ্ট গ্রেডে উন্নীত হতে চান। সরকারিভাবে যদি কোনো গ্রেড জ্যেষ্ঠ সচিব দিয়ে পরিচিত করা হয় তা হলে যাঁরাই ওই গ্রেডে উন্নীত হতে চাইবেন, তাঁদের ওই পদের নামটিই উল্লেখ করতে হবে। তার অর্থ এই নয় যে তাঁরা সচিবদের সমান হতে চাইছেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন। কোনো দিন কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তো বলেনেনি যে, সচিবদের চাকরির বয়স বৃদ্ধি করা যাবে না। আর তা ছাড়া একজন সচিবের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে একজন অধ্যাপকের তুলনা করা চলে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের সঞ্চয় আর একজন সচিবের সঞ্চয় কখনোই সমান নয়। একজন সচিব কম চাকরিকালে বিত্তের পাহাড় কীভাবে গড়ে তোলেন, সেই প্রশ্ন তো একজন শিক্ষক তোলেননি। তাহলে শিক্ষকের সঙ্গে সচিবের তুলনার প্রসঙ্গ কেন আসছে? সচিব কাজ করেন করণিকের। ইউনিয়ন পরিষদেরও সচিব থাকেন, মন্ত্রণালয়েরও সচিব থাকেন। তাদের কাজ প্রায় একই। আর শিক্ষক কাজ করেন জ্ঞান সৃজনের, পাঠদানের। আমাদের দেশে কৃষিতে যে অভাবনীয় সাফল্য, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণার সাফল্যই বেশি। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যেটুকু গবেষণা হয়, তার প্রধান অংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। সেই শিক্ষকদের সম্পর্কে দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন নেতিবাচক কথা বলেন, তখন মেধাবী শিক্ষকরা কেন দেশে থাকতে চাইবেন? যাঁরা বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে যান তাঁদের অনেকেই ফিরে আসেন না। যারা ফিরে আসেন, তাঁদের ফিরে আসার পথটিও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে সরু হয়ে আসবে বলেই ধারণা করা যায়।
গণতন্ত্রের মোড়কে দেশ যদি আমলাতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত হয়, তাহলে এর পরিণতি কখনোই সুফল বয়ে আনবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে সচিবদের পক্ষ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের বিবৃতি এবং অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিষয়টি জিদের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারকে সময় দিয়ে এসেছেন সমস্যা সমাধানের জন্য। কিন্তু প্রায় আট মাস ধরে চলে আসা শিক্ষকদের এই চেষ্টার প্রতি যখন কোনো গুরুত্বই দিচ্ছে না, তখনই শিক্ষকরা লাগাতার ক্লাস বর্জন কর্মসূচি দিতে বাধ্য হয়েছেন।
গণতন্ত্র যখন প্রকৃত চরিত্র হারিয়ে বিকল্প বিবিধ তন্ত্রের ওপর নির্ভর করে, তখন নতুন নতুন সমস্যা সমাজে দেখা দেবে-এটাই স্বাভাবিক। বর্তমান গণতন্ত্র অনেকটাই আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভর করে আছে। আমাদের দেশে ব্যবসায়ী, সাবেক আমলা (বিশেষ করে বর্তমান অর্থমন্ত্রীর মতো) যখন রাজনীতিতে প্রভাবক হন, তখন তাঁরা গণমানুষের যন্ত্রণা বুঝতে পারেন না। তাঁদের পালস বুঝতে পারে না। তাঁরা গণমানুষ বিরোধী সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন সরকারে পরিণত করেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দাবির বিরুদ্ধে বর্তমানে সরকারের বিবৃতি আর সচিবদের বিবৃতিতে কোন পার্থক্য লক্ষ করা যায় না। অভিন্ন সুর। সুর অভিন্ন হলেও দেশের স্বার্থে-জাতির স্বার্থে শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। সরকারের উচিত দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ,বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর