জাগো বাহে
কাঁটাতারের এপারে স্মৃতি, ওপারে স্বপ্ন
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাগের সময়ে বাংলাদেশ থেকে অনেকই যেমন ভারতে গেছেন, ভারত থেকে অনেকেই বাংলাদেশে এসেছেন। আমরা সাহিত্য-ইতিহাসের পাতা থেকে সেই বাস্তবতা উপলব্ধি করি—দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময়ে যন্ত্রণাটা কেমন হয়, স্বজন রেখে যাওয়ার কষ্টটা কীরূপ। সে ঘটনার আর একটি পুনরাবৃত্তি ঘটে গেল সদ্যবিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে।
গত জুলাই মাসে ভারতের কোচবিহারে দেশ বিভাগের সময়ে ভারতে যাওয়া একজনের সঙ্গে কথা হলো। সেখানে অলক কুমার গুহ বাসায় নিয়ে গেলেন তাঁর অশীতিপর বৃদ্ধ মায়ের সঙ্গে দেখা করানোর জন্য। গভীর আবেগে আমার কাছে তাঁর মা জানতে চান—রংপুর এখন কেমন আছে? রংপুরের সেনপাড়া, গুপ্তপাড়া নামগুলো এখনো আছে কি না, মাহীগঞ্জ স্কুলটার এখন কী অবস্থা? একের পর এক তিনি স্মৃতিচারণ করতে থাকলেন। আবেগে-মায়ায়-ভালোবাসায়-বেদনায় তিনি স্মৃতির মধ্যে ডুবে থাকলেন। ১৬-১৭ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন। দেশভাগের সময়ে চলে গেছেন ভারতে। অলক দা বলেন, ‘রংপুর থেকে যিনিই আসুন না কেন, মা তাঁকে এসব জিজ্ঞাসা করেন। এই বয়সেও মা বাংলাদেশকে কিছুতেই ভুলতে পারেন না।’ তাঁর কথা শুনে মনে হলো, ভারতের চেয়ে তিনি বাংলাদেশকেই অন্তরে বেশি পরিমাণে ধারণ করে আছেন।
যাঁরা জন্মভূমি ছেড়ে যান, তাঁরা আসলে দেহটাকে নিয়ে যান। মনটা পড়ে থাকে স্বদেশে। মাকে ছেড়ে যেতে চাইলেই যাওয়া যায় না। যাঁরা ছেড়ে যান, তাঁদের চোখে বেদনার রং লেগে থাকে। বাংলাদেশের মধ্যে থাকা ভারতীয় ছিটমহলগুলো থেকে যাঁরা ভারতে যাওয়ার জন্য নাম লিপিবদ্ধ করেছিলেন, তাঁদের অনেকের মধ্যে যাওয়া না-যাওয়ার দোলাচল ছিল। নিজ নিজ জন্মভূমিতে থেকে গেছেন অর্ধলক্ষাধিক ছিটমহলবাসী। গত ১৯ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা সদ্যবিলুপ্ত ছিটমহলগুলো থেকে ৯৭৯ জন ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য চলে যান। নাম নিবন্ধন করলেও যাননি ৮২ জন।
গত ৫ জুন-২০১৫ ভারতের বিধানসভায় স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুমোদনের পূর্বে যতবার ছিটমহলে গিয়েছিলাম, ততবারই ছিটমহলবাসীর মনের আকাশজুড়ে ছিল হতাশার ঘনমেঘ। চুক্তি অনুমোদনের পর ছিটমহলগুলোতে আশার সঞ্চার হয়। ৩১ জুলাই ছিটমহল বিনিময়ের তারিখ নির্ধারণ হওয়ার পরের দিনগুলোতে তাদের চোখেমুখে ছিল স্বস্তির রেখা। ৩১ জুলাই মধ্যরাতে ছিটমহল কুড়িগ্রামের দাসিয়ারছড়ায় যখন ৬৮টি মোমবাতি জ্বালিয়ে ছিটমহলযুগের অবসান হয়, তখন সেই রাতে উপস্থিত থেকে দেখেছি মানুষের ঢল। কানায় কানায় উপচেপড়া আনন্দে মেতেছিলেন সেদিন ছিটমহলবাসী। ১৫ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই ছিটমহলে গিয়ে তাদের ৬৮ বছরের বঞ্চনা দূর করার ঘোষণা দিয়ে আসেন।
গত ২০ অক্টোবর দাসিয়ারছড়ায় ঢোকার সময়ে লক্ষ করলাম, আগের সেই ছিটমহল আর নেই। সড়ক প্রশস্ত হয়েছে এবং পাকা করার কাজ চলছে। সড়কের দুদিকে বিদ্যুতের খুঁটি। বিদ্যুৎ পেয়ে সদ্যবিলুপ্ত ছিটমহলবাসী ভীষণ খুশি। দাসিয়ারছড়ার কালীর হাট বাজারেও লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। বাড়ি বাড়ি গিয়ে খবর নিচ্ছিলাম, তাদের অনুভূতি এখন কেমন। কালীর হাট এবং দেবীর পাঠের মাঝামাঝি এক বাড়িতে গিয়ে শুনলাম, তাঁরা ভারতে যাওয়ার জন্য নাম লিখিয়েছেন; কিন্তু আর যাবেন না। কেন যাবেন না—জিজ্ঞাসা করতেই আচিয়া বেগম বলছিলেন, ‘হামার উন্নতি হইবে বুঝবার পারি নাই। এলা দেকি কারেন (বিদ্যুৎ) আচ্চে, রাস্তা পাকা হচ্চে, আমরা ইলিপের চাউল পাচি। হামরা আর যাবার নই। বেটা আগে দিল্লিত কাজ করছিল। এলা ঢাকা গেইচে।’
জন্মভূমি দেশ ছেড়ে যাওয়া সত্যিই বড় কঠিন। যাঁরা বাংলাদেশ থেকে ভারতে গেলেন, তাঁরা কেউ সেখানে চাকরি করেন, কারো আত্মীয়স্বজন অধিকাংশই ভারতে, কেউ কেউ ধর্মীয় কারণে, আর কেউ ছিটমহল বিনিময়ের বিরোধিতা করেছিলেন। একসময়ে যাঁরা যেতে চেয়েছেন, তাঁদের অনেকেই যাননি। যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে নাম নিবন্ধন করেছিলেন ৬৫ বছরের কৃষ্ণনাথ। তিনি বলছিলেন, ‘যেদিন নাম দিছি ভারতে যাবার জন্যে, সেদিন থাকি মেনটাল হছি। আমার খালি মনে হয়, এটা কী সর্বনাশ করলাম আমি। মন ঠিক করার জন্যে চার দিন মা-মনসার উদ্দেশে পূজা দিছি। মন ভালো হয় নাই। আমি দেশ ছাড়ার চিন্তায় অসুস্থ হছি। মরি গেইলেও আমি আর ভারত যাবার নই।’ কৃষ্ণকান্ত না গেলেও তাঁর আপন ভাই ধীরেন্দ্রনাথ বলছিলেন তিনি ভারত যাওয়ার পক্ষে। ধীরেন্দ্রনাথের নাতনি ডিগ্রি পড়ুয়া অনীতা কিছুতেই যেতে চাননি। তাঁরা বাবা-মা-নানা-নানি সকলেই যাবেন। তাঁর না গিয়ে কোনো উপায় নেই। অনীতার আক্ষেপ করা দেখে তাঁর নানি অনীলা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। বিলাপ করে বলতে থাকলেন, ‘আমার কেউ নাই। খড়কুটার মতো ভাসতে ভাসতে ভারত যামো। এই বাড়িতে রইদ (রোদ) ছিল। গাছ লাগাচি। এলা ছায়া। সব থুইয়া যাওয়া নাগবে। আমার কিচ্ছু নাই, কেউ নাই। আমার নাম দেওয়ার আগে একটাবার জিজ্ঞাসাও করে নাই।’ ধীরেন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মুখের এক কথা। যাওয়ার কথা বলছি, যামো। কথা নড়াইলে অধর্ম হইবে। পাপ হইবে।’
১৯ নভেম্বর থেকে ভারতের মূল ভূখণ্ডে যাঁরা যাওয়ার জন্য নাম লিখিয়েছেন, তাঁদের যাওয়া শুরু হয়। ২২ নভেম্বর কুড়িগ্রামের দুটি ছিটমহল থেকে বাগভাণ্ডার সীমান্ত দিয়ে ৭২ জন গেছেন। আমি ২১ নভেম্বর বিকেলে গেলাম কুড়িগ্রামের দাসিয়ারছড়া সদ্যবিলুপ্ত ছিটমহলে। সেখানে প্রস্তাবিত শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মাদ্রাসা মাঠে সারিবদ্ধ ট্রাক চোখে পড়ল। ট্রাকগুলোতে যাঁরা ভারতে যাবেন, তাঁদের মালামাল ওঠানো হচ্ছে। হরিচরণ নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে গেলাম। তাঁরা সপরিবারে ভারতে যাবেন। তাঁদের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম, ঘরের ভেতর আর কিছুই নেই। শূন্য ঘর। উঠানে দাঁড়ানো পরিবারের সদস্যদেরও ভেতরটা যেন খালি হয়ে আছে। ঘরের শূন্যতা আর মনের শূন্যতার ছায়া পড়েছে তাঁদের মুখের ওপর। বৃদ্ধ লক্ষ্মী রানীর চোখ থেকে বিরতিহীন শুধু জল গড়িয়ে পড়ছে। তিনি কোনো কথাই বলছেন না। জমাট কষ্ট চোখের জলে গড়িয়ে পড়ছে।
২২ নভেম্বর সকাল সোয়া ৭টায় পৌঁছালাম হরিচরণদের বাড়িতে। সেখানে শোকের মাতম। হৃদয়বিদারক এক করুণ আলেখ্য সেদিনের সকালটা। ভারতযাত্রীরা বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন জন্মভূমি স্থান ছেড়ে যাওয়ার বেদনায়। আত্মীয়স্বজনও কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। বাসে উঠেও অনেকেই মাতম করছেন। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের মতো মনে হলো। বাস যখন বাগভাণ্ডার সীমান্তে এসে পৌঁছায়, তখনো বাসযাত্রীদের আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। সীমান্তে বিদায় সংবর্ধনা ফটকে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে লেখা হয়েছে, ‘যেতে নাহি দেব। হায়,/ তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।’ সীমান্তের একটু দূরেই শত শত স্বজন মলিন চোখে তাকিয়ে আছেন। অনেকেই চোখ মুছতে থাকেন। দূর থেকে হাত নাড়িয়ে তাঁদের বিদায় জানালেন তাঁরা। যাঁরা ভারতে গেলেন, তাঁরা মূলত নিজ দেশেই গেলেন। তবুও জন্মভূমি স্থানের স্মৃতিই হয়তো একদিন তাঁদেরও অলক কুমার গুহের মায়ের মতো স্মৃতিকাতর করে তুলবে। কাঁটাতারের এপারে রইল তাঁদের অযুত স্মৃতি, ওপারে সীমাহীন স্বপ্ন।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।