জন্মদিন
সংকট সন্ধিক্ষণের নেতা জিয়াউর রহমান
ক.
নেতৃত্ব সম্পর্কে বহুল উচ্চারিত শেকসপিয়ারের সংলাপটি এ রকম “Some are born great, some achieve greatness and some have greatness thrust upon ’em.” জিয়াউর রহমান উত্তরাধিকার সূত্রে নেতা ছিলেন না, ক্ষমতার দাপটেও তাঁর ওপর মহত্ত্ব আরোপিত হয়নি। তিনি নেতৃত্ব কর্তৃত্ব মহত্ত্ব অর্জন করেছিলেন নিজ কর্তব্যগুণে। তাঁর অবদান, তাঁর ব্যক্তিত্ব, তাঁর চরিত্র তাঁকে মহত্ত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। পৃথিবীর ইতিহাস প্রমাণ করে কোনো কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতিতে একজন মহৎ মানুষ, একজন বীর যোদ্ধা অথবা একজন ত্রাণকর্তা বেরিয়ে আসেন, যিনি দেশ জাতি রাষ্ট্রকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেন। তুর্কি বীর কামাল পাশা, ফরাসি বীর নেপোলিয়ান এবং দ্য গল, মিসরের জামাল আবদুন নাসের ছিলেন এ ধারার জাতীয় বীর। মনীষী কার্লাইল এমন সব বীরের স্মরণেই বলেছেন ‘A hero appears in the world according to the need of his time.’
খ.
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন ২৫ মার্চ এবং তৎপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের নিরস্ত্র, নিরীহ মানুষের ওপর গণহত্যা শুরু করে তখন এসব স্বাধীনতাকামী মানুষ অভিভাবকহীন, নেতৃত্বহীন, সিদ্ধান্তহীনভাবে চরম অসহায়ত্ব, অনিশ্চয়তা, হতাশা এবং ভীতির মধ্যে নিপতিত হয়। এ সংকটময় সময়ে একটি কণ্ঠের বীরোচিত ঘোষণা গোটা জাতিকে আন্দোলিত করে। মেজর জিয়ার এ অকুতোভয় ঘোষণা গোটা দেশে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে এবং অনিশ্চিত অবস্থার অবসান হয়। ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ। জিয়া চট্টগ্রামে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তা ও সৈনিকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন এবং সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার নির্দেশ দেন। জিয়ার নেতৃত্বে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিহত করে। পরে তারা ভারতে প্রবেশ করে। ৭ জুলাই ১৯৭১ গঠিত হয় জিয়ার নামের আদ্য অক্ষর দিয়ে ‘জেড’ ফোর্স। তিনি হন সেক্টর কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধে জেড ফোর্স বিশেষ অবদান রাখে। ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার নেতৃত্বে সংঘটিত চট্টগ্রামের প্রতিরোধ যুদ্ধকে স্টালিনগ্রাদের যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেন। পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য তিনি বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত হন।
গ.
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা শিগগিরই রাজনৈতিক নিপীড়ন, অর্থনৈতিক সংকট, সামাজিক উত্তেজনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনাবলি জাতিকে রাজনৈতিক সংকট থেকে সামরিক সংকটে নিপতিত করে। অভ্যুত্থান, প্রতি অভ্যুত্থান, ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চক্রে ৭৫-এর ৩-৭ নভেম্বর জাতি এক অনিশ্চিত সময় অতিক্রম করে। এ সময়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান গৃহবন্দি হন। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের পুনরাবৃত্তি ঘটে এ সময়। সাধারণ সৈনিকরা নির্দেশের সোপানকে অগ্রাহ্য করে ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসে। বাম ধারায় অনুপ্রাণিত নেতৃত্বে এ অসাধারণ ‘বিপ্লব’ ঘটালেও তারা এ বিপ্লব ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। রচিত হয় সৈনিক জনতার এক অপূর্ব মেলবন্ধন। ব্যক্ত হয় সেনা অধিনায়ক জিয়ার প্রতি সৈনিক ও সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন। বাম বিপ্লবীদের নেতৃত্বে এবং সাধারণ সৈনিকদের কর্তৃত্বে জিয়াউর রহমান গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্ত হন। জিয়াউর রহমান সেনানিবাসে আনীত হন। জিয়াউর রহমান হৃত সেনাপ্রধানের পদে অধিষ্ঠিত হন। ঘটনার পরম্পরা অবশেষে জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করে।
বাম ধারার বিপ্লবীদের পক্ষ থেকে স্লোগান উচ্চারিত হয়, ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই’। লিফলেট বিতরণ করা হয়। সৈনিকদের আবারও ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসতে বলা হয়। সর্বাত্মক অরাজকতা সৃষ্টি হয় প্রায় সকল সেনানিবাসে। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব, কঠোর পরিশ্রম, নির্দেশনা, ব্যবস্থাপনা, অফিসারদের প্রণোদনায় অবশেষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরে আসে।
ঘ.
পরবর্তী পাঁচ বছরে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন সাধন করেন। এসব কিছুকে আদর্শ বা নীতিগত, কাঠামোগত, আইনগত, উন্নয়নগত ও প্রথাগত পরিবর্তন বলে চিহ্নিত করা যায়। বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-অনুভূতি-বিশ্বাস ও জীবনবোধের নিরিখে তিনি সংবিধান সংশোধন করেন। ‘বিসমিল্লাহ’ সংযোজন করেন। ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের সূচনা করেন। সংবিধানে ও উন্নয়ন কৌশলে সমাজতান্ত্রিক ধারা (তথাকথিত অধনতান্ত্রিক পথ) পরিহার করেন, মুক্ত অর্থনীতি, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি, রাজনীতিতে উগ্র বাম ও উগ্র ডানের সমদূরত্বে মধ্যপন্থা অনুসরণ করেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন করেন। সর্বাত্মক এ পরিবর্তনের নিরিখেই সমাজতাত্ত্বিকরা তাঁকে আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি বলে অভিহিত করেছেন।
ঙ.
প্রেসিডেন্ট জিয়ার আর একটি বড় অবদান হচ্ছে জাতীয় সমঝোতা ও সমন্বয়ের রাজনীতি (Politics of National Reconciliation) । সমাজে বিরাজমান বিভক্তি এবং সৃষ্ট বৈরিতা অবসানে জিয়াউর রহমান বিবিধ কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
১. এ সময়ে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধির (Political party Regulations-PPR)-এর আওতায় কার্যক্রম শুরু করতে জিয়াউর রহমান অনুমতি প্রদান করেন। এ সময়ে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ প্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
২. ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদে শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তিনি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন করে সমন্বিত জাতীয় ঐক্যের প্রমাণ রাখেন।
৩. ব্যক্তিক উপলব্ধির বাইরেও তাঁর প্রথম রাজনৈতিক নিবন্ধ ‘একটি জাতির জন্মে’ একটি কাঙ্ক্ষিত জাতি গঠনের প্রত্যয়ে তিনি ক. বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিচয়, খ. দেশের জনগণ, গ. বাংলা ভাষা, ঘ. সংস্কৃতি, ঙ. অর্থনৈতিক জীবন, চ. ধর্ম এবং ছ. আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সবকিছুকে সমন্বিত করেন।
৪. জাতিসত্তার পরিচয় অস্বীকৃত চাকমা, মারমা, গারো, সাঁওতালসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মোড়কে সুসংহত হয়।
৫. ‘আমাদের পথ’ শীর্ষক নিবন্ধে জিয়াউর রহমান লিখেছেন, ‘আমাদের প্রয়োজন অনতিবিলম্বে জনশক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা... ওয়ান পার্টি সিস্টেম এবং রেজিমেন্টেশন এনফোর্স করে’ যে সাফল্য লাভ করা যায় না অতীত তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। রাজনীতিতে থাকবে প্রতিযোগিতা, কিন্তু বৈরিতার কোনো স্থান নাই’।
৬. বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতীয় সংকট উত্তরণে এবং জনগণের অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধির জন্য জিয়াউর রহমানের অবদান চির অম্লান, চির ভাস্বর, চিরস্মরণীয়।
৭. বাংলাদেশি জাতির এক সংকট সন্ধিক্ষণে আমরা জিয়াউর রহমানের ৮০তম জন্মবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছি। এরই মধ্যে অনেক অর্জন ও বর্জনের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় জীবন অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু জাতীয় মৌলিক নীতিমালার (National Fundamental Principles) ক্ষেত্রে দীর্ঘ কাঙ্ক্ষিত জাতীয় ঐকমত্য (National Consensus) অর্জিত হয়নি।
তাই জাতীয় জীবনের এই মহাসংকট সন্ধিক্ষণে শহীদ জিয়ার প্রতিচ্ছবি দেশনেত্রী খালেদা জিয়া যথার্থভাবেই আহ্বান জানিয়েছেন ‘দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও’। শহীদ জিয়ার ৮০তম জন্মবার্ষিকীতে শহীদ জিয়ার সংকট নিরসনের শপথ ও সংকল্প, তাঁর অনুসৃত সততা-ত্যাগ ও দেশপ্রেমের ফল্গুধারা আমাদের দেশ বাঁচাতে ও দেশের মানুষকে বাঁচাতে উদ্বুদ্ধ করুক এই প্রার্থনা।
লেখক : ড. আবদুল লতিফ মাসুম, অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।