সহজ প্রশ্ন
আমজনতার আম-ছালা দুটোই যাবে?
আম দেখে ইংরেজরা সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলেই নাকি খুব বিস্মিত হয়েছিল। তারা দেখেছিল, গাছ থেকে আম পড়লেই মানুষ ছুটে যায়। আমটা কুড়িয়ে আনতে। ইংরেজরা তাই আমের নাম দিয়েছিল ‘মানুষ যায়’। যার ইংরেজি করলে দাঁড়ায়, ম্যান গো। একটা কৌতুক দিয়ে শুরু করলাম। আগে ছিল রাজা যায় রাজা আসে, কিন্তু এখন মনে হয় প্রবাদটা বদলে গিয়ে হয়েছে মানুষ যায়, মানুষ আসে। আর আমজনতা শুধু আমের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে জীবন শেষ করে কিন্তু রসটা নিংড়ে খায় করপোরেট আমের বোতল। সেখানেই নাকি আসল আমের স্বাদ!
চট্টগ্রামে চিকিৎসকের অবহেলায় এক প্রসূতির মৃত্যু এবং অপর এক রোগী পঙ্গুত্ব বরণ করে, এমন অভিযোগে দুটি মামলা হওয়ার পর থেকে আন্দোলনের নামে চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলোচিত চরিত্র হয়ে দেখা দিয়েছে চিকিসকরা। চিকিৎসায় অবহেলা, একই পরীক্ষার ভিন্ন ক্লিনিকে রিপোর্টের পার্থক্য, মাত্রাতিরিক্ত ফিস, সাংবাদিকদের মারধর, এ ছাড়া রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে খারাপ আচরণ নিত্যদিনের ঘটনা। এ নিয়ে ক্ষুব্দ স্বজনরা হাসপাতাল ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটিয়েছে। কিন্তু মুশকিল হলো, এঁরা এমন এক পেশায় কাজ করছেন যেটার সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা বেশি। সে সুযোগটা নিচ্ছেন তাঁরা, জনগণকে জিম্মি করে ফেলছেন।
ডাক্তাররা কি আইনের ঊর্ধ্বে? জানা মতে, চিকিৎসায় অবহেলায় কারো কোনো আইনি শাস্তি হয়েছে এমন উদাহরণ নেই। অন্য সব জায়গায় ভিন্নমত থাকলেও এখানে যেন বিএমএ, ড্যাব সব এক। সবাই এক হয়ে ছুটছেন টাকার পেছনে, এতে রোগী বাঁচল কি মরল কিছুই যায়-আসে না। যাঁরা রোগব্যাধি নিয়ে হাসপাতালে ছোটেন বা স্বজনদের ডাক্তারখানায় নিয়ে যেতে হয় তাদের অভিজ্ঞতা আরো ভয়াবহ। ভাবটা এমন যেন, ‘তোমরাই তো বলো, কাউকে বাঁচাতে গেলে ঈশ্বরের পরই ডাক্তারের স্থান। কাজেই কাকে বাঁচাব কাকে মারব তা আমার হাতেই।’
দুই.
অনেক দিন আগের কথা। চট্টগ্রামে ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জনসভা কাভার করতে গেছি সংবাদকর্মী হিসেবে। অনুষ্ঠান শেষে যখন ফিরছিলাম, অনুষ্ঠানস্থলের পাশে একটি বাঁশ ডিঙানোকে কেন্দ্র করে কিছু পুলিশ সদস্য এমন আচরণ করলেন, আমি হতবাক। প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে উল্টো পুলিশের মার খেলাম এবং হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো সিএমপি কার্যালয়ে। অথচ ক্রাইম রিপোর্ট করার সুবাধে এই পুলিশদের অনেকে আমার পরিচিত ছিল। এই পুলিশরা এমন নাটক সাজিয়ে ফেলল যেন আমি পুলিশ সদস্যদের মেরেছি, তখন অপমানে কাঁদা ছাড়া কিছুই করার নেই।
চট্টগ্রামের অনেক সংবাদকর্মী বিষয়টি জানেন, পরে আমার পত্রিকার চিফ রিপোর্টার এম নাসিরুল হক সেখান থেকে আমাকে নিয়ে আসেন। সেই ট্রমা কাটাতে আমার বেশ সময় লেগেছিল। যেমনটি এখন লাগছে প্রিয় ছোট ভাই গোলাম রাব্বীর। পুলিশ তাকে মারল, অপমান করল আর পুলিশপ্রধান সাফাই গাইলেন, ‘রাব্বী সাহেব যেহেতু পুলিশের কাজে বাধা দিয়েছেন, সেটি ফৌজদারি অপরাধের শামিল।’ এর আগে অভিযুক্ত এসআই মাসুদ ফেসবুকে সাফাই গাইতে গিয়ে ফেসবুক আইডি ব্লক করেছে কর্তৃপক্ষ। পরে পুলিশ হেল্প লাইন পেজে প্রচার চালানো হয়েছে, ‘রাব্বীর পক্ষ হয়ে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি লড়ছেন।’ কী অদ্ভুত যুক্তি! এরপরও তো মামলা নিতে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত হলো।
একজন অপরাধীকে বাঁচাতে পুলিশ প্রধান বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এমন আচরণ সত্যি হতবাক করে। অথচ এঁরাই বড় করে ব্যানারে লিখে রাখেন, ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’। কিন্তু যাঁরা আমজনতা, বড়াই করে বলার মতো কোনো পরিচয় নেই তাঁরা মাত্রই জানেন হুমায়ুন আজাদের সেই প্রবচনটা কতটুকু সত্য, ‘ইউরোপ-আমেরিকায় সবচেয়ে ভদ্র, শিক্ষিত ও বিনয়ী লোকজন হয় পুলিশ। আর আমাদের দেশে অসভ্য-অভদ্র লোকগুলো পুলিশ।’ আর তাই এদের হাতে জিম্মি আমজনতা। বিশেষ করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর অনেক পুলিশ প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেছে, সরকারকে তারাই টিকিয়ে রেখেছে। যার সবশেষ প্রকাশ্য রূপ পেল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র কর্মকারকে মারার সময় পুলিশ বলছিল, ‘মাছের রাজা ইলিশ আর দেশের রাজা পুলিশ’।
তিন.
বেতন বৈষম্য ও জাতীয় বেতন স্কেলে মর্যাদাহানির অভিযোগ তুলে প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু করেন দেশের ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ভাবতাম ইস, যদি শিক্ষক হতে পারতাম! কিন্তু পরে যখন কলমসৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছি, তখন এঁদের চরিত্র দেখে অবাক হতাম, ভালো নম্বর, শিক্ষক বানানো থেকে শুরু করে পদ-পদবির জন্য এঁরা যে রাজনৈতিক নেতার পা চাটতে পারেন তার উদাহরণ অনেক। কারো কারো দলবাজি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি যাঁরা করেন তাঁদের তোষণ করেই চলেন।
এই শিক্ষকরা নানা ছুটি নিয়ে বিদেশ ঘুরেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন। এরপরও আমি বলছি না, তাঁদের ন্যায্য অধিকার না মানতে, কিন্তু শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে কেন? শিক্ষকদের ক্লাস না নেওয়ার কারণে বছরের পর বছর সেশনজটে আটকা পড়ে একদিকে যেমন চাকরির বয়সসীমা পেরিয়ে যায়, তেমনি অনেকে পারেন না পড়ার খরচ চালিয়ে নিতে। এরপর আন্দোলন থামাতে হয় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে। এখানেই সবার প্রশ্ন, অন্য মন্ত্রীরা তাহলে করছেনটা কী?
চার.
পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলন তো আরো ভয়াবহ। এরা বেপরোয়া গাড়ি চালাবে, মানুষ মারবে, তারেক-মিশুকের মতো মানুষ হারিয়ে যাবেন কিন্তু তাদের কিছু বলা যাবে না। বললেই একদিকে শ্রমিক নেতা, পরিবহন কোম্পানির মালিক, সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান এগিয়ে আসবেন তাদের বাঁচাতে। ওদের পক্ষ নিয়ে কথা বলবেন। সারা দেশে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। কাজেই নিয়ম না মেনে লাইসেন্স দিতে হবে। নো প্রবলেম! জিম্মি তো সেই আমজনতা। তাঁরাই তো পাবলিক যানে চলাচল করেন।
একমাত্র সাংবাদিক ছাড়া আর সবাই যেন ঐক্যবদ্ধ। কাজেই তাঁরা পান থেকে চুন খসলেই খুন করতে এগিয়ে আসেন। এতে পাবলিকের কী হলো, তাতে কী এসে গেল! আমজনতা আম পাবে না, বড়জোর আঁটি পাবে।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, সময় টেলিভিশন