জাগো বাহে
নাগরিক সুবিধাবিহীন নগর রংপুর
২০১০ সালের আগেও রংপুর একটি জেলা শহর ছিল মাত্র। এ শহর সম্পর্কে যাঁরা অবগত আছেন তাঁরা জানেন, এই শহর কতটা পরিচ্ছন্ন, নিরিবিলি এবং নিরাপদ ছিল। ছিমছাম ছিল জীবনপ্রবাহ। ক্রমে সেই শহর বিভাগীয় শহরে পরিণত হলো। রংপুর বিভাগ ঘোষণা হওয়ার পর আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছিল রংপুরবাসী। নিঃসন্দেহে রংপুরবাসীর জন্য এই বিভাগপ্রাপ্তি অনেক বড় ঘটনা। রংপুরের আলাদা করে উন্নয়নের জন্য বিভাগ ঘোষণা ছিল অত্যন্ত জরুরি।
কুড়িগ্রাম, লালমনির হাট, পঞ্চগড়, নীলফামারীসহ আটটি জেলা থেকে রাজশাহী শহরে দিনে গিয়ে কাজ করে দিনে ফেরা সম্ভব হতো না। রংপুর নিকটবর্তী হওয়ায় রংপুর বিভাগের আটটি জেলার সাধারণ মানুষের ভোগান্তি অনেকটাই কমে এসেছে। এতে রাজশাহী শহরের কিছুটা গুরুত্ব কমেছে। সেই গুরুত্ব এসে যোগ হয়েছে রংপুর শহরে। রংপুর বিভাগের আট জেলার মানুষ এখন তাদের কাজে রংপুর আসে।
ফলে রংপুরে মানুষের যাতায়াত বেড়েছে অনেকখানি। ধীরে ধীরে সেই ছিমছাম শহরের জীবনপ্রবাহে যুক্ত হয় নগর সংস্কৃতি। প্রতিদিন যখন অসংখ্য নতুন নতুন লোক শহরে আসতে থাকে তখন শহরে অপরাধী চক্রও সক্রিয় হতে থাকে।
বিভাগীয় শহর ঘোষিত হওয়ার পর থেকে রংপুরবাসী দাবি জানাতে থাকে রংপুর শহরকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করা হোক। সিটি করপোরেশন ঘোষণা করতে সরকার বিলম্ব করছে দেখে রংপুরবাসী হরতালের মতো কর্মসূচিও দিয়েছিল। সরকার রংপুরকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করে। বিভাগীয় শহর এবং সিটি করপোরেশনে অনেকেই নিজেদের জন্য জমি কেনা, বাড়ি করা এসব বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ফলে প্রতিদিনের তুলনায় প্রতিদিন রংপুরের জনঘনত্বের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
যতদ্রুত রংপুর শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে সেই তুলনায় নাগরিক সুবিধা বাড়েনি। প্রায় চার বছরে রংপুর শহরের চার লেনের সড়কের কাজ শেষ হয়েছে। সেই কাজ শেষ হতে না হতেই রাস্তার অনেক স্থানেই ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। সড়কের সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকাগুলোতে অর্ধেক অংশই ব্যবসায়ীদের দখলে। ফুটপাতসহ অনেকটা রাস্তাজুড়ে চলছে ব্যবসা। ফলে দীর্ঘ জানজট সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক স্থানেই মাঝখানে বিদ্যুতের খুঁটি রয়েছে। রাস্তা যখন সরু ছিল তখন রাস্তার পাশে ছিল বিদ্যুতের খুঁটি। এখন রাস্তা প্রশস্ত হওয়ার কারণে সেই খুঁটি চলে এসেছে রাস্তার ভেতর। কিন্তু সেই খুঁটি বিদ্যুৎ বিভাগ এখন পর্যন্ত সরিয়ে ফেলেনি। রংপুর শহর এখন কার্যত অটো রিকশার দখলে। অপরিকল্পিত অটোরিকশা রংপুরের জানজটের আর একটি কারণ। অটো রিকশার সংখ্যা কমিয়ে টাউন সার্ভিসের ব্যবস্থা করা গেলে বরং জনগণ বেশি সুবিধা পেত।
রংপুর জেলা শহর হিসেবে অনেক পুরাতন। সে কারণে পথের ধারে অনেক বয়সী গাছ ছিল। সবুজে ঢাকা ছিল পথের দুধার। রাস্তা প্রশস্তকরণের সময়ে সেই সবুজ নিধন হয়। সড়ক প্রশস্ত করা হলেও আর সড়কের পাশে কোনো গাছ লাগানো হয়নি। ফলে এখন নৈসর্গিক সৌন্দর্যহীন হয়ে পড়েছে রংপুর নগর।
চুরি-ছিনতাই-সন্ত্রাসের নগরে পরিণত হচ্ছে রংপুর। প্রায় প্রতিদিনই শোনা যায় চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনার কথা। রংপুরে খুনের ঘটনাও বেড়েই চলেছে। কয়েক দিন আগে রংপুরে মেট্রোপলিটন সিটি ঘোষণা করা হয়েছে। রংপুরের জনবসিত বাড়লেও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যের স্বল্পতা হেতু তা অনেক সময়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল না। রংপুরবাসী অপেক্ষা করে আছে, মেট্রোপিলিটন নগর হিসেবে পর্যাপ্ত জনবল রংপুরের আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন সাধন করবে।
রংপুর পৌরসভা সিটি করপোরেশনে উন্নীত হলেও এখন পর্যন্ত নতুন অর্গানোগ্রাম হয়নি। সে কারণে নতুন কাঠামোতে নতুন জনবল নিয়োগ করা সম্ভব হয়নি। নতুন সিটি করপোরেশন হিসেবে সরকার বিশেষ কোনো বাজেটও দেয়নি। ফলে পৌরসভার জনবল এবং পৌরসভার আয় দিয়েই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে সিটি করপোরেশন। শহরের পরিচ্ছন্নতার জন্য বিশেষ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনি নগর পিতা।
পৌরসভার চেয়ে প্রায় চারগুণ বেশি এলাকা নিয়ে সিটি করপোরেশন হয়েছে। নতুন করে যুক্ত হওয়া এলাকাগুলোর অনেক স্থানেই কাঁচা সড়ক আর পল্লী বিদ্যুৎ। নগরের অনেক সড়ক সন্ধ্যার পর অন্ধকারেই থাকে। সেখানে নেই কোনো সড়কবাতি। বর্তমানে এসব এলাকার জনগণকে অধিক পরিমাণে খাজনা দিতে হয়। কিন্তু কোনো রকম নাগরিক সুবিধা নেই।
রংপুর যখন শুধুই জেলা শহর ছিল তখন দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টি হলেও মুহূর্তেই নেমে যেত সেই পানি। কিন্তু এখন একটুখানি বৃষ্টি হলেও প্রশস্ত সড়কগুলো জলাবদ্ধ হয়ে থাকে। রংপুর ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। তারপরও রংপুরের বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ যথাযথভাবে হচ্ছে না। আবাসিক এলাকার সড়কগুলো যে পরিমাণ প্রশস্ত হওয়া জরুরি তা নেই।
রংপুর শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া শ্যামাসুন্দরী খালের বিভৎস রূপ দেখলে অবাক হতে হয়। এই খাল রংপুরের পয়োনিষ্কাশনে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারত। নগরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিরও একটি অনুষঙ্গ হতে পারত। অথচ সেই খালটিতে জমে থাকা ময়লা এখন শহরে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। রংপুরে জনগণের চাহিদার তুলনায় শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবাও অপর্যাপ্ত।
রংপুরের উন্নয়নে বর্তমান সরকারের ভূমিকা প্রশংসনীয়। রংপুর বিভাগ, সিটি করপোরেশন, মেট্রোপলিটন সিটি সব কিছুই বর্তমান সরকারের করা। পরিকল্পনা আর সামান্য বিনিয়োগের অভাবে এত বড় বড় অর্জনও যেন কিছুটা মলিন হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এমন কোনো মাস্টার প্লান তৈরি হয়নি যেটা অনুসরণ করতে রংপুর জেলা প্রশাসন এবং নগর প্রশাসন মানতে বাধ্য হয়। এই দুই প্রশাসনের মধ্যে রয়েছে রশি টানাটানি। দুই প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা পরিকল্পিত নগর বাস্তবায়নে বাধা হয়ে আছে।
যাঁরা রংপুর শহরের দীর্ঘদিনের নাগরিক তাঁদের জিজ্ঞেস করলে বলবেন, আগে রংপুর ভালোই ছিল। গত ছয় বছরে রংপুর অনেক ব্যস্ত শহরে পরিণত হয়েছে। কিন্তু নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি পায়নি। রংপুর শহরে এখন বিপুল খোলা জায়গা রয়েছে। সরকার চাইলেই এ শহরকে পরিকল্পিত শহর হিসেবে গড়ে তোলা কঠিন কিছুই নয়। বর্তমান সরকার যেহেতু রংপুরের সব উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে তাই বোধ করি নাগরিক সুবিধা সৃষ্টি করাও তাদেরই দায়িত্ব।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।