প্রতিক্রিয়া
দীপনের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের প্রকাশনার জগৎ
জাতীয় জীবনে অপসংস্কৃতির কর্তৃত্ব ও অপশক্তির তৎপরতার মধ্যে ইসলামের নামে সক্রিয় গুপ্তঘাতকদের হাতে প্রগতিশীল প্রকাশক, জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপন শহীদ হন। তাঁর এই শাহাদাতের ঘটনায় কেবল বাংলাদেশ নয়, গোটা পৃথিবী নড়ে ওঠে। পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রে সভ্যতার ভবিষ্যৎ নিয়ে বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মনে অনেক নতুন প্রশ্ন দেখা দেয়। আরো অনেক মৃত্যু ঘটেছে এবং ঘটছে। ব্যাপারটি নিয়ে কোনো যোগ্য ব্যক্তি অনুসন্ধান চালালে চলমান সভ্যতার সংকটের অনেক গুরুতর রহস্য বোঝা যাবে।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, আস্তিকতা-নাস্তিকতা, দুর্নীতি, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, নির্বাচন, ক্লিন হার্ট অপারেশন, এনকাউন্টার, ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ইত্যাদি ধারায় যে কাণ্ডকারখানা বাংলাদেশে চলছে, তাতে বাংলাদেশ কি আর সভ্যতার ধারায় আছে? অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তি নিয়ে মানবজাতি আজ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ন্যাটো ইত্যাদির পরিচালনায় যে ধারায় চলছে তা কি সভ্যতার ধারা? লাখ লাখ বছরের বন্যাবস্থার ও বর্বরতার পর্যায় অতিক্রম করে মানবজাতি বড়জোর ১০ হাজার বছর ধরে সভ্যতার ধারায় চলছিল। এর মধ্যে নানা জটিলতা ও উত্থান-পতন গেছে। এখন দেখা যাচ্ছে, উৎপাদন বৃদ্ধি ও সম্পদের প্রাচুর্যের মধ্যে ইতিহাসের চাকা যেন পেছন দিকে ঘুরছে। কখনো কখনো মনে হয়, বিশ্বায়নের নামে মানবজাতি যেন বর্বরতা ও বন্যাবস্থার দিকে ফিরে চলছে। অতীতের অপসৃত সব সংস্কার-বিশ্বাস পুনরুজ্জীবিত ও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এ নিয়ে পৃথিবীর সর্বত্র সাধারণ মানুষ ও বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মধ্যে যে অসন্তোষ দেখতে পাই, তাতে আশা করি ইতিহাসের পশ্চাৎগতি একদিন উল্টে যাবে এবং সম্মুখগতি সূচিত হবে।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এ দেশে সরকার কর্তৃক কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হতো ব্রিটিশ শাসনকালে ও পাকিস্তানকালে। তার মধ্যেও বিবেকবান চিন্তাশীল লেখক, প্রগতিশীল সাংবাদিক ও ন্যায়কামী রাজনীতিবিদরা নির্যাতন সহ্য করে অপরাজেয় মনোবল নিয়ে মত প্রকাশ করতেন এবং হাজারো জটিলতার মধ্যে নিজেদের বিবেকের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে কাজ করতেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর চরম বিশৃঙ্খলা ও অপব্যবস্থার মধ্যে সেই চরিত্রবল হারিয়ে যায়। এখন এ দেশে চিন্তার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর কেবল সরকারি নিয়ন্ত্রণই নয়, সরকারি নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে আছে দেশি-বিদেশি নানা শক্তির নিয়ন্ত্রণ। এখনকার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ, পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ কোনোটাই কম ক্ষতিকর নয়। এর মধ্যে আছে জঙ্গিবাদীদের হত্যাযজ্ঞ।
উপন্যাস, গল্প, কবিতা, নাটক যাঁরা লেখেন তাঁদের মনের অবস্থা কেমন? কী চিন্তা করেন তাঁরা? লেখনী দিয়ে তাঁরা কী অর্জন করতে চান? বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের গবেষণার প্রকৃতি কী? গোটা শিক্ষাব্যবস্থার অভ্যন্তরে শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতা কীভাবে তৈরি হচ্ছে? প্রশাসন-ব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা কেমন চলছে? এনজিও ও সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনগুলোর ভূমিকা কী? নানা বিদেশি শক্তি আছে। স্বাধীনতা কোথায়? রাজনৈতিক দলগুলো কি চিন্তার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চায়? মুক্তবুদ্ধিচর্চার নামে কী করা হচ্ছে? এসব নিয়ে সারা দেশের শিক্ষিত লোকদের মধ্যে বিচার-বিবেচনা দরকার। সর্বত্রই সংস্কার দরকার।
বাংলাদেশের গবেষণার ও লেখার জগতে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে ব্যবসায়িক প্রবণতা, বিনোদনমূলক প্রবণতা, চমকপ্রবণতা, উসকানিমূলক প্রবণতা। এসবের মধ্যে প্রগতিমূলক প্রবণতা দুর্গত। তবু যাঁরা অপরাজেয় মনোবল নিয়ে প্রগতির পথে চলতে চাইতেন, দীপনের শহীদ হওয়ার পর লেখা নিয়ে তাঁদের আত্মপ্রকাশ আরো বেশি দুরূহ হয়ে পড়েছে। গবেষণা সংস্থা, সংবাদপত্র, সাময়িকপত্র, পুস্তক প্রকাশ সর্বত্র সবাই অনেক বেশি সতর্কতা অবলম্বন করছেন। নিরাপত্তাবোধের অভাব তাঁদের পীড়ন করছে। খুব বেশি আত্মরক্ষামূলক নীতি অবলম্বন করেছেন তাঁরা। বই প্রকাশে এখন আর তাঁরা আগের মতো অসতর্ক নন। ধর্ম, ধর্মনিরপেক্ষতা, আস্তিকতা, নাস্তিকতা বিষয়ে খুব সতর্ক না হয়ে চলার কথা বাংলাবাজারের প্রকাশকরা কী করে ভাববেন। দীপন তাঁদের কাছে অপরিচিত ছিলেন না। দীপনের মতামত, ব্যক্তিত্ব ও জীবন যে সমাজে টিকতে পারল না, সে সমাজে প্রকাশকদের সুদৃঢ় আত্মরক্ষামূলক নীতি গ্রহণ ছাড়া আর উপায় কী? যে কাণ্ডকারখানা চলছে তাতে ‘বঙ্গবন্ধু’ ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ‘প্রথম বাংলাদেশ সরকার’ ‘তাজউদ্দীন’ প্রভৃতি বিষয় নিয়েও সত্যসন্ধ, বিশ্লেষণমূলক, বিচারমূলক চিন্তা ও মতপ্রকাশ আগের চেয়ে অনেক বেশি দুরূহ হয়ে পড়েছে। বিশিষ্ট কথাশিল্পী, বিশিষ্ট নাগরিক, আমাদের শিক্ষক অধ্যাপক শওকত ওসমান ১৯৯০-এর দশকে দৈনিক আজকের কাগজে ‘শেখের সম্বরা’ নামে ইসলাম বিষয়ে এক বিশেষ ধরনের লেখা লিখতেন। সেগুলো আবার তিনি ফটোকপি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাংলা একাডেমিতে, প্রেসক্লাবে পরিচিত-অপরিচিত অনেকের হাতে দিয়ে পড়তে এবং ফটোকপি করে প্রচার করতে বলতেন। একটা ‘মিশনারি জিল’ ছিল তাঁর। তখন ছিল তীব্র মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন ও নারীবাদী আন্দোলনের কাল। স্যারের ওই লেখাগুলোর কথা অনেকের মনে থাকার কথা। শওকত ওসমান স্যারের ওই চিন্তার অনুসরণে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তাঁর তরুণ অনুসারীরা অনেকে লিখে চলছেন। আমার মনে হয়, ইসলাম বিষয়ে চিন্তার এই ধারাটা সম্পূর্ণ ভুল। দেশে চিন্তার স্বাধীনতা যে আজ এতটা বিপর্যস্ত, তার জন্য এ ধারার চিন্তা ও কার্যক্রমও কম দায়ী নয়। আমাদের বুঝতে হবে যে, সভ্যতার বিকাশে ইসলামের কল্যাণকর ভূমিকা ছিল। ইসলামের যেমন অপব্যবহার আছে, গণতন্ত্রেরও তেমনি অপব্যবহার আছে।
চিন্তার ও মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তার অবসানের ও স্বাভাবিক অবস্থা প্রবর্তনের জন্য প্রগতিশীল লেখক ও প্রগতিশীল প্রকাশকদের সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করতে হবে। রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থাকে উন্নত করতে হবে। শুভ পরিবর্তনের কাজ করার ক্ষেত্রেও বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। ইলেকট্রনিক মিডিয়া গ্রহণ করতে হবে, কিন্তু বই বাদ দেওয়া যাবে না।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।