রিপোর্টারের ডায়েরি
বিদ্যুৎ চুক্তির বেসাতি
এক দারুণ অভিজ্ঞতা হলো আমাদের। এই তো সেদিন, যেদিন ত্রিপুরার বিদ্যুৎমন্ত্রী মানিক দে পাশে বসা বাংলাদেশের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে ইঙ্গিত করে পরিষ্কার বাংলায় সাংবাদিকদের বলছিলেন, ‘খেয়াল করেছেন উনি কিন্তু এরই মধ্যে একটা মারাত্মক কথা বলে ফেলেছেন...।’ পাঠক কী বলতে চেয়েছি তার আগে আরেকটু ভিন্ন কথা বলতে চাই।
গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ভারতের দ্বিপক্ষীয় বহু বৈঠকের দিন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মাসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভেতরে-বাইরে অপেক্ষার প্রহর গুনেছি। গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী পানি না পাওয়ার অভিযোগ, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির সম্ভাব্যতা, পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, স্পর্শকাতর পণ্যের তালিকার বেশকম, অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা, হঠাৎ টিপাইমুখ বাধ নির্মাণের তোড়জোড়সহ নানা বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ সেই সব বৈঠক শেষে আমরা ভারতের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর কথাটাই শুনতে চেয়েছি। সে সময় পররাষ্ট্র বিটে কাজ করা অনেকেই বলতেন, সব সময় প্রভাবশালী এই প্রতিবেশীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মানে ‘টেবিল টকে’ আমাদের পারফরমেন্স ভালো নয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এই বক্তব্যের প্রতিবাদ না করলেও মন খারাপ করতেন। কেউ কেউ বলতেন, ‘ভাই সাইড লাইনে অমন একটা দেশের পতাকা ঝুলতে থাকলে অনেকভাবেই কথা তোলা যায়।’ এ আলোচনায় এক সিনিয়র কূটনৈতিক রিপোর্টার বলছিলেন, ‘সেই অভিজ্ঞতার সময় ছিল ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জমানায়’। সে সময় দুই দেশের সম্পর্কটা কোনো দিনের জন্যই অভিনয়ের বাইরে কোনো আন্তরিকতায় মোড়ানো ছিল না। ছিল না দুই পক্ষেই। এসব কথার প্রায় সবই কিন্তু মিথ্যে নয়। তো এই ধরনের অভিজ্ঞতা নিয়েই অনেককাল চলছিল।
যেদিন ত্রিপুরার পোড় খাওয়া রাজনীতিক মানিক দে ওভাবে বলছিলেন, তখন বাংলার নসরুল হামিদের বিনম্র বুকটা বেশ চওড়া হয়ে গেছে। আমাদেরও হয়েছে। এ যে সাক্ষাৎ বিজয়।
নসরুল হামিদ সূচনা বক্তব্যে বলেছেন, ভারতের ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ ১০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ নিতে যাচ্ছে। তবে সব সময় যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই নেওয়া হবে এবং ততটুকু বিদ্যুতের দামই দেওয়া হবে। মানিককে এই কথাটিকেই অন্তত দুবার মারাত্মক বলেছেন। প্রতিবাদ করেননি। কিন্তু বলেছেন, ‘১০০ পর্যন্ত নেবেন, চাইলে ২০ মেগাওয়াটও নেবেন, তখন বাকি ৮০ মেগাওয়াট কি আমরা ফ্রিজে রেখে দেব। বিদ্যুৎ কি ধরে রাখা যায়। যায় না। আপনারা ২৪ ঘণ্টা কেন নিচ্ছেন না।’ মানিক দে বলে গেলেন, ‘হ্যাঁ বিদ্যুৎ আমাদের দিতে হবে। এখানে আসার আগে কেন্দ্রীয় ভারত সরকার বলেছেন এগিয়ে যেতে।’ প্রথমেই বলেছিলাম দারুণ অভিজ্ঞতার কথা। আশা করি পাঠক ধরতে পেরেছেন সেটা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এটা ছিল ওপারের অভিজ্ঞতার শেষ, এপারের শুরু।
যে দেশে দ্রুত গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে বলে এখনই হাহাকার, যে দেশে রেকর্ড ভেঙে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় তেল পুড়িয়ে, যে ছোট্ট বাংলাদেশে এখনো শতকরা ৩০ ভাগ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি সেই দেশে সাড়ে পাঁচ রুপির বিদ্যুৎ নিতে এ কেমন চুক্তি। কথাগুলো আমার নয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিমের। তিনি বলেন, ‘প্রথম কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে তাও আবার দুই দেশের মধ্যে এ রকম চুক্তি হতে পারে না। তেলভিত্তিক দু-তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে অবশ্যই সস্তার এই বিদ্যুৎ নেওয়া যায়। আর আমরা জানি, যেগুলোর মূল্য ১৪ থেকে ২২ টাকা পর্যন্ত ইউনিট।’ অধ্যাপক তামিম বলছেন, ‘পালাটানা থেকে যদি এই ১০০ মেগাওয়াট নিতেই এমন চুক্তি করতে হয় তাহলে ভারত থেকে আমরা কুষ্টিয়ায় ভেড়ামারা হয়ে অবিলম্বে আরো ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আনার সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছি?’
মন্ত্রণালয়ের এক কর্তাব্যক্তির কাছে প্রশ্ন করেছিলাম। তার উত্তর ওই বিদ্যুৎ শুধু কুমিল্লা অঞ্চলে আপাতত ব্যবহার করা হবে বিধায় এমন করে চুক্তির প্রয়োজন হয়েছে। গ্রিডলাইন সংস্কার করে বেশি বিদ্যুৎ আনা যাবে পরে। জানি না, এ কেমন কথা। এ কেমন চুক্তির বেসাতি।
সেদিন এটিএন নিউজের এক টকশোতে এসেছিলেন এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ারের সম্পাদক সাংবাদিক মোল্লা আমজাদ হোসেন। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এই বিদ্যুৎ নিতে সমস্যা কোথায়? মোল্লার উত্তর, অসুবিধা তো দূরের কথা, যদি আমরা ১০০ মেগাওয়াট কনফার্ম করতাম, তাহলে এর দাম সাড়ে থেকে কমে চার রুপিতে নেমে আসত।’
এখন প্রশ্ন, যাঁরা গুঞ্জন তুলেছেন, কুইক রেন্টালের বেসরকারি বন্ধু ব্যবসায়ীর লাভের খাতিরে পালাটানার কম খরচের বিদ্যুৎ যতদিন কম নেওয়া যায় তাই এমন চুক্তি, তাঁরা কতটুকু ভুল বলছেন?
লেখক : সাংবাদিক, এটিএন নিউজ।