বইমেলা
বইয়ের দাম কম না বেশি?
কৃতবিদ্য অনুবাদক গোলাম হোসেন হাবীব একবার প্রশ্ন ছুড়েছিলেন সামাজিক গণযোগাযোগের মাধ্যমে, দেশি বইয়ের দাম কম না বেশি? বলা বাহুল্য, উত্তরদাতা পাঠকরা দুই রকম মতামতই দিয়েছিলেন। একদল বলেছিল, ‘আড়াইশ টাকা দামের বার্গার খেতে পারো, মোবাইলে টাকা ভরতে পারো, বই কেনার বেলাতেই দামটা বেশি!’ আরেকদল, বলা বাহুল্য আমি নিজেই এই দলে, বইয়ের দাম দেখলে যে গা জ্বলে সেটা কখনো আড়াল করে না।
দুই মতের মাঝেই কিছু না-কিছু সত্য আছে। কিন্তু উভয় মতামতেরই একটা সীমাবদ্ধতাও আছে, উভয় মতই দাঁড়িয়ে আছে একটা ভূমির ওপর : প্রধান বাজার যখন কেবল সচ্ছল মধ্যবিত্ত-শিক্ষিত-রুচিবান অংশ। হয় তাদের স্বাচ্ছন্দ্য আছে মোটামুটি কিংবা বইয়ের নেশা এতই যে অন্য কিছুকে সে জন্য ছাঁটাই করতে দ্বিধা করেন না। শুধু যদি এদের হিসাবে ধরি, তাহলে বাংলাদেশের বইয়ের দাম কমই বলতে হবে। নেশাগ্রস্তকে বই কেনা থেকে বিরত রাখার মতো বইয়ের দাম নয় এ দেশে, সচ্ছল মধ্যবিত্তের স্বাচ্ছন্দ্যে থাবা বসানোর মতোও নয়। বইয়ের এত কম দাম হওয়ার পরও নেশাগ্রস্ত পাঠকের সংখ্যাটা মধ্যবিত্তের মধ্যেও অনেক কম, আর এটাই চিন্তার কারণ। অন্য মতটা মধ্যবিত্তের অসচ্ছল অংশের কিংবা হয়তো নেশাটা যাদের অতটা চড়া না। বইমেলায় অজস্রবার দেখেছি এমন সব পাঠককে, পছন্দ হওয়া বইটা নিয়ে কথা বলতে বলতে মনে মনে সংগতি হিসাব করে নেয়। এই বইটা কিনতে গেলে কোন বইটা বাদ দিতে হবে ভাবে। কিংবা খুব দামি কোনো বই কিনতে কোন বিলাস ছাঁটতে হবে, তা-ই ভাবে। মন স্থির করতে না পেরে চলে যায়, কেউ কেউ ফিরে এসে বইটাকে মোড়কে ভরে দিতে বলে। তার চোখে-মুখে তখন সিদ্ধান্ত নিতে পারার যে আনন্দ আর তহবিল নিয়ে যে দুশ্চিন্তাকে একই সঙ্গে খেলা করতে দেখা যায়, কবিরা বই বিক্রেতা হলে তা নিয়ে অনেক কবিতা লেখা হতো।
বরং আমরা প্রায়ই খেয়াল করি না যে এর বাইরের অধিকাংশ নাগরিক সম্ভাব্য ক্রেতার তালিকাতেই পড়েন না, অন্ন-বস্ত্রের চিন্তাতেই তাঁদের দিন কাটে, রাত ফুরোয়। ফলে বইয়ের বাজারটা গোড়াতেই খুব ছোট। জনসংখ্যা যতই হোক দেশে, বইয়ের বাজার এত সংকুচিত বলেই এত অল্প লোকের কাছ থেকে প্রকাশকের লাভ, উপকরণের দাম, লেখকের সম্মানী (যদি বা দেওয়া হয়), বানান সংশোধনের পাওনা, মুদ্রাকর-বাঁধাইকরের জীবিকা তুলে আনতে হয়। ফলে বইয়ের দাম তো উঁচুই হওয়ার কথা, কারণ কম সংখ্যক বই থেকেই এসব টাকা উঠিয়ে আনতে হবে।
প্রশ্নটাকে আবার বিবেচনা করা যাক। বইয়ের দাম কম না বেশি? সম্ভবত দুটোই সঠিক উত্তর।
একটা বইয়ের দামকে যদি আন্তর্জাতিক মুদ্রায় রূপান্তর করা হয়, দেখা যাবে বইয়ের দাম অত্যন্ত কম। অনুবাদ বা মৌলিক গবেষণার বইপত্রের কথা ভাবুন, ১০ ফর্মার অধিকাংশ বই সাড়ে তিনশ টাকার মধ্যে পাবেন। ফলে সচ্ছল মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত যাঁরা বই কেনেন না, সেটা রুচিগত কারণেই, তাঁরা তুলনামূলক কম দামেই বই কিনতে পারেন।
ওদিকে গড় নাগরিকদের আয়ের সঙ্গে তুলনা করে ভাবুন, বইয়ের দাম অত্যন্ত বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গড় দামের বই কিনতে একজন শ্রমিকের বড়জোর দেড়-দুই ঘণ্টার মজুরিই যথেষ্ট হবে। এদিক দিয়ে বিবেচনা করে দেখতে গেলে বাংলাদেশে একজন শ্রমিক মোটামুটি মানসম্পন্ন একটা বই কিনতে চাইলে তাঁকে গোটা একটা দিনের মজুরি ব্যয় করতে হবে।
কিন্তু পোশাকশ্রমিক তো বই পড়েন না, তাহলে? সস্তা, জনপ্রিয় উপন্যাসও কি তাঁর পড়ার কথা ছিল না? কিংবা তাঁরা পাঠকে পরিণত হলে নতুন ধরনের সাহিত্যের একটা ঘরানা এবং বাজারও কি তৈরি হওয়ার কথা ছিল না? একই কথা চলচ্চিত্র-সংগীত-সুকুমারবৃত্তির বাকি সব শাখার জন্যও প্রযোজ্য। সেই বাতি টিমটিম করে জ্বলছে-নিভছে।
বাংলাদেশের আরো বহু কিছুর মতো গেঁড়োটা এই আয়ের প্রশ্নে আটকে পড়ে আছে। অধিকাংশ পোশাকশ্রমিকের সঙ্গে কথা বললেই দেখবেন, তাঁদের বড় অংশই মাধ্যমিক স্তর পাড়ি দিয়েছে। তাঁরা বইপত্র পড়েন না, কেনেন না, এটা কি তাঁদের রুচির সমস্যা?
পাঠক হিসেবে আপনার ন্যূনতম কোনো স্পর্শকাতরতা থাকলে জানবেন, অবসরহীনতা দরিদ্র মানুষকে কতখানি বিনোদনহীন, ক্লান্তিকর ও একঘেয়ে জীবনে আটকে ফেলছে। কিন্তু এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সামর্থ্যের অভাবও। নিজের অবসর না থাকলেও সন্তানের জন্য বই তিনি কিনতে পারতেন, কেননা, তিনি খুব ভালো করেই জানেন বইয়ের সেই ক্ষমতার কথা : জ্ঞান তার সন্তানকে ক্ষমতাবান করতে পারত, তার শ্রেণি উত্তরণ ঘটাতে পারত। কিন্তু (অপ্রধানত) বই বাছাইয়ের জ্ঞান নিজের না থাকায়, এবং (প্রধানত) আর্থিক সামর্থ্যের ঘাটতি এত সস্তা বইয়ের দেশেও তাকে ক্রেতা হতে দিচ্ছে না। দরিদ্র এবং অল্পশিক্ষিত মানুষরা তাই খুব কম পরিমাণে হলেও বই কেনেন বটে, বাজারটা খুবই সীমিত বলে সেখানে কিছু চিরায়ত সাহিত্য এবং ধর্মীয় গ্রন্থের পুনর্মুদ্রণই প্রধানত ঘটে। এর বাইরে কিছু গল্প-উপন্যাস লেখার কাঁচা প্রয়াসও সেখানে আছে।
বাংলাদেশের গ্রন্থশিল্পের যদি কখনো মুক্তি মেলে, তাতে রক্ত সঞ্চালনের সম্ভাবনা যদি কখনো তৈরি হয়, তা এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে দাসপ্রায় মজুরি-দাসত্ব থেকে মুক্তির প্রশ্নের সঙ্গেই জড়িত।
২.
কিন্তু এ তো দূরলোকের কথা। আজকে বইয়ের দাম যতটা কম হওয়া সম্ভব ছিল, ততটা কম কি এ দেশে? সেটাও কিন্তু না। আবারো সমস্যাটাতে আসা যাক। প্রকাশক লোকসান দিয়ে বই বিক্রি করবেন না। কাজেই এতগুলো প্রাণীর (এর মাঝে লেখকের নিগ্রহের কথা নিত্যই আপনারা শুনতে পাবেন) ভরণপোষণের পরই বইয়ের দাম নির্ধারণ হবে। শুনেছি, সভ্য দুনিয়ায় বইয়ের দামের প্রধান ক্রেতা নানা ধরনের পাঠাগার, বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্থা ইত্যাদি। তারা শক্ত বাঁধাইয়ের সংস্করণটা কেনে। একজন প্রকাশক যদি কয়েক হাজার বই এমন সব প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করতে পারেন গড়ে ২০-২৫ ডলারে, সাধারণ পাঠকের কাছে চাইলে তিনি তুলনামূলক কম দামেও বই বেচতে পারবেন, লেখকও সম্মানজনক একটা পারিশ্রমিক পাবেন।
মোটকথা, প্রকাশনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রাণগুলোকে রক্ষার দায়িত্ব যদি সাধারণ পাঠকের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়, বইয়ের দাম বাজারের আর সব পণ্যের চেয়ে অনেক বেশি বোধ হবে। অন্যদিকে, যদি সেটার প্রাতিষ্ঠানিক ক্রয় বেশি হয়, তাহলে সাধারণ পাঠকের ঘাড়ে খরচটা চাপবে অনেক কম।
বাংলাদেশে ভালো পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না, তার সঙ্গে বইয়ের বাজারের এই সংকুচিত দশার একটা নির্ঘাত সম্পর্ক আছে। কেনার মতো বই প্রকাশিত হয় আসলে খুব কম। যে কটা হয়, তা-ও বড়জোর তিনশ থেকে পাঁচশ মুদ্রণ সংখ্যায়—যদি না তাতে বাজারে শিহরণ তোলার মতো কিছু থাকে। কাল্পনিক একটা বইয়ের দাম আটশ টাকা হলে, মুদ্রণ সংখ্যা পাঁচশ হলে এবং সৌভাগ্যবশত এক বছরে তা বিক্রি হয়ে গেলে ১০ ভাগ হিসেবে লেখক সম্মানী হবে মাত্র ৪০ হাজার টাকা। আটশ টাকা দাম হবে যে বইটির, তা অন্তত এক বছর বা তার বেশি সময়ের পরিশ্রমের ফসল হওয়ার কথা। এই সময়টুকু একজন গবেষণা বা অনুবাদ করার মতো যোগ্যতা আছে এমন একজন মানুষ অন্য যেকোনো কিছু—নানা সংস্থায় পরামর্শক, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, এনজিওতে অনুবাদ বা আর যেকোনো কিছু করলেও বহু গুণ বেশি নগদ সম্মান পাবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বহু পেশাদার কিন্তু অখ্যাত লেখক খণ্ডকালীন চাকরি করতে বাধ্য হন। কিন্তু এ দেশে দেখবেন প্রায় সর্বাংশে লেখককুল খণ্ডকালীন লেখক। ফলে নানা বিষয়ে পাণ্ডুলিপি তৈরি করার মতো যোগ্য লেখকের যে অভাব আছে তা না, বরং তুলনামূলকভাবে যোগ্য লোকেরা নিয়মিত লেখালেখিতে আসছেন খুবই কম।
এটাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার কথাটা তাঁরা দুঃস্বপ্নেও ভাববেন না। ফলে যেসব মানুষ এই বাজারে খেটেখুটে একটা পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন, তাঁদের প্রায় সবাই নেশাগ্রস্ত, কোনো না কোনোভাবে স্বাভাবিকতার ব্যত্যয়। বহু ক্ষেত্রে এমনও দেখা যাবে, একটা বা দুটো সফল পাণ্ডুলিপি তৈরি করেও লেখক জীবনের ইতি ঘটছে।
বাজার যেখানে এত ছোট, কামড়াকামড়ি, অসততা, দুর্নীতি, মোসাহেবি সেখানে টিকে থাকার অস্ত্র। বহু প্রকাশক আমলাদের বই ছাপেন উৎসাহ ভরে। ঠিকঠাকমতো সম্মানীও যেচেই লেখককে দিয়ে দেন। এ তো বিনিয়োগ মাত্র। উমেদাররা সেই গ্রন্থ সারি ধরে কেনেন এবং কর্তাদের বগলে করে ঘোরাঘুরি করেন। সরকারি ভাবাদর্শের প্রশংসা করে যদি দার্শনিক গ্রন্থ, সরকারি নীতির প্রশংসা করে অর্থশাস্ত্র কিংবা সরকারি ইতিহাসের প্রশংসা করে রাষ্ট্রনীতিমূলক গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন, সরকারি বিদ্যালয়-উচ্চবিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই, ব্যাংক-বিমাওয়ালারা পর্যন্ত সেই বই হাজার হাজার সংখ্যায় কিনে নেবে।
জাতীয় গ্রন্থ সংস্থার সাবেক পরিচালক অসীম সাহার আলোচনায় শুনলাম, গ্রন্থ সংস্থার জন্য সরকারি ব্যয় বরাদ্দ নাকি মাত্র এক কোটি ১২ লাখ টাকা! সেটা নিয়েও ঔপন্যাসিক ও সম্পাদক রাখাল রাহা জানিয়েছেন, গ্রন্থকেন্দ্রের আওতাভুক্ত ৮৩৫টি পাঠাগারের অধিকাংশই বেনামি এবং ভুয়া। সরকারি এই বরাদ্দ লুণ্ঠনই এসব পাঠাগারের জন্মের মূল কারণ। নিজের পরিচালিত একটি পাঠাগারের জন্য গ্রন্থকেন্দ্রের বরাদ্দ পাওয়া বই সংগ্রহ করতে গিয়ে রাখাল রাহা একদা যে করুণ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন, সেটা এ দেশের সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক গ্রন্থ ক্রয়ের প্রধানতম অংশ। সেবার গ্রন্থকেন্দ্রের কেনা বইয়ের তালিকায় কোনো ভালো বই ছিল না, ছিল না ভালো প্রকাশকের বই, ছিল না এমনকি কোনো প্রতিষ্ঠিত লেখকের বই। মানদণ্ড আরো একধাপ নামিয়ে তিনি খুঁজলেন অন্তত ছোটদের রূপকথা, মজার গল্প ইত্যাদি ধরনের বইপত্র পাওয়া যায় কি না। তা-ও ছিল না। যে অল্প কিছু পাঠাগার টিকে আছে সত্যিকারের উৎসাহীদের শ্রমে-ঘামে, অজানা লেখক এবং অচেনা প্রকাশকের কাছ থেকে কেনা অপ্রয়োজনীয় বইগুলো বান্ডিল ধরে সেসব পাঠাগারের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। সেই আবর্জনা ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ির পাঠাগার পর্যন্ত তিনি আর কষ্ট করে নিয়ে যাননি। জনগণের করের অর্থের এই বিপুল অপচয় নিয়ে তিনি সোচ্চার, আমরা কতদূর?
পাঠাগারগুলোর দশা নিয়ে আরেকটু বলি। অধিকাংশ সরকারি পাঠাগার ঘুরলে আপনি জানতেই পারবেন না, হালে কী ধরনের বই প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রকাশনার যতই বেহাল অবস্থা থাকুক না কেন, পাঠাগার আপনাকে যে ধারণা দেবে, তার চেয়ে বাস্তবতা খানিকটা বেশি আশাদায়ী। শাহবাগে অবস্থিত কেন্দ্রীয় পাঠাগারটিও হালে চাকরিপ্রার্থীদের দখলে চলে গেছে, পাঠকের ঠাঁই নেই। কিন্তু ঠাঁই হলেও খুব লাভ হতো না, আপনি টের পেতেন না যে গত এক বছরে বাংলাদেশে জগদীশন্দ্র বসুকে নিয়ে এত দারুণ একটা সংকলন বেরিয়েছে মুন্সীগঞ্জ থেকে। প্রকাশিত সব বই জাতীয় মহাফেজখানায় থাকে, সত্যি। কিন্তু সাধারণ পাঠকের জন্য যে সাধারণ পাঠাগার, সেখানে প্রকাশিত মানসম্পন্ন গ্রন্থেরও ভগ্নাংশের ঠাঁই হয় না।
৩.
সমাধান কী হতে পারে? পৃথিবীর কোনো সমস্যারই কোনো আদর্শ সমাধান নেই, কিন্তু আমরা যে পরিস্থিতিতে আছি, সেটার ধরন অত্যন্ত স্থূল। প্রথমত, এখানে বই কেনায় সরকারি বরাদ্দ বৃদ্ধি করা দরকার। যে দেশে অর্থমন্ত্রী কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যাংক লোপাটের ঘটনাকেও সামান্য অর্থ বলতে পারেন, সে দেশে বই কেনার জন্য এই বরাদ্দ ন্যক্কারজনক।
কিন্তু এই বর্ধিত ব্যয়ও যদি এখনকার মতো ন্যক্কারজনক পদ্ধতিতে লোপাট হয়ে যায়? সেটা পুরোপুরি থামানোর উপায় সম্ভবত নেই। কিন্তু সেটাকে সীমিত করার উপায় আছে। সে জন্য প্রয়োজন একটা গ্রহণযোগ্য পর্ষদ, যারা বছরজুড়ে প্রকাশিত বইগুলো থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি সংস্থা প্রভৃতির জন্য বই বাছাই করে দেবে। এই বইগুলো কেনা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক হবে।
এমন একটা পর্ষদ গঠন অসম্ভব নয়। পক্ষপাত ইত্যাদি ত্রুটি থেকে দুনিয়ার কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানই মুক্ত নয়। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো থেকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে এমন একটা পরিষদ বানানো গেলে, সদস্যদের পছন্দ গোপন থাকলে দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের পক্ষে এত মানুষকে বশে আনা কঠিন হবে। এর সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের নির্দিষ্ট অনুপাতে নেওয়া যেতে পারে, আমলা প্রতিনিধি একদম না থাকাই মঙ্গল। তেমন একটা স্বাধীন পর্ষদ লেখক-প্রকাশক-পাঠক সবার জন্যই মঙ্গলের হবে।
আমাদের বইয়ের সংস্কৃতিতে তিনটে ধারা প্রবলভাবে বিরাজ করছে। মাঝখানে যাঁদের বাস, তাঁদের কথাই এতক্ষণ হলো। কিন্তু বাকি দুটি ধারাকেও অস্তিত্বহীন ভাববেন না। তাঁদের কথা সংক্ষেপে বলে নিই এই তিনটি আলোকচিত্রে, টাঙ্গাইলের ছবিটি তুলেছেন বন্ধু সাদিক রেজা।
সড়কবাতিতে বই বিক্রেতা, অধিকাংশ বই তাঁর ইংরেজি ভাষায়। গুলশান-বনানী কিংবা ধানমণ্ডির বেশ কিছু বইয়ের দোকানে গেলেও একই চিত্র পাবেন। ঢাকার উচ্চশিক্ষিত এবং উচ্চআয়ের মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশের বাড়িতে পড়া কিংবা ঘর-সাজানো উভয় প্রয়োজনেই বাংলা বইয়ের কাটতি তেমন নেই। শিক্ষাব্যবস্থার বৈষম্য এবং ইংরেজিকে কেন্দ্র করে ফুটানির সংস্কৃতি বাংলা বইয়ের বাজারকে বেশ খানিকটা সংকুচিত করেছে, কেননা তুলনামূলকভাবে এদেরই অধিক অর্থ ব্যয়ের সামর্থ্য আছে।
যাত্রাবিরতিতে বইয়ের দোকান, সিরাজগঞ্জ : পেছনের দুই সারি গ্রন্থই অজস্রহারে পুনর্মুদ্রিত। ডান দিকের সারিটি ধর্মীয় গ্রন্থ। বাঁ দিকেও অল্প কটি ধর্মীয় গ্রন্থ, বাকিগুলো চিরায়ত কিংবা হালের কেজো ধরনের বইপত্র। চিরায়ত বইগুলোর মাঝে আছে সবার ওপরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র, শার্লক হোমস, ডেল কার্নেগি, বাণী চিরন্তনী, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় (ইনি এখনো তালিকায় টিকে আছেন এইখানে, অথচ মূলধারায় হারিয়ে গেছেন কবে!) ম্যাক্সিম গোর্কি, বিষাদ সিন্ধু ইত্যাদি। এখানে উপস্থিতি সুনিশ্চিত নিয়মিত বিক্রি হওয়ার সাক্ষ্য দেয়। সামনে টেবিলে ছড়ানো-ছিটানো বইগুলোও সস্তায় ভালো পরিমাণে বিক্রি হয়, শিরোনাম থেকেই সেগুলোর বিষয়বস্তুও মোটামুটি বোঝা যায়।
সন্তোষ, টাঙ্গাইলে ভাসানী মেলায় বইয়ের দোকান: যাত্রাবিরতির বইগুলোর সাথে মিল আছে বইয়ের সংগ্রহে। দাম ও ধরন উভয় দিক দিয়েই। পার্থক্য কেবল ‘সমকালীন’ উপন্যাসের সংগ্রহে, যদিও উচ্চশিক্ষিত পাঠককূল এই লেখকদের সাথে আদৌ পরিচিত নন। যাত্রা বিরতির নিয়মিত দোকানে এমন উপন্যাসের ঠাঁই না হওয়া থেকে বোঝা যায় এগুলোর কাটতি তত ভাল না। বেশ কটি উপন্যাসে দেয়া তথ্য থেকে জানা গেলো বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, অধ্যক্ষ কিংবা সরকারী কর্মকর্তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রন্থকারগণ এগুলো প্রকাশে সমর্থ হয়েছেন।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন। কেন্দ্রীয় সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন।