জাগো বাহে
উন্নয়নবৈষম্যের শিকার রংপুর
পাকিস্তান শাসনামলে বর্তমান বাংলাদেশ ছিল শোষিত-নিপীড়িত-বঞ্চিত। সেই সময়ের শোষণ কোথায় বেশি হয়েছিল আর কোথায় কম হয়েছিল সেটা আলাদা করে মূল্যায়নের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই রংপুর যখন বরাবরের মতো প্রতিবছরই চরম অবহেলা আর উপেক্ষার শিকার হয়, তখন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে- রংপুরের প্রতি সরকারের এত ঔদাসীন্যের কারণ কী? দেশে উন্নয়নবৈষমস্য দূরীকরণে কোনো দলীয় সরকারই আন্তরিকতা প্রদর্শন করেনি। এ পর্যন্ত যত দলই সরকার গঠন করেছে, সবাই এ বৈষম্য করে গেছে। এই ধারাবাহিকতায় বিএনপি-জাতীয় পার্টি-আওয়ামী লীগ-চারদলীয় জোট-মহাজোট কেউই বাদ নেই।
এ পর্যন্ত যতগুলো বাজেট উপস্থাপিত হয়েছে, তার প্রতিবারই রংপুর অঞ্চলের জন্য বরাদ্দ ছিল কম। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা। যখন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দেশ চালিয়েছেন, তখন রংপুর অঞ্চলের জন্য বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখেননি। কিছু কিছু সড়ক উন্নয়নের কাজ করেছেন। এখন দেশের অনেক এলাকার চেয়ে রংপুরের সড়কের অবস্থা করুণ। রংপুর শহরে সেই সময়ে নিয়ন আলোর ব্যবস্থা করেছিলেন। গ্রামের অভাবী লোক শহরে আসত কাজের সন্ধানে। নিয়ন আলোয় তাদের গায়ের রং বদলে যেত। একজনের কাছে অন্যজনকে হঠাৎ অচেনা মনে হতো। কিন্তু পেটের ক্ষুধা আর পরিবারের না খেয়ে থাকার যন্ত্রণাটা তাতে বদলাত না বিন্দুমাত্র।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন নয় বছর ক্ষমতায় থাকার পর। এরপর বিএনপি ক্ষমতায় আসে। যখনে দেশ বিএনপি চালিয়েছে তখন রংপুর অঞ্চলের সংসদ সদস্যরা ছিলেন জাতীয় পার্টির। বিএনপি সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর রংপুর অঞ্চলের উন্নয়ন করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেননি। সংসদ সদস্যরাও জাতীয় পার্টির হেতু উন্নয়ন প্রকল্প রংপুর অঞ্চলের জন্য আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। জাতীয় পার্টির অধিকাংশ সাংসদ আবার নিজ নিজ ব্যবসায়-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন সব সময়। তারা নিজেরা দামি গাড়ি আর দামি বাড়ির মালিক। সাধারণ মানুষদের নিয়ে ভাবার মতো অবসরও তাদের ছিল না। ফলে ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত রংপুর থাকে উন্নয়নবঞ্চিত। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগ থাকলেও রংপুরের মানুষ আঁকড়ে ধরে থাকে জাতীয় পার্টিকেই। জাতীয় পার্টির ক্ষমতা আরো কমতে থাকে। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত রংপুরে সামান্য উন্নয়ন হলেও তা দেশের সার্বিক উন্নয়নের চেয়ে অনেক কম। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসীন হয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। রংপুর অঞ্চল ছিল ক্ষমতার বাইরে। রংপুরের বঞ্চনার কাল আরো দীর্ঘ হতে থাকে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। মহাজোট সরকার ক্ষসতায় আসার পর রংপুর অঞ্চলের জন্য কিছু কিছু উন্নয়নের পথ খুলেছে। তারপরও সেই উন্নয়ন দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের তুলনায় কম।
২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার রংপুরে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার সদিচ্ছা থেকে একটি প্রকল্পও গ্রহণ করেছিল। এমনকি প্রকল্প পরিচালকও নিয়োগ হয়েছিল। ক্ষমতার পলাবদল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই খালেদা জিয়া সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়ে যান নোয়াখালীতে। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০১ সালে তিস্তা রেল সেতুর পাশে একটি সড়ক সেতুর কাজ শুরু করেছিল। বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার পর সেই সেতুর কাজ আর খুব বেশি এগোয়নি। ২০০৮ সালে ক্ষতায় আসার পর সেই কাজে গতি আসে। এখন সেই সেতুর সুবিধা ভোগ করছে দেশের সাধারণ মানুষ। বর্তমান মহাজোট সরকার যখন প্রথমবার ক্ষমতায় আসে তখনি রংপুরকে বিভাগ ঘোষণা করে। তার অল্প দিন পরই রংপুরকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করে। এখন আবার রংপুর উন্নীত হয়েছে মেট্রোপলিটন সিটিতে। কুড়িগ্রামের ধরলা সেতুর কাজও আওয়ামী লীগ সরকারের করা। দ্বিতীয় ধরলা সেতু, দ্বিতীয় তিস্তা সেতুর কাজ চলছে। এগুলোও আওয়ামী লীগ সরকারেরই উদ্যোগে হচ্ছে।
রাজনৈতিক প্রতিকূলতা দিনের পর দিন রংপুরকে করে রেখেছে পশ্চাৎপদ। রংপুরের এই পিছিয়ে থাকা অবস্থা থেকে উন্নয়ন সমতায় ফেরাতে কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি। এ অঞ্চলে এমন কোনো রাজনীতিকও নেই যিনি রংপুরের সংকটগুলো সরকারের উচ্চপর্যায়ে তুলে ধরতে পারেন। যে মন্ত্রীরা রংপুর অঞ্চলের তাঁরা খুব বেশি প্রভাবক নন।
অরাজনৈতিক কিছু বেসরকরি সংস্থা, সামাজিক সংগঠন রয়েছে যাদের পক্ষ থেকে উন্নয়নবৈষম্য দূরীকরণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সেই ক্ষীণ চেষ্টা বৈষম্য দূরীকরণে বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয় না। বছর দুয়েক আগে ঢাকাস্থ রংপুর বিভাগ উন্নয়ন সমিতি একটি সেমিনারের আয়োজন করেছিল। সেখানে রংপুর অঞ্চলের অনেক সাংসদ-মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা অনেকেই অনেক রকম আশ্বাসও দিয়েছিলেন উন্নয়নের লক্ষ্যে। সম্ভবত দিন শেষে তারা ভুলেই গেছেন। আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবেও রংপুর অঞ্চলের অনেক সাংসদ-মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে রংপুরের উন্নয়ন নিয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠক হওয়ার কথা আছে। এ রকম কিছু কিছু কর্মসূচি বিভিন্ন সময়ে গ্রহণ করা হয়ে আসছে। কিন্তু কার্যত কোনো ফল পাওয়া যায় না।
২০১১ সালে রংপুর জেলা স্কুল মাঠে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি বক্তব্যে বলেছেন-রংপুরের উন্নয়নের দায়িত্ব তাঁর নিজের। রংপুরের উন্নয়নের যে করুণ অবস্থা, তাতে করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ হস্তক্ষেপ ছাড়া এ সমাধান অসম্ভব। রংপুর অঞ্চলের এমন কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নেই যাঁরা রংপুরে উন্নয়ন সমতা বিধান করতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেন। এখন হয় শেখ হাসিনা, নয়তো সজীব ওয়াজেদ জয় এ দুজনের যে কোনো একজনকে দায়িত্ব গ্রহণ করতেই হবে।
দেশের উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জরুরি। রংপুর যে উন্নয়নবৈষম্যের শিকার এর মূল কারণ রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। আবার উন্নয়ন সমতার জন্যও রাজনীতির আশ্রয় নিতে হবে। বলা যায়, রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান রাজনৈতিকভাবেই হতে হবে। সে জন্য শেখ হাসিনা অথবা সজীব ওয়াজেদ জয়ই পারেন সমস্যা সমাধানে কার্জকর ভূমিকা নিতে। অবহেলিত-উপেক্ষিত জনগোষ্ঠী সেদিকেই তাকিয়ে আছে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।