শ্বেতাঙ্গরা ‘প্রবাসী’ হলে অশ্বেতাঙ্গরা ‘বহিরাগত’ কেন?
(বর্তমান রচনাটি দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত মাউনা রেমার্ক কুটোনিনের লেখা ‘হোয়াই আর হোয়াইট পিপল এক্সপ্যাটস হোয়েন দ্য রেস্ট অব আস আর ইমিগ্রেন্টস’ নিবন্ধের ভাবানুবাদ। সিলিকন আফ্রিকা পত্রিকার সম্পাদক কুটোনিন আফ্রিকা রেনেসাঁ আন্দোলনেরও সক্রিয় কর্মী।)
অভিবাসনের খেরোখাতায় এখনো কিছু নাকউঁচু শব্দ বলবৎ রয়েছে। এই শব্দগুলো আপাত নিরীহ আর শুনতে শুনতে অভ্যাস হয়ে গেছে বলে আমরা তেমন আমলে নেই না। কিন্তু এর পেছনে উদ্দেশ্য রয়েছে অবশ্যই- তা হলো সাদা চামড়ার মানুষ বা শ্বেতাঙ্গরা আর সবার থেকে উঁচু জায়গায় অবস্থান করে। সেসব উদ্দেশ্য প্রণোদিত শব্দের মধ্যে একটি হলো ‘প্রবাসী’।
চমকে গেলেন নাকি? দিনরাত যে শব্দ উচ্চারণ করছি সেটার পেছনে আবার বিশেষ কি উদ্দেশ্য? ‘প্রবাসী’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ কী তবে? কাকে বলব প্রবাসী? উইকিপিডিয়া টীকা দিচ্ছে- ‘প্রবাসী হলো এমন একজন যিনি নিজের জন্মস্থানের বাইরে ভিন্ন দেশে বসবাস করেন, সাময়িক বা স্থায়ীভাবে।’ অভিবাসনতত্ত্বে প্রবাসীর ইংরেজি ‘এক্সপ্যাট’। লাতিন টার্ম ‘এক্স’ এবং ‘পাত্রিয়া’ ( দেশ, পিতৃভূমি) থেকে আগত শব্দ ‘এক্সপ্যাট’।
সে হিসেবে যদি আপনি হিসেব কষেন, তাহলে ‘এক্সপ্যাট’ কাকে বলবেন? কোনো ব্যক্তি যদি জীবিকার উদ্দেশ্যে নিজ দেশের সীমানা পেরিয়ে অন্য দেশে পাড়ি জমান; নিশ্চয়ই তাকে ‘এক্সপ্যাট’ বা ‘প্রবাসী’র তালিকায় গণ্য করা জায়েজ! কিন্তু আফসোস, এই সূত্র সবার ক্ষেত্রে খাটবে না। বাস্তবতা হলো ‘এক্সপ্যাট’ খেতাবটি আলাদা করে সাদা চামড়ার পশ্চিমাদের জন্য তুলে রাখা হয়েছে। সুতরাং ছেলেবেলায় করা গণিতের মতো বলতে হবে, যদি এবং কেবল যদি কোনো সাদা চামড়াওয়ালা পশ্চিমা ব্যক্তি কাজ কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি জমান- তাকে ‘প্রবাসী’ বলা যাবে। তাহলে অন্যদের কী বলবেন? সে শব্দটাও তো জানি আমরা- ‘ইমিগ্র্যান্ট’ বা ‘অভিবাসী’! অভিবাসীর আরেক প্রতিশব্দ বহিরাগত।
আফ্রিকানরা অভিবাসী। অ্যারাবিয়ানরা অভিবাসী। এশীয়রাও অভিবাসী বটে! তবে ইউরোপীয়রা কখনোই অভিবাসী নয়, তারা প্রবাসী- কারণ অন্য কোনো জাতিগোষ্ঠী তাদের কাতারে খাপ খায় না, তাই! তারা শ্রেষ্ঠ তথা শ্রেষ্ঠতম। নিচু জাতের লোকজনদের, অর্থাৎ পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গ ছাড়া অন্য সবার জন্য ‘অভিবাসী’ উপাধিটাই বরাদ্দ।
বর্ণ আর জাতিভেদে এই ‘প্রবাসী বনাম অভিবাসী’ বিতর্কটি তুলেছে খোদ পশ্চিমা গণমাধ্যম। অর্থনৈতিক তথ্য বাতলানোর সবচেয়ে হোমরাচোমরা পশ্চিমা পত্রিকা ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ ক’দিন আগেই ‘এক্সপ্যাট’দের জীবনযাপন নিয়ে বড়সড় এক ব্লগ ছাপিয়েছে। লেখার শিরোনাম ‘হু ইজ অ্যান এক্সপ্যাট, এনিওয়ে’? যার বাংলা করলে দাঁড়ায়- ‘সে যাহোক, প্রবাসী তবে কে?’ ওই লেখার মূল যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে- “নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি জমানো লোকদের মধ্যে কতিপয়কে বলা হয় প্রবাসী, বাকিরা ‘অভিবাসী’ কিংবা নেহায়েত ‘বহিরাগত’। এগুলো আসলে নির্ভর করে সামাজিক শ্রেণি, জন্মভূমি আর অর্থনৈতিক অবস্থানের ওপর। শুনতে অবাক লাগে যখন হংকংয়ে কিছু মানুষকে প্রবাসী বলা হলেও অন্যদের তা বলা হয় না! জন্মস্থান তথা শেকড়টা পশ্চিমা হলেই কেবল ‘প্রবাসী’ খেতাব মিলবে আপনার, অন্যথায় আপনি ‘অভিবাসী’, ‘দেশত্যাগী’, ‘বহিরাগত’- কিংবা আপনার কপাল ফিলিপিনো শ্রমিকদের মতো হলে কেবলই ‘অতিথি’। তারা বছরের পর বছর বসবাস করুক কি খেটে যাক, কিছুই যায় আসে না- ‘গেস্ট’ তো ‘গেস্ট’ই! বিশেষ ক্ষেত্রে মান্দারিনভাষী কিছু মূল ভূখণ্ডের চীনাদের ‘প্রবাসী’ বলা হয় অবশ্য! পুরো বিষয়টা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দ্বিচারী নীতি ছাড়া আর কি!”
একই বাস্তবতা আফ্রিকা আর ইউরোপে। আফ্রিকার শীর্ষমানের পেশাদাররা কাজের জন্য ইউরোপে যান, তবে ‘প্রবাসী’ খেতাব জোটে না তাদেরও। তারা নেহাতই ‘অভিবাসী’। এমনই এক আফ্রিকান বলেছেন, “সরকারি আর বেসরকারি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করি আমি। তবে যেহেতু আমি কৃষ্ণাঙ্গ, কাজেই ‘প্রবাসী’ শব্দটি আমার জন্য প্রযোজ্য নয়! ওরা আমকে বলে, আমি নাকি উচ্চ ডিগ্রিধারী ‘ইমিগ্র্যান্ট’!
তবে বহু শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তিই কিন্তু বর্ণপ্রথার সুবাদে পাওয়া সুবিধে ভোগ করার বিষয়টি অস্বীকার করেন। আর করবেনই বা না কেন? কেবল জন্মগত চামড়ার গুণে তাদের এই সুযোগসুবিধা আর বিশেষত্ব আরোপের ভাবাদর্শ আসলেই বন্ধ করা উচিত। সুতরাং অন্যদের মতো এখন থেকে সাদা চামড়ার লোকজনকে আফ্রিকা বা অন্য দেশে ‘প্রবাসী’ না বলে ‘অভিবাসী’ হিসেবেই গণ্য করা উচিত। এতে তাদের শ্বেত-অহম আঘাত পেলে তারা আকাশচারী হতে পারে! এই প্রাচীনপন্থী দৃষ্টিকোণ এখন বদলানোর সময় এসেছে।