বিধানসভা নির্বাচন
পশ্চিমবঙ্গে নতুন সমীকরণ
বিশ্বের বৃহত্তম বলে চিহ্নিত ভারতীয় গণতন্ত্রের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক পর্যায়ের নিয়মিত নির্বাচন। গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শাণিত হয়ে ওঠে। সুদীর্ঘ ১৯৪৭-২০১৬ পর্যন্ত প্রায় ৭০ বছর ধরে ভারতীয় গণতন্ত্র এগিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় সংবিধানের সার্থকতা এই যে, তারা বৈচিত্র্যের মাধ্যমে ঐক্য সাধনে সক্ষম হয়েছে। অনেক ভাষা, ধর্ম, বর্ণ এবং নৃগোষ্ঠীতে বিভক্ত ভারতীয় জনগোষ্ঠী গণতন্ত্রের ভুলত্রুটির মধ্য দিয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারছে। তাই জনগণের ক্রোধ, ক্ষোভ ও দুঃখকষ্ট নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। আর এতেই প্রশমিত হয় মনোকষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার হলেও কেন্দ্রীয় সরকার বেশ শক্তিশালী। কেন্দ্রীয় সরকারের আইন সভার নাম পার্লামেন্ট। এটি দুই অংশে বিভক্ত- উচ্চ পরিষদ ও নিম্ন পরিষদ। উচ্চ পরিষদের নাম ‘রাজ্য সভা’(Council of States) আর নিম্ন পরিষদের নাম ‘লোক সভা’(House of People) আর প্রাদেশিক পরিষদের নাম ‘বিধান সভা’ (Legislative Assembly)।
নির্বাচন ২০১৬ : পাঁচ বছর অন্তর কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। পশ্চিম বাংলায় সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১১ সালে। পাঁচ বছর পর এ বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা।
সামাজিক অস্থিরতা দুষ্ট ভারতে এসব নির্বাচন একসঙ্গে অনুষ্ঠান না করে বরং ধাপে ধাপে অনুষ্ঠিত হয়। সে অনুযায়ী ছয় ধাপে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচন শুরু হয়ে গেছে। এপ্রিল ৪ এবং ১১ নির্ধারিত রয়েছে, পুরোনো নকশাল বাড়ি আক্রান্ত অঞ্চলগুলোতে। অপরদিকে এপ্রিল ১৭, ২১, ২৫, ৩০ ও মে ৫ নির্ধারিত রয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলের নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। অনেক বছর পরে এ নির্বাচনী এলাকা পুনর্গঠিত হচ্ছে। ছিটমহলগুলো থেকে বেশ কিছু সংখ্যক লোকজন ভোটারভুক্তি হওয়ার কারণে এ পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আরো একটি বিষয় বর্তমান নির্বাচনে পরিদৃষ্ট হয়েছে আর তা হলো- জনসংখ্যা বা ভোটার সংখ্যায় পশ্চিম বাংলার প্রাধান্য। এবার পশ্চিম বাংলার ভোটার সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৬.৫৫ কোটি। এর মধ্যে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ৩.৩৯ কোটি এবং নারী ভোটারদের সংখ্যা ৩.১৬ কোটি। ভোটারের সংখ্যার দিক দিয়ে তামিলনাডুকে অতিক্রম করেছে পশ্চিম বাংলা।
ভোটারের ধর্মীয় বিভাজন : পশ্চিম বাংলায় হিন্দু ভোটারের সংখ্যা ৭০.৫৪ ভাগ। আর মুসলিম ভোটারের সংখ্যা ২৭.০১ ভাগ। মুসলমানদের এই সংখ্যা সব সময়ই পশ্চিম বাংলার রাজনীতিতে নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। অন্যান্য ধর্মীয় জনসংখ্যা নেহাত সামান্য। এখানে রয়েছে শিখ, খ্রিস্টান এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনগণ। উল্লেখ্য যে, পশ্চিম বাংলার কিছু কিছু অঞ্চল যেমন মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর ইত্যাদি অঞ্চলে মুসলমানদের প্রাধান্য রয়েছে। অপরদিকে উত্তরবঙ্গ অর্থাৎ হিমালয়সংলগ্ন দার্জিলিং অঞ্চলে বৌদ্ধদের প্রাধান্য রয়েছে।
তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতি : পশ্চিম বাংলার রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিচরণ অনেক কাল ধরে। তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম বাংলায় প্রাধান্যের জন্য লড়ছেন অনেক আগে থেকে। ২০১১ সালের নির্বাচনে তার কপাল খোলে। বিধান সভা নির্বাচনে তিনি ১৮৪ আসন পান। এই প্রথমবারের মতো ৩৫ বছর পর বাম রাজত্বের অবসান ঘটে পশ্চিম বাংলায়। ভারতের রাজনীতিতে সব সময় সুবিধাজনক অবস্থা নেওয়ার জন্য তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী নিন্দিত। তিনি সময় ও সুযোগ বুঝে চলেন। এবার আসন্ন নির্বাচনে তিনি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। চ্যালেঞ্জের বড় কারণ জোটের রাজনীতি।
বাম-কংগ্রেস জোট : রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কোনো কথা নেই- এটা এবারও প্রমাণিত হলো যে পশ্চিম বাংলার বিধান সভার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘকাল ধরে ভারতের রাজনীতিতে বিশেষত পশ্চিম বাংলায় বাম-কংগ্রেস বৈরিতা একটি শতসিদ্ধ ঘটনা। বামদের প্রাধান্যের কারণেই কংগ্রেসকে পশ্চিম বাংলার রাজনীতি থেকে বিরত থাকতে হয়েছে। এখন মমতা হটাও ইস্যুকে কেন্দ্র করে দুই দল এক হয়েছে। মমতাও এই জোটকে প্রবল আক্রমণ করছে। তিনি বলছেন, ওই জোট হচ্ছে- স্বার্থসুবিধের অনৈতিক জোট। মমতা প্রকৃত পক্ষে বাম-কংগ্রেস জোটের কাছে পরাজিত হতে পারেন। মমতার বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে। দলীয়করণ বেড়েছে। নারীর ইজ্জত লুণ্ঠনের ঘটনা অনেক ঘটেছে। অপরাধীরা মমতার আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বেড়েছে হু হু করে।
সিঙ্গুরে টাটার অধিকৃত জমি কৃষকদের ফিরিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। আবার এটাও ঠিক যে, গত পাঁচ বছরে রাজ্যের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। মানুষের জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেক ভাল। মমতা পশ্চিম বাংলার জনগণকে তুষ্ট করার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সম্পাদনে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিলেন। বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনার প্রতি তার এ বিরূপ মনোভাব বাংলাদেশে তাকে অর্জনপ্রিয় করেছে। অপরদিকে মুসলমানদের মসজিদ-মাদ্রাসা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সহায়তার মনোভাব তার জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে।
বামফ্রন্টের অবস্থান : জোতি বসুর নেতৃত্বে পশ্চিম বাংলায় বাম ঘরানার রাজনীতিতে রীতিমতো অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। গণতান্ত্রিক পন্থায় যে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতাশীন হতে পারে এবং জনগণের জন্য প্রকৃতপক্ষে ভালো কিছু করতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বামফ্রন্টের দীর্ঘ মেয়াদি শাসন। কংগ্রেসের সন্ত্রাস এবং পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার বিপরীতে বামফ্রন্ট পশ্চিম বাংলায় গণমুখী শাসনব্যবস্থা চালু করতে সক্ষম হয়। সবচেয়ে যে সংস্কারটি দ্বারা সাধারণ নিপীড়িত কৃষককূল উপকৃত হয় তা হলো- ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ নীতির বাস্তব প্রয়োগ। এই অভূতপূর্ব সংস্কারের ফলে সাধারণ কৃষক সমাজ এবং অন্যান্য দরিদ্র শ্রেণির মানুষ বামফ্রন্টকে অব্যাহত সমর্থন দেয়। ওই সময়কালে পশ্চিম বাংলায় তেমন কোনো সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু অনেক দিন ক্ষমতায় থাকলে যা হয়- অন্যায়, অনিয়ম এবং এক ধরনের দলীয় নিয়ন্ত্রণে জনগণ বিকল্পের সন্ধান করে। সেখানে বৈপ্লবিক বক্তব্য নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিম বাংলার রাজনীতিতে তীব্রভাবে সজাগ থাকেন। তারই প্রতিফলে বিগত নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেন।
কংগ্রেসের অবস্থা : সর্বভারতীয় পর্যায় ১৯৪৭ সাল থেকে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস কেন্দ্র এবং প্রাদেশিক পর্যায়ে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করে আসছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজ্যে সাময়িক পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। ১৯৭১ পরবর্তীকালে পশ্চিম বঙ্গের রাজনীতিতে বামফ্রন্টের অভ্যুদয় ঘটে। সব ধরনের বাম ধারার রাজনৈতিক দল এই বামফ্রন্টে শামিল হয়। সম্মিলিত বাম ফ্রন্টের কাছে কংগ্রেসের ভরাডুবি ঘটে। সেই থেকে এ পর্যন্ত কংগ্রেস কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত হতে পারলেও পশ্চিম বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেনি। তবে পশ্চিম বাংলার নির্বাচনে কংগ্রেস একটি গুরুত্বপূর্ণ দল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
২০১১ সালের নির্বাচনে তারা বিধান সভায় ৪২টি আসন পায়। কংগ্রেস বামফ্রন্টকে হারানোর জন্য ২০১১ সালের নির্বাচনে মমতার সঙ্গে জোট বাঁধে। এখন আবার মমতাকে তাড়ানোর জন্য বামফ্রন্টের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে।
বিজেপির অবস্থান : পশ্চিম বাংলায় দীর্ঘকাল ধরে বামফ্রন্টের প্রাধান্য বজায় থাকার কারণে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটেনি। কেন্দ্রে বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে পশ্চিম বাংলায় এর অনুরণ পরিলক্ষিত হয়। সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। বিগত জাতীয় নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এখানে কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এবার তারা জোট বেঁধেছে গোর্খা জনমুক্তি মঞ্চের সঙ্গে।
পশ্চিম বাংলার রাজনীতিতে নানা মত ও পথের পরিচয় স্পষ্ট হলেও মূলত দুই শক্তি এই নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করছে। এরা হলো কংগ্রেস-বাম প্রভাবিত জোট এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগেস। বামজোট দৃঢ়তার সঙ্গে বলছে তারা জয় লাভ করবে- যদি নির্বাচনী নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হয়। অপরপক্ষে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ে জনতা তাকেই পুনর্বির্বাচিত করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। আমাদের নিকটবর্তী হিসেবে আমরা আশা করি, সেখানে এমন একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক যারা সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করবে এবং গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থার প্রতি সজাগ থাকবে।
লেখক : ড. আবদুল লতিফ মাসুম : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।