বাংলা নববর্ষ : অর্থনৈতিক তাৎপর্য
বাঙালির আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে বাংলা নববর্ষের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। নববর্ষ আমাদের জীবনে আসে নতুন স্বপ্ন নিয়ে, বেঁচে থাকার নবীন আশ্বাস নিয়ে। নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখে অতীতের কথা ভুলে গিয়ে আমরা নতুনের আহ্বানে সঞ্জীবিত হয়ে উঠি। প্রাত্যহিক কাজকর্মের পরিবর্তে এই দিনে বাঙালির ঘরে ঘরে চলে উৎসবের আমেজ-ঘরবাড়ি পরিষ্কার হয়, সবাই পরিধান করে নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ, ভালো খাবারের আয়োজন চলে, সবাই দল বেঁধে যায় বৈশাখী মেলায়। বস্তুত, নববর্ষ মিশে আছে বাঙালির সত্তার সঙ্গে, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে নববর্ষের সেই পুরোনো ঐহিত্য এখন কিছুটা ম্লান, সন্দেহ নেই; তবে লক্ষণীয় যে, নিকট অতীত থেকে নববর্ষ নতুন মাত্রায় হয়েছে অভিষিক্ত। নববর্ষ এখন শুধু ঐতিহ্যিক-সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গই নয়, তা আমাদের জাতিসত্তার পরিচয়েরও অন্যতম শক্তি-উৎস।
সাংস্কৃতিক পরিচয়, জাতিসত্তার ঠিকানা এবং প্রতিবাদের শক্তি-উৎস হিসেবে নববর্ষের যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি রয়েছে তার অর্থনৈতিক গুরুত্ব। বাঙালির অর্থনৈতিক জীবনের সঙ্গে নববর্ষের রয়েছে একটি নিবিড় সংযোগ। দূর অতীতে নববর্ষের প্রথম দিন থেকেই বাঙালির অর্থনৈতিক জীবনের বার্ষিক নতুন পথচলা শুরু হতো-এখনো কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রচলিত আছে এই ঐতিহ্য। সাংবাৎসরিক হিসাব-নিকাশ চলে এই দিনে, ব্যবসা-বাণিজ্যের লাভ-ক্ষতি মিলিয়ে দেখা হয় পহেলা বৈশাখে। ব্যবসায়ীদের কাছে এ অনুষ্ঠান ‘হালখাতা’ নামে পরিচিত। ‘হালখাতা’ নতুন বাংলা বছরের হিসাব পাকাপাকিভাবে টুকে রাখার জন্য ব্যবসায়ীদের নতুন হিসাব খোলার এক আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ। হালখাতায় কাজ-কারবারের লেনদেন, বাকি-বকেয়া, জমা-খরচ সবকিছুর হিসাব লিখে রাখার ব্যবস্থা হয়। দোকানিরা তাঁদের গ্রাহক, পৃষ্ঠপোষক ও শুভার্থীদের দোকানে নিমন্ত্রণ করেন। সবার সঙ্গে দেখা হয়, হয় মিষ্টিমুখ। কিন্তু একই সঙ্গে পুরোনো বকেয়াও শোধ করে দেওয়া হয়। শুরু হয় আবার নতুন লেনদেন। নববর্ষে হালখাতার এ-অনুষ্ঠান নানা কারণেই এখন পুরোনো পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে। তবে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বোধ করি, এই ঐতিহ্যের আন্তরিক অনুশীলন এখন অতি জরুরি। নানা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে সময়মতো তা পরিশোধ না করা, এখন এ দেশের একটা সাধারণ প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। কল্পনা করা যাক, নববর্ষের হালখাতার দিনে সব ঋণ শোধ হয়ে গেল, তাহলে কেমন হয়? সংশ্লিষ্ট মহল একবার ভেবে দেখবেন কি?
নববর্ষের প্রথম দিনে বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে কৃষিকাজের সূচনা হয়। হয়তো মাঠ চাষের অনুপযোগী, বৃষ্টির জন্য কৃষক আকাশের দিকে তাকিয়ে, তবু নববর্ষ এলে শুভ-সূচনার উৎস হিসেবে তিনি মাঠে যান, সামান্য চাষ করে নতুন বছরের কৃষিকাজ শুরু করে দেন। এভাবে বাংলার কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক জীবনের সঙ্গেও নববর্ষের রয়েছে আত্মিক সম্পর্ক।
নববর্ষের সঙ্গে অন্য যে প্রসঙ্গটি নিবিড়ভাবে জড়িত, তা হলো বৈশাখী মেলা। নববর্ষে বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে মেলা। বৈশাখ মাসজুড়ে চলে এই মেলা। কোথাও বা তিনদিন বা সাতদিনের মেলাও বসে। এসব মেলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি হয়, বিক্রি হয় নানা ধরনের খেলনা। এসব মেলায় যাত্রা, পুতুল নাচ ও সার্কাস বসে, গ্রামীণ জীবনে দেখা দেয় নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা। সন্দেহ নেই, এই মেলায় কেনাবেচার প্রক্রিয়া বাংলার গ্রামীণ অর্থনৈতিক জীবনে নতুন প্রবাহ সঞ্চার করে; অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেখা দেয় সচলতার আহ্বান।
অতীতে, বাংলার সামন্তযুগে, নববর্ষের সঙ্গে ‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। এই অনুষ্ঠানে প্রজাসাধারণ জমিদারকে খাজনা পরিশোধ এবং নতুন বছরের খাজনা প্রদানের সূত্রপাত করত। জমিদারতন্ত্রের অবসানের ফলে এ প্রথা এখন উঠে গেছে। তবে এই অনুষ্ঠানের ইতিবাচক দিক সামাজিক মেলামেশা এখনো বর্তমান। গ্রামগঞ্জে বার্ষিক খাজনা দেওয়া হয় চৈত্র মাসে। নববর্ষের আগেই খাজনা পরিশোধের এই বিধান গ্রামজীবনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম দিক।
বাংলা নববর্ষে আত্মীয়স্বজন ও প্রিয়জনকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো এখন একটা প্রথায় পরিণত হয়েছে। ফলে নানা ধরনের খাবার কেনা হয়, কেনা হয় নানা মিষ্টিদ্রব্য। এই মিষ্টিদ্রব্য নববর্ষের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবেই বিবেচ্য।
সাম্প্রতিককালে নববর্ষের মেলা কেবল গ্রামীণ জীবনেই সীমাবদ্ধ নয়, শহরেও ছড়িয়ে পড়েছে এর বিস্তার। নববর্ষে এখন শহরে বসে বৈশাখী মেলা, লোকমেলা কিংবা বইমেলা। নববর্ষে বইমেলার আয়োজন একান্তভাবেই নতুন উপাদান এবং তা বাংলার শাহরিক সভ্যতার অংশ। এসব মেলায় বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেন হয়, বৃদ্ধি পায় অর্থনৈতিক সচলতা।
এভাবে দেখা যায়, নববর্ষ কেবল সাংস্কৃতিক আর সামাজিক উৎসবই নয়, একই সঙ্গে তা অর্থনৈতিক উৎসবও বটে। বাংলার নববর্ষ আমাদের অর্থনৈতিক জীবনের সঙ্গে নিবিড়-গভীরভাবে সম্পর্কিত। বাংলা নববর্ষের অতীত ঐতিহ্যগুলো যদি যথাযথভাবে পুনর্জীবিত করা যেত, তাহলে নিঃসন্দেহে আমাদের অর্থনৈতিক বিপন্নতা-উত্তরণের একটা পথ পাওয়া যেত। আমরা বিশেষভাবে ‘হালখাতা’ উৎসবে ঋণ পরিশোধের প্রসঙ্গের কথা বলছি। অপ্রিয় হলেও সত্য, ঋণগ্রাহকরা নানা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা নিয়ে নিজেরা ধনী হয়েছেন, কিন্তু দরিদ্র করেছেন দেশকে, দেশের মানুষকে। কেননা, ঋণ নিয়ে তারা আর ঋণ পরিশোধ করছেন না। আমরা আশা করব, ১৪২৩-এর এই নববর্ষে হয়তো আমাদের চৈতন্যোদয় হবে।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।