আন্তর্জাতিক
মিয়ানমারে গণতন্ত্রের শুভযাত্রা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা
মিয়ানমারে গণতন্ত্রের শুভসূচনা ঘটেছে। গত ৩০ মার্চ গণতান্ত্রিক সংস্কারের সর্বশেষ ধাপে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে থিন কিউ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। বিগত প্রায় ৫০ বছরের ইতিহাসে অব্যাহত সামরিক শাসন অবশেষে তিনিই প্রথম বেসামরিক ব্যক্তি যিনি মিয়ানমারের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। এর মাধ্যমে সামরিক কর্তৃপক্ষের হাত থেকে গণতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষের হাতে ক্ষমতা অর্পিত হলো। গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হলো নেত্রী অং সান সু চির প্রধানমন্ত্রী সমতুল্য পদে অনুমোদন। গত ৫ এপ্রিল এ-সংক্রান্ত একটি বিল দেশটির পার্লামেন্টে অনুমোদিত হয়েছে। সেনা প্রতিনিধিদের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে এ বিলটি পাস হয়। এর ফলে স্টেট কাউন্সিলর বা রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা হবেন অং সান সু চি। কিন্তু আদতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর সমতুল্য ভূমিকায়। বিলটি প্রেসিডেন্টের অনুমোদনসাপেক্ষ।
প্রেসিডেন্ট থিন কিউ এনএলডি তথা নেত্রীর ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় সূ চির এ পদে অধিষ্ঠান একরকম সময়ের ব্যাপার মাত্র। রাষ্ট্রের উপদেষ্টা বিল শিরোনামের সু চির ক্ষমতায়ন বিল অনুযায়ী তিনি রাষ্ট্রীয় যেকোনো প্রতিষ্ঠান, বিভাগ ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে পরামর্শ দিতে পারবেন। এর আগে নেত্রীকে চারটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ওই দায়িত্বকে আইনানুগ করা এবং সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় সকল কার্যক্রমের ওপর সু চির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ সাংবিধানিক পরিবর্তন আনয়ন করা হয়েছে।
সূচির উপদেষ্টা প্রস্তাবনা ও সামরিক বাহিনীর বিরোধিতা
উল্লেখ্য যে, সু চির নেতৃত্বে ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে সু চির দল ‘ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)’। জনগণ অধীর আগ্রহে সু চির নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষমাণ ছিল। কিন্তু এত বিপুল বিজয়ের পরেও তাদের সন্দেহ-অবিশ্বাস কাটছিল না। এর প্রধান কারণ দুটো- ১. সেনাবাহিনী আদৌ নিরঙ্কুশভাবে ক্ষমতা পরিত্যাগ করবে কি না। এর আগে নির্বাচিত হয়েও সু চি সেনাবাহিনীর অস্বীকৃতির কারণে ক্ষমতা লাভ করেননি। ২. সামরিক বাহিনী প্রণীত সংবিধানের ৫৯(এফ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘মিয়ানমারের কোনো নাগরিকের স্বামী বা স্ত্রী কিংবা সন্তান বিদেশি হলে তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না।’ সু চির প্রয়াত স্বামী একজন ব্রিটিশ নাগরিক। আবার দুই ছেলেও মিয়ানমারের নাগরিক নন। এই দুটি কারণে অস্বস্তিতে ছিল জনগণ। সংবিধানের যে ধারার কারণে গণতন্ত্রকামী নেত্রী সু চির প্রেসিডেন্ট হতে বাধা রয়েছে, তা অপসারণে এনএলডি এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে আপস আলোচনা এর আগে ব্যর্থ হয়েছে। সেনাবাহিনীর মুখপাত্রের বক্তব্য ছিল, ‘ধারাটি জেনেবুঝেই সংবিধানে রাখা হয়েছে, যেন বিদেশি আগ্রাসন থেকে দেশের মানুষকে বাঁচানো যায়।’ অপরদিকে এনএলডির পক্ষ থেকে গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থার দোহাই দেওয়া হয়। সু চির রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা পদে অনুমোদন প্রস্তাবনায় সেনাবাহিনীর আগের অবস্থানের প্রতিধ্বনি ঘটে। পার্লামেন্টে উত্থিত এই প্রস্তাবনার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিত্বশীল সামরিক কর্মকর্তারা প্রবল প্রতিবাদ করেন। তাঁরা বিলটিকে অসাংবিধানিক বলে অভিহিত করেন।
সংকটের পটভূমি
বর্তমান পৃথিবীতে গণতন্ত্র হচ্ছে একটি কাঙ্ক্ষিত শাসনব্যবস্থা। দুর্ভাগ্যবশত মিয়ানমার (পূর্ব নাম বার্মা, প্রাচীনে ব্রহ্ম দেশ)-এর জনগণ বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত ছিল। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো মিয়ানমার ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ব্রিটিশ ভারতের মতো সেই স্বাধীনতা অর্জন নিয়মাতান্ত্রিক ছিল না। ঔপনিবেশিক শাসনের শুরু থেকেই বর্মী জনগণ স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করে আসছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে জাপান বার্মা দখল করে নিলে স্বাধীনতাযুদ্ধ তরান্বিত হয়। যুদ্ধ চলাকালে ‘অধিপতি’ নামে জাপান নিয়ন্ত্রিত স্বল্পস্থায়ী একরকম রাজতন্ত্র কায়েম হয়। স্বাধীনতার জন্য আকাঙ্ক্ষা সংগ্রামশীল সব দল ও পক্ষকে একীভূত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। সবাইকে নিয়ে গঠিত হয় Anti-Fascist People’s Freedom League (AFPFL)। ধর্মীয় রাজনীতিবিদ উনু এর নেতৃত্ব দেন। স্বাধীনতার পর এক দশক এই জোট দেশ শাসন করে।
প্রথম সামরিক শাসন
১৯৫৮ সালের সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৯৬০ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকে। এই সরকার দেশে বিভিন্ন অঞ্চলের বিদ্রোহ দমন করে। অবশ্য অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যর্থ হয়। এ সময়ে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে জাতীয় নেতা উনু ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করেন। এএফপিএফএলের অপর অংশ বিরোধী দলে অবস্থান করে। উনুর বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে জাতীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলার পুনরাবির্ভাব ঘটে। সেনাবাহিনী এ সুযোগ গ্রহণ করে। ১৯৬২ সালে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত একটানা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে তারা। সামরিক বাহিনী আইন সভা ও বিচার বিভাগের একরকম অবলুপ্তি ঘটায়। এরা একটি সামরিক বিপ্লবী পরিষদ গঠন করে। রাজনৈতিক কার্যক্রম এবং মৌলিক নাগরিক স্বাধীনতা পরিত্যক্ত হয়। ১৯৭৪ সালে জেনারেল নে উইন-এর নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। Burma Socialist Program Party নামে গঠিত দেশের একমাত্র বৈধ দল বলে ঘোষিত হয়। জনগণের জন্য ন্যায় নিশ্চিত করার নামে রাষ্ট্রব্যবস্থার সর্বস্তরে ক্ষমতাসীন পার্টির লোক বসিয়ে দেওয়া হয়। এ সময়ে ‘পিথু হলুত্তা (Pyithu Hluttaw) নামে সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত জাতীয় সংসদ গঠিত হয়।
১৯৮৮-এর গণ-আন্দোলন ও তৃতীয় অভ্যুত্থান
দীর্ঘদিনের সামরিক শাসন এবং অর্থনৈতিক দুর্দশায় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে মিয়ানমারের নাগরিক সাধারণ। ১৯৮৮ সালের প্রথম দিকে রাজধানী রেঙ্গুনসহ দেশের সর্বত্র ব্যাপক গণবিক্ষোভ হয়। এতে দেশের ছাত্রসমাজ ব্যাপকভাবে অংশ নেয়। সামরিক সরকার ব্যাপক রক্তপাত ঘটিয়ে আন্দোলন দমন করে। ক্ষমতাসীনরা নামে মাত্র পরিবর্তন এবং সংস্কার এনে ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে চায়। কিন্তু সামরিক রাজনীতির বৈশিষ্ট্যগত ধারায় ক্ষমতাসীন সামরিক ব্যক্তিবর্গকে হটিয়ে দিয়ে এদেরই আরেক অংশ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়। ১৯৮৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ক্ষমতার এই পটপরিবর্তন ঘটে। মিয়ানমারের ইতিহাসে এটি তৃতীয় অভ্যুত্থান বলে পরিচিত। সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন ১৮ কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত The State Law and Order Restoration Council (SLORC) সামরিক আইনের মাধ্যমে দেশ শাসন করতে থাকে। এরা আগের সরকার কর্তৃক গঠিত রাজনৈতিক দল বাতিল করে। পরিবর্তিত সরকার রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেয়। বহুদলীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের কথা বলে। সামরিক বাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে থাকার নির্দেশনা দেয়।
নির্বাচন প্রতারণা
নতুন রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির আওতায় ১৯৯০ সালের ২৭ মে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন National League for Democracy (NLD) ৮০ ভাগ আসনে জয়লাভ করে। কিন্তু নবগঠিত সরকার জনগণের এ রায় গ্রহণে অস্বীকার করে। এরা জনগণের ক্ষোভ পোষণের জন্য নিজেদের পছন্দসই লোকদের নিয়ে ৭০০ সদস্যের সাংবিধানিক পরিষদ (Constitutional Council) গঠন করে। এই পরিষদ একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং আরেকটি সাধারণ নির্বাচনের পরিকল্পনা করে। অপরদিকে NLD-এর নির্বাচিত সদস্যরা রাষ্ট্রশাসনে তাঁদের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে National Coalition Government ঘোষণা করেন। ক্ষমতাসীন SLORC ন্যায়ানুগভাবে নির্বাচিত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ১৯৯৩ সালে সামরিক জান্তা গঠিত সাংবিধানিক পরিষদ একটি সংবিধান প্রণয়ন করে। ১৯৯৫ সালে তারা অং সান সু চিকে বিনা শর্তে মুক্তি দেয়। ১৯৯৬ পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। অং সান সু চির বাসভবন হয়ে দাঁড়ায় গণ-আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু।
রাজনৈতিক সংস্কার
অবশ্য পরবর্তীকালে রাজনৈতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করে সামরিক জান্তা। ২০১১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক সংস্থার ও সমঝোতার পথ গ্রহণ করে তারা। বর্মী জনগণের অবিসংবাদিত নেতা অং সান সু চিকে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। সরকার তাঁর সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করে। প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন এবং মন্ত্রী অংকীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত এই সংলাপের উদ্দেশ্য সম্পর্কে গণমাধ্যমে বলা হয় : ‘উভয় পক্ষ তাদের মধ্যকার মতপার্থক্য নিরসনে রাজি হয়েছে। তারা দেশ ও জনগণের সাধারণ স্বার্থে কাজ করতে সম্মত হয়েছেন’। অং সান সু চিকে অবাধে সারা দেশে ভ্রমণের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এসব রাজনৈতিক সমঝোতার আলোকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হয়। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার আওতায় ২০০ রাজবন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়। নতুন শ্রম আইন প্রণীত হয়। ট্রেড ইউনিয়ন এবং ধর্মঘট করার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়। গণমাধ্যমের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়। সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, আরোপিত বিধিনিষেধ গণতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সুতরাং বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা উচিত। ভয়েস অব আমেরিকা, ইউটিউবসহ কয়েকটি মাধ্যমের ওপর থেকে বিধি নিষেধ প্রত্যাহার করা হয়। ২০১২ সালের মার্চ মাসে তথ্যমন্ত্রী অবহিত করেন যে, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম আইন সংস্কার করা হয়। জাতীয় মুদ্রানীতি সংস্কার করা হয়। ২০১২ সালের মার্চ মাসে সাংবিধানিক পরিষদে সরকার একটি আইন পাস করে। এ আইনের আওতায় সেনাবাহিনীসহ সব কর্মচারীর বেতন বৃদ্ধি করা হয়। দুর্নীতি দূরীকরণের লক্ষ্যে এ বেতন বৃদ্ধি ঘটে বলে সরকারি সূত্রে বলা হয়।
উপনির্বাচন
রাজনৈতিক সমঝোতার অংশ হিসেবে ২০১২ সালের ১ এপ্রিল জাতীয় সংসদ ‘হুলুত্তাও’-এর বেশ কয়েকটি আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অং সান সু চির এনএলডিকে এ উপনির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। ফলাফল হয় বিস্ময়কর। ৪৪টি আসনের ৪১টিতে জয়লাভ করে বিরোধীরা। অং সান সু চি একটি আসনের ব্যক্তিগত জয়লাভের মাধ্যমে পুনঃআনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। জাতীয় সংসদের নিম্ন পরিষদে এনএলডির বিজয় তাদের ব্যাপক জনপ্রিয়তার প্রমাণ দেয়। সম্ভাবনাময় সমঝোতার প্রান্তিক পর্যায়ে উপনীত হলেও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অব্যাহত থাকে। যুদ্ধরত গোষ্ঠীগুলোও তাদের তৎপরতা বন্ধ করেনি।
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছিলেন, ক্রমবর্ধমান সংস্কারের ফলে চরমপন্থী সেনা কর্মকর্তারা বিগড়ে যেতে পারেন। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে বারবার আশ্বস্ত করা হয়। কেউ কেউ পাল্টা অভ্যুত্থানের আশঙ্কা করছিলেন। বিবিসি বিশ্লেষক মেরিলাল মন্তব্য করেন, ‘আসিয়ান বাণিজ্য বাজারে প্রবেশ এবং ২০১৫ সালের নির্বাচন বিজয়ের লক্ষ্যে সামরিক জান্তা এসব সংস্কারে রাজি হয়েছে।’ অং সান সু চি নিজেও সংস্কার ফলাফল নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে বহুল আকাঙ্ক্ষিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
নির্বাচন ২০১৫
মিয়ানমারের বিগত ৫০ বছরের ইতিহাসে এটাই ছিল অবাধ ও গণ-অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে অং সান সু চির এনএলডি নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। ৫০ বছরের সামরিক শাসন অবসানের লক্ষ্যে এ নির্বাচন ছিল গণতন্ত্রের পথে প্রথম পদক্ষেপ। নির্বাচনে এনএলডি জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষের ২২৪ আসনের মধ্যে ১৩৫ আসন লাভ করে। অন্য আরেকটি রাজনৈতিক দল ইউএসডিপি এখানে ১১ আসন, অন্যরা ২২ আসন পায়। অপরদিকে সেনাবাহিনী উচ্চ পরিষদে ৫৬ আসন দখল করে। নিম্ন পরিষদেও একই ধারা অব্যাহত থাকে। ২৪০ আসন বিশিষ্ট নিম্ন পরিষদে এনএলডি ২৫৫, সেনাবাহিনী ১১০, ইউএসডিপি ৩০ এবং অন্যরা ৩৮ আসন পায়। এর বাইরে সংবিধান অনুযায়ী উভয় পরিষদের এক-চতুর্থাংশ আসন সেনাবাহিনীর দখলে রয়েছে।
আশা
প্রেসিডেন্ট থিন কিউ শপথ গ্রহণের পর বলেছেন, তাঁর সরকার একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ নেবে। এটি হবে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এক-চতুর্থাংশ সামরিক বাহিনীর সদস্যসংবলিত বর্তমান পার্লামেন্টের পক্ষে সত্যিকার গণতন্ত্রে উত্তরণ হবে একটি কঠিন কাজ। পৃথিবীর যেকোনো সংবিধানের সঙ্গে সামরিক বাহিনী প্রদত্ত সংবিধান মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কোনো দেশের পার্লামেন্টে সামরিক বাহিনীর আসন সংরক্ষণ একটি অভাবিত বিষয়। এর আগে ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্কে এই অদ্ভুত ব্যবস্থাটি গণতন্ত্রের তৃতীয় তরঙ্গে (Third Wave of Democracy) ভেসে যায়। মিয়ানমারের সাধারণ মানুষ আশা করে বর্তমানে ফিরে আসা গণতন্ত্রের অভিঘাতে সামরিক বাহিনীর গায়ের জোরের বিধানও ভেসে যাবে। গণতন্ত্রের সূচনা মিয়ানমারের রাজনীতিতে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। এ দেশের সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগণের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠের বিশেষত আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর আরোপিত নির্বাসন এবং নিপীড়নের অবসান ঘটবে বলে বাংলাদেশের জনগণ আশা করে।
আশঙ্কা
সামরিক শাসন সম্পর্কে যাঁদের অধ্যয়ন রয়েছে, তাঁরা জানেন সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা আরোহন হচ্ছে বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়ার মতো। ক্ষমতা রাখাও বিপজ্জনক, ছাড়াও বিপজ্জনক। মিয়ানমার সেনাবাহিনী অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং দীর্ঘকালব্যাপী আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধের ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটাতে বাধ্য হয়েছে। অং সান সু চির জন্য সামনের সময়টি বিপজ্জনক এবং স্পর্শকাতর। নতুন সরকারের সাফল্য নির্ভর করছে অং সান সু চির রাজনৈতিক কুশলতা এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব নিরসনের ওপর। সেনাবাহিনী বাধ্য হয়ে বেসামরিক সরকারকে গ্রহণ করলেও তারা সময়ান্তরে মিসরের সেনাপ্রধান আবুল ফাত্তাহ সিসির মতো সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে। সু চির জন্য ইতিবাচক দিক হলো, দেশটি সেনাবাহিনীর এবং জনগণের হলেও চূড়ান্ত বিবেচনায় শুধু জনগণের, আর জনগণ রয়েছে তাঁরই সঙ্গে।
লেখক : সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।