ব্রাজিল সংকট
দিলমা রৌসেফের অভিশংসনকথা
গেরিলা যোদ্ধা থেকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়ে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট হন তিনি। তিনিই প্রথম নারী, যিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট হন। সামরিক জান্তার নির্যাতন পেরুতে হয়েছিল তাঁর। কারাবাসেও কাটাতে হয়েছে অনেকটা সময়। বলা হচ্ছে দিলমা রৌসেফের কথা। সেই লৌহমানবীই এখন বাজেট ঘাটতি গোপনের অভিযোগে হারিয়েছেন ক্ষমতা। দেশটির পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেট গত বৃহস্পতিবার তাঁকে অভিশংসনের পক্ষে ভোট দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ছয় মাসের জন্য বরখাস্ত হলেন দিলমা। তাঁকে বরখাস্তের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিতে অবসান ঘটল টানা ১৩ বছরের বাম শাসনের।
এদিকে দিলমার স্থলাভিষিক্ত হলেন দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট মিশেল টিমার, যাঁর বিরুদ্ধে ক্ষমতার লোভে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করে আসছেন দিলমা। অভিশংসন প্রক্রিয়ার নিন্দা জানিয়েছেন দিলমা রৌসেফ। ব্রাজিলের সংবিধান, গণতন্ত্র, জনগণের সার্বভৌম অধিকার এখন ঝুঁকিতে। ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট মিশেল টিমার নতুন ব্যবসাবান্ধব মন্ত্রিসভার ঘোষণা দিয়েছেন।
দিলমা রৌসেফের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, ২০১৪ সালে পুনর্নির্বাচনের সময় বাজেট আইন ভঙ্গ করে সরকারি হিসাবে কারসাজি করেছিলেন তিনি। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি পেট্রোবাসের কোটি টাকার একটি প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
ব্রাজিলের সিনেট বুধবার থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত টানা ২২ ঘণ্টা শুনানির পর প্রেসিডেন্ট দিলমা রৌসেফকে অভিশংসন তথা সংসদীয় বিচারের মুখোমুখি করার পক্ষে ভোট দিয়েছে। ৮১ সদস্যের সিনেটের ৫৫ জন প্রেসিডেন্ট দিলমাকে অভিশংসনের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। বিপক্ষে ভোট দেন ২২ জন। বাকিরা ভোট দেননি। এতে প্রস্তাব পাস হওয়ায় তিনি প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত হলেন। ব্রাজিলের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট দিলমার বিরুদ্ধে দেশের বিপুল বাজেট ঘাটতি গোপন করে রাখার অভিযোগ আনা হয়। এ অভিযোগে এখন তাঁর বিচার শুনানি চলবে আগামী ১৮০ দিন। ছয় মাস পরের ভোটাভুটিও দিলমার বিরুদ্ধেই যাবে এমনটি আশা করছে সবাই। যদিও অভিযোগ শুরু থেকেই অস্বীকার করে আসছিলেন দিলমা। আর ক্ষুব্ধতার তীর ভাইস প্রেসিডেন্ট টিমারের প্রতি। এ অভিশংসনকে ‘একজন নিরীহ নারীর বিরুদ্ধে অবিচার’ বলেও উল্লেখ করেছে কেউ কেউ। অভিশংসন ঠেকাতে সর্বশেষ প্রচেষ্টা হিসেবে দেশের সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছিলেন দিলমা, তবে তাতে কাজ হয়নি। এখন যিনি প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট মিশেল টিমার। টিমার মূলত দিলমাবিরোধী হিসেবেই পরিচিত। তিনি এরই মধ্যে দিলমার কাছ থেকে ক্ষমতা বুঝে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। ব্রাজিলের মধ্যডানপন্থী পিএমডিবি পার্টির নেতা হিসেবে পরিচিত টিমার। শিগগিরই নতুন সরকার ঘোষণা করবেন তিনি।
দিলমার অপসারণের মধ্য দিয়ে ব্রাজিলে একটি যুগের অবসান ঘটল। ২০০৩ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি ক্ষমতায় আসে এবং প্রেসিডেন্ট হন লুলা ইনাসিও ডি সিলভা। তাঁরই উত্তরসূরি হিসেবে ২০১০ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসেন দিলমা। ২০১৪ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হন তিনি। ১৩ বছর আগে ব্রাজিলে বামপন্থীরা ক্ষমতায় আসার পর দেশটিতে বিরাট পরিবর্তনের সূচনা হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচ থেকে টেনে তোলা সম্ভব হয়। তবে ব্রাজিল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আবারও অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে। এতেই টানাটানি শুরু হয়। গত বিশ্বকাপের সময়ও দেখা গেছে ব্রাজিলের জনগণ দিলমার বিরোধিতা করে স্লোগান দিয়েছে। কেন এই অবস্থার মধ্যে দেশে বিশ্বকাপ আয়োজনের মতো সিদ্ধান্ত নিল সরকার? এ নিয়ে কম ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। বিশ্বব্যাপী ব্রাজিল তখন আলোচিত হয়েছিল বেশ। দেশে ফুটবল বিশ্বকাপের মতো আয়োজন চলছে, যা কিনা সারা বিশ্বের মানুষকে এক কাতারে নিয়ে আসে। সেখানে ব্রাজিলে উৎসবের বদলে আন্দোলন! দিলমার অভিশংসনের মাধ্যমে এটা পরিষ্কার হলো যে মানুষ কতটা বিরক্ত হয়েছিল তাঁর শাসনের এ সময়টিতে। দেশের হাজার হাজার দিলমাবিরোধী সমর্থক রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভ করেছে। বলেছে তাদের আর প্রয়োজন এ প্রেসিডেন্টের।
লেখক : শিক্ষার্থী, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।