আন্তর্জাতিক
ব্রাজিলে বিতর্কিত অভিশংসন
যখনই ‘তৃতীয় বিশ্ব’ শব্দটি উচ্চারিত হয়, তখনই একশ্বাসে নির্দেশিত হয় এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা। মূলত দক্ষিণ আমেরিকার এই মহাদেশ লাতিন ভাষাভাষী হওয়ার কারণে অঞ্চলটি লাতিন আমেরিকা বলেই পরিচিত। পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি দেশ হলেও লাতিন আমেরিকায় উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে খুব কম। ব্রাজিল দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় দেশ। অফুরন্ত সম্পদের ভাণ্ডার এ দেশটি, তবুও এটি তৃতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিক সীমারেখায় আবদ্ধ। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামরিক শাসনের ইতিহাস এবং বিশ্ব পুঁজির প্রতিযোগিতায় আক্রান্ত এ দেশটি। সম্প্রতি দেশটি আন্তর্জাতিক বলয়ে আলোচিত হয়েছে এ দেশের প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফকে অভিশংসন করে।
মে মাসের ১২ তারিখে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। এই অভিশংসন প্রক্রিয়া অনুযায়ী রুসেফ ১৮০ দিন ক্ষমতার বাইরে থাকবেন। এর মধ্যে যদি তিনি দোষী প্রমাণিত হন, তাহলে তাঁকে আর ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হবে না। তবে তিনি যদি নির্দোষ প্রমাণিত হন, তাহলে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবেন। তবে সে দেশের আইন অনুযায়ী অভিশংসিত করতে সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন পেতে হবে। তার মানে ৮১ সদস্যের সিনেটের ৫৪ জন যদি তার বিপক্ষে ভোট দেয়, তাহলে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হবেন। এ ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন বিরোধী শক্তির পক্ষে খুব কঠিনই মনে হয়। তার কারণ, সিনেটের ভেতরে এবং রাজপথে উভয় পক্ষই বেশ শক্তিশালী। কেহ কারে হারাতে নারে—সমানে সমান। যদি এভাবে দিলমা রুসেফের ক্ষমতাচ্যুতি ঘটে, তাহলে ব্রাজিলে ১৩ বছর ধরে চলে আসা বামপন্থী সরকারের স্থায়ী অপসারণ ঘটবে। সিনেটের এই ভোটের পর রুসেফ এক ভাষণে তাঁর বিরুদ্ধে উপস্থাপিত অভিশংসনকে তিনি অভ্যুত্থান আর তামাশা বলে অভিহিত করেন। তিনি আরো বলেন, ব্যালট বাক্সের প্রতি সম্মান, ব্রাজিলের জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছা ও সংবিধান এক ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। রুসেফ অভিযোগ করেন, পরিকল্পিত চক্রান্তের অংশ হিসেবে তাঁর বিরুদ্ধে অভিশংসনের এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, দীর্ঘ ২২ ঘণ্টা বিতর্কের পর ১২ মে বরখাস্তের পক্ষে রায় দেয় সিনেট। ৮১ সদস্য সিনেটের মধ্যে ৫৫ জন রুসেফের বিরুদ্ধে ভোট দেন। ২২ জন সদস্য তাঁর পক্ষে ভোট দেন। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, একে ডান-বামের রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বলে অভিহিত করা যায়। বামপন্থী বিশ্লেষকরা একে প্রগতিশীল রাজনীতিক দিলমা রুসেফের বিরুদ্ধে করপোরেট পুঁজি তথা সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত বলে অভিহিত করেছেন।
দৃশ্যত সাময়িকভাবে অভিশংসিত রুসেফকে এখন ছয় মাসের জন্য ক্ষমতার বাইরে থাকতে হবে। দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাঁর প্রতিপক্ষ হিসেবে পরিচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইকেল তোমার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট মনোনীত হয়েছেন। বিশ্ব পুঁজির এজেন্ট বলে কথিত তেমার এরই মধ্যে একটি ব্যবসাবান্ধব মন্ত্রিপরিষদ ঘোষণা করেছেন। তেমার ডানপন্থী দল পিএমডিবির শীর্ষস্থানীয় নেতা। তিনি কেন্দ্রীয় সাবেক প্রধান হেনরিকে অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত করেছেন। এরই মধ্যে সাময়িক সরকারের পক্ষ থেকে আমূল পরিবর্তনে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। দিলমা রুসেফের বিরুদ্ধে উত্থিত আন্দোলনের কারণ অনুসন্ধান করে যা জানা গেছে, তা তৃতীয় বিশ্ব মানের কোনো গুরুতর অপরাধ নয়। মূল অভিযোগ হিসেবে যা বর্ণনা করা হয়েছে—ক. ২০১৪ সালে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার আগে তাঁর হস্তক্ষেপে ক্রমবর্ধমান সরকারি অর্থনৈতিক ঘাটতি চেপে যাওয়া; খ. অসত্য তথ্য-উপাত্ত দিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে; গ. এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে তাঁর দেশে বাজেট আইন ভঙ্গ করেছেন। এখন তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা চলবে কয়েক মাস। সিনেটের বিতর্কে অংশগ্রহণ করে অপর একজন রাজনীতিবিদ বলেছেন, অসুস্থ এই দেশটিকে বাঁচাতে অভিশংসন নামের তেতো ওষুধের বিকল্প নেই। অবশ্য রুসেফপন্থীরা বরাবরই বলে আসছেন, জোর করে ক্ষমতা দখলের একটি প্রক্রিয়া চলছে। মার্ক্সবাদী রুসেফ দেশ শাসনে নানা ধরনের ভুল পদক্ষেপ নিলেও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সৎ বলে পরিচিত। তাঁর রয়েছে সুদীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। একসময় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। গত শতকের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে তিনি কারাবরণ করেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের পর্যালোচনায় দেখা যায়, সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। একটি বিরাট অংশ রাজনীতিকদের প্রতি ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে পড়েছে। তাঁরা গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছেন। এরা সামরিক শাসনের পক্ষেও মত প্রকাশ করছে। রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে জনগণের ব্যাপক হতাশার কারণ হলো পর্তুগিজদের থেকে স্বাধীনতা লাভের পর প্রকৃতপক্ষে দেশের কোনো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটেনি। বর্তমানে প্রাচুর্যময় এই দেশে নিদারুণ অর্থনৈতিক সংকট চলছে। মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলা অধোগতি এবং দুর্নীতির বিস্তার দেশটিকে ধ্বংসের প্রান্ত সীমায় নিয়ে গেছে। যদিও সেখানে সাম্প্রতিককালে কৃষিভিত্তিক শিল্পায়নের প্রসার ঘটেছে, মৌলিক শিল্পায়নের অগ্রগতি হয়েছে, তবুও তা জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে তেমন কোনো সুফল প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনীতির ধারাটি এ রকম যে, সামগ্রিকভাবে সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে না আনলে তা গোটা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। যে রাজনৈতিক পক্ষই ক্ষমতায় থাকুক, তারা যদি দুঃশাসন নিশ্চিত করে, তাহলেই জনগণের মঙ্গল।
লেখক : অধ্যাপক সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।