আন্তর্জাতিক
মমতার আশা এবং আমাদের আশঙ্কা
মানুষ বলে, ‘মুখ নাকি মনের আয়না’। ঠিক তেমনি নির্বাচন হচ্ছে জনগণের মনের কথা। নির্বাচন যদি সঠিক, সুন্দর ও নিরপেক্ষ হয় তাহলে মানুষের মনের কথা বেরিয়ে আসে। আর এই মনের কথার অপার নাম হচ্ছে নির্বাচন। অতিসম্প্রতি ভারতের কয়েকটি রাজ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে অন্যত্র যাই হোক না কেন পশ্চিমবঙ্গ চমক ফিরিয়ে এনেছে। শাসক দল যদি ক্ষমতায় থাকে তাহলে বদনামের শিকার হয় অনেক। বিরোধীদের কাজ হচ্ছে- সর্বতোভাবে সরকারপক্ষকে পরাজিত করা। আর সরকারপক্ষের কাজ বিরোধীদের অব্যাহত বদনাম রটানো। বিশেষত এটাই সত্য যে, বিরোধী দল শত রটনা করেও মমতাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেনি।
বামঘেঁষা পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যম জোরেসোরে বলছিল যে এবার কংগ্রেস সমর্থিত বাম জোট ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু অবশেষে শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে মমতা আবার ক্ষমতায় এলেন। দীর্ঘকাল ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গকেন্দ্রিক রাজনীতি করে আসছেন। ক্ষমতার ভিত্তি পশ্চিম বাংলাকে করায়ত্ত করার জন্য তিনি কোনো নির্দিষ্ট দল বা আদর্শকে ধারণ করেননি। তাই দেখা যায় যে, কখনো তিনি কংগ্রেসের মিত্র আবার কখনো শত্রু। সুদীর্ঘ ৩৫ বছরের বাম শাসনে তিনি অসম্ভব সাহসিকতার সঙ্গে বাম ক্যাডারদের মোকাবিলা করেছেন। নির্যাতিত হয়েছেন। একসময় মনে হয়েছে, তিনি নিঃশেষ হয়ে গেছেন। আবার পুনরুদ্যমে সরব হয়েছেন। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে সর্বভারতীয় রাজনীতির পরিবর্তে আঞ্চলিকতা তীব্রতর হয়েছে। সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় রাজনীতিকেন্দ্রিক কংগ্রেস ও বিজিপির পরাজয়- আঞ্চলিকতারই বিজয়। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে এই কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্নতা একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়।
আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় বামজোটের অব্যাহত পরাজয়। ক্ষমতাসীন থাকার সময় বামশাসনের ফলে বেশকিছু সুফল সাধারণ মানুষ পেয়েছে। শহরে হকার, ছোট দোকানি এবং নিম্ন আয়ের লোকদের বাম সরকার যথেষ্ট সহায়তা দিয়েছে। গ্রামগঞ্জে ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ নীতি কায়েম হওয়ায় বাম সরকারের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়েছে। বাম সরকারের দীর্ঘ বছরগুলোতে মারাত্মক দুর্নীতির কোনো খবর পাওয়া যায়নি। সামগ্রিকভাবে বামশাসনে পশ্চিমবঙ্গ ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পমুক্ত। কিন্তু তারপরও বামদের ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। এর কারণ বিশ্লেষণ করলে কতগুলো বিষয় স্পষ্ট হবে : (ক) মানুষ বেশি দিন কোনো দল বা ব্যক্তিকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। মানুষ গণতন্ত্র চায়। উপযোগের ক্রমহ্রাসমান বিধি অনুযায়ী যদি একজন ব্যক্তিকে রসগোল্লা খাওয়ানো হয়, তাহলে একসময় দেখা যাবে সে রসগোল্লা আর খেতে চায় না। মানুষের মনোভাব, মূল্যবোধ এবং চাহিদা - স্থবির নয়। (খ) প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুর অবিসংবাদিত নেতৃত্বের শূন্যস্থান পূরণ সম্ভব ছিল না। বুদ্ধদেব বসুর নেতৃত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা যায় না। তবে তিনি জ্যোতি বসুর সম্মোহনী বৈশিষ্ট্যের পরিপূরক নন। (গ) দীর্ঘ শাসনে দলীয় স্থবিরতা পরাজয়ের একটি বড় কারণ হিসেবে দেখা হয়। (ঘ) সর্বভারতীয় রাজনীতির প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গ প্রভাবিত হয়েছে। (ঙ) পার্টি ক্যাডার পর্যায়ে সোভিয়েত স্টাইলের অলসতা, অযোগ্যতা, অকর্মন্যতা এবং আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা তাদের পেয়ে বসেছিল। (চ) যে যুবশক্তি ছিল বাম রাজনীতির ধারক ও বাহক, তারা ৩৫ বছরে প্রবীণ হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে পৃথিবীব্যাপী সমাজতন্ত্রের পতন নিশ্চিতভাবেই জনগণকে প্রভাবিত করে থাকবে। স্বাভাবিকভাবেই যুব-প্রবীণের একটি ‘জেনারেশন গ্যাপ’ সেখানে তৈরি হয়েছে।
একটি গুরুতর অভিযোগ মমতা ও তাঁর তৃণমূলের বিরুদ্ধে। সেটি হচ্ছে- তারা নাকি আওয়ামী নির্বাচনী স্টাইল ধারণ করার চেষ্টা করেছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে মমতা ব্যানার্জির কোনো মমত্ব না থাকলেও ‘ভোটার ছাড়া নির্বাচন’-এর যে কৌশল আওয়ামী লীগ অনুসরণ করে চলছে, সেটা নাকি আওয়ামী নির্বাচনের পশ্চিমবঙ্গ সংস্করণ। প্রথমদিকে প্রাদেশিক নির্বাচন কমিশন মমতার আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করলেও পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপ ঘটে। অবশেষে শক্তি প্রয়োগের বিচ্ছিন্ন অভিযোগ সত্ত্বেও নির্বাচন মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে জনপ্রতিক্রিয়ায় বোঝা যায়। নির্বাচন-পরবর্তীকালে বিরোধী দলগুলোর ফলাফল মেনে নেওয়া থেকেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। নির্বাচনী ফলাফল অবশ্যই চমক দেওয়ার মতো। ২০১১ সালে তৃণমূল আতাত করেছিল কংগ্রেসের সঙ্গে। তখন তাদের আসন ছিল ১৮৪। এবারের চিত্র বিপরীত। কংগ্রেস তৃণমূলের বিপক্ষে জোট বাঁধে বামদের সঙ্গে। আবারও প্রমাণিত হলো, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কোনো কথা নেই। তৃণমূল এবার আসন পেয়েছে ২১২, কংগ্রেস ৪০ ও বাম ৩৩। এক্সিট পোলে তৃণমূলের আসন ১৬০-১৭০ এ থাকবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে তৃণমূল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতীয় গণমাধ্যমে বাম ঘরানার প্রভাব লক্ষ করার মতো। ফল প্রকাশের আগেই তারা বামফ্রন্টকে আশ্বস্ত করতে চাইছিল তারাই সরকার গঠন করবে। এখন যে অবস্থা, তাতে বামদের ভবিষ্যতে দাঁড়ানো কঠিন হবে। একসময় জনমনে বামদের জন্য সতত ভালোবাসা ছিল। এখন হাওয়া বদলে গেছে। যদি ধর্মের হাওয়া এভাবে বইতে থাকে, তাহলে পশ্চিমবঙ্গও সে হাওয়া দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। গত নির্বাচনে বিজেপি মাত্র তিনটি আসন পেয়েছিল। এবার পেয়েছে ১০টি। তবে এ কথা সত্য যে, এই হাওয়া পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতীয় জনগণের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। মানুষের প্রতি ভালোবাসার যে মূল্য আছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কার্যক্রম তার প্রমাণ দিয়েছে। তৃণমূলের সাফল্যের কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা যা বলছেন তা হলো এ রকম : (১) দুই টাকা কিলোতে চাল সরবরাহ করে মমতা যে সহজ আস্থা অর্জন করেছেন তা কঠিন বদনামেও টলেনি। (২) গ্রাম-বাংলায় গত কয়েক বছরে যে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে, তা জনগণকে তুষ্ট করেছে। (৩) দুর্নীতির যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তা শহুরে মানুষকে কিছুটা বিভ্রান্ত করলেও গ্রামে চিড় ধরাতে পারেনি। (৪) কিছু পপুলাস প্রোগ্রাম বা জনতুষ্ট কর্মসূচি মমতার আবেদন ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে। যেমন-ঘরে ঘরে লেখাপড়া করার তাগিদ, প্রতি পরিবারে সাইকেল বিলি, কন্যাদায়গ্রস্ত বাবাদের অর্থ সাহায্য, ক্লাবে ক্লাবে অনুদান ইত্যাদি। এসব জনমোহিনী পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি সহজেই গ্রাম-বাংলার মন জয় করেছেন। (৫) যথেষ্ট কুশলতার সঙ্গে এসব সাফল্যের খবর জনগণের মধ্যে জড়িয়ে দিয়েছেন। (৬) সীমান্ত পার্শবর্তী এলাকায় ‘অনুপ্রবেশ’ একটি সংবেদনশীল বিষয়। বিজেপি এবং অন্যরা যখন অনুপ্রবেশকারীদের সম্পর্কে আতঙ্ক ছড়াচ্ছিল, তখন বুদ্ধিমতী মমতা তাদের প্রতি সহনাভূতি প্রদর্শন করেন। ফলে দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশ থেকে আসা বিপুল জনগোষ্ঠী তার প্রতিও সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে। (৭) নির্বাচনের সময়ে গণমাধ্যমের লোকেরা বলেছিল, ৩০% মুসলিম জনগোষ্ঠী তৃণমূলের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন। বিশেষ করে বাম ঘরানা আগের মতো মুসলমানদের আশ্বস্ত করেছে। কিন্তু নির্বাচনী ফলাফলে দেখা গেছে, মুসলমানরা তৃণমূলের সঙ্গেই আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মুসলিম অধ্যুষিত বেশির ভাগ অঞ্চলে জিতেছে তৃণমূল। তৃণমূলের প্রার্থী হয়ে রেকর্ডসংখ্যক মুসলিম বিধানসভার সদস্য হয়েছেন।
তৃণমূল সরকার পশ্চিম বাংলায় এর আগে মসজিদ-মাদ্রাসা এবং মুসলিম শিক্ষা অনুকূল যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তাতে মমতাকে জামায়াতের সমর্থক বলেও প্রচার চালানো হয়েছিল। এপার বাংলায় এবং ওপার বাংলায় সত্য-মিথ্যা কিছু গল্পকাহিনী প্রচার করা হয়েছিল, তাতে কাজ হয়নি। বরং মুসলিম জনগোষ্ঠীতে ওই প্রচারণা বুমেরাং হয়েছে। বিশ্বস্ততার সঙ্গে তারা থেকেছে তৃণমূলের সঙ্গে।
ভারতে বিধানসভা নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিধানসভা নির্বাচন প্রমাণ করে ওই রাজ্যে কারা শক্তিশালী। পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন বা লোকসভা নির্বাচনে এর প্রভাব অবশ্যম্ভাবী। সাম্প্রতিক সময়ে পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এই রাজ্যগুলো হলো আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, তামিল নাডু, কেরালা ও পদুচেরি। এসব নির্বাচনে জাতীয় দলগুলোর বিপর্যয় এবং স্থানীয় দলগুলোর বিজয় লক্ষ করা যায়। জাতীয় দল হিসেবে কংগ্রেস এবং বিজেপির অবস্থান ভরাডুবির দিকে। মোদি হাওয়া চারটি রাজ্যে কোনো কাজ করেনি। বরং দিল্লি ও বিহারে বিজেপির পরাজয়ের পর এবার এসব নির্বাচনের মাধ্যমে কিছু নেতিবাচক হাওয়া পরিদৃষ্ট হলো। যা হোক, কেরালায় পুরোনো বামগোষ্ঠী ক্ষমতায় বহাল রয়েছে। তামিল নাডুতে দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও জয়ললিতা জয় লাভ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সম্ভাবনা তিরোহিত হয়েছে। ছোট্ট রাজ্য পদুচেরিতে কংগ্রেস সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। একমাত্র ব্যতিক্রম আসাম। আসামে ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গের বিপরীত ঘটনা। ‘অনুপ্রবেশ’ ইস্যু সেখানে ভোটের মাত্রা নির্ধারণ করেছে। আসামে বিজেপি সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে জয়লাভ করেছে। সেখানে ৩৩ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠী হুমকির মধ্যে রয়েছে। আসামে কয়েকটি সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দল সাম্প্রদায়িকতার আগুনে হাওয়া দিয়েছে। এরা হলো- একসময়ের কংগ্রেসের মিত্র আসাম গণপরিষদ ও বড়োল্যান্ড পিপলস ফ্রন্ট। আসামে মুসলিমদের মাওলানা আজমলের নেতৃত্বাধীন দল এআইডিএফের আসনসংখ্যা কমে এসেছে। দীর্ঘদিন আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ এককভাবে নির্বাচন করতে বাধ্য হয়েছেন। নবনির্বাচিত সরকারের নেতারা বলছেন, আসাম সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া সমাপ্ত করবেন। নদীগুলোতেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। আসামে বসবাসরত মুসলিম জনগোষ্ঠীকে পুশব্যাক করবেন। সে ক্ষেত্রে আসাম-বাংলাদেশ সীমান্ত উত্তপ্ত হওয়ারই কথা। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকারের তরফ থেকে ওই সমস্যা সমাধানে কোনো নির্দেশনা এ পর্যন্ত আসেনি এবং অনুসৃত তোষণনীতির তোড়ে সে সম্ভাবনাও কম।
আসামের মুসলমানদের সামনে ঘোর দুর্দিন। তাদের নিয়ে বাংলাদেশ বেশ বড় সমস্যায় পড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞমহল এরই মধ্যে মন্তব্য করেছেন। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মুসলমানদের প্রতি তৃণমূল কংগ্রেস সহায়ক হলেও বাংলাদেশের প্রতি বিরূপ। সবাই জানে যে, বাংলাদেশের প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যয়ের মমত্ব না থাকার কারণে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। মনমোহনের বাংলাদেশ সফরের সময় প্রান্তিক পর্যায়ে এসে বেঁকে বসেন দিদি। তখন মনে করা হচ্ছিল, সমাগত নির্বাচনকে সামনে রেখেই কুশলী রাজনীতিবিদ মমতা মুখ ফিরিয়েছেন। এখন বাংলাদেশের মানুষ সীমান্তে গণহত্যা এবং ফারাক্কা চুক্তির বিষয়ে আশা-নিরাশার দোলে সময় অতিবাহিত করছে। প্রতিবেশী দুটি রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল বাংলাদেশের মানুষের আশঙ্কার কারণ না হয়ে উঠুক-এটিই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : কলামিস্ট ও অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়